পোস্টস

ফিকশন

বাজার

১৮ মে ২০২৪

সাজিদ রহমান

মূল লেখক সাজিদ রহমান

বাজারে ঘরের মানুষ আছে, থাকে ঘরছাড়া মানুষও। ছোটবেলায় সব বাবা-মা সন্তানকে নিষেধ করে বাজারে বেশি না যেতে। শুধু সন্তান নয়, মানুষও নষ্ট হয় বাজারে। সমাজই খারাপ মানুষকে বাজারি বলে গালি দেয়। অথচ বাজার ছাড়া সমাজের চলেনা। চোর বা সন্ন্যাসী, বেশ্যা কিংবা বুজুর্গ, বাজার সকলের। বাজার সমাজের এমন একটি অংশ যেখানে যোগী ও ভোগী উভয়কে পাওয়া যায়।

শুধু যোগী ও ভোগী নয়, সংসারের সকল শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা সেখানে। সেজন্যই বাজারকে সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে অদ্ভূত জায়গা বলা হয়। বাজারে দেখা মিলে সমাজের নানা শ্রেনীর, হরেক পেশার মানুষের। গুণীজনরা একটা কথা বলে থাকেন, ছাত্র জীবনে যে মেস বা হলের গনরুমে দিন কয়েক কাটায়নি কিংবা পচা-কাদা মাড়িয়ে, দুর্গন্ধের সুবাস মেখে মেরে-কেটে দুই/চার দিন কাচা বাজারের ব্যাগ টানেনি, তার এক জীবনে কখনই আর যাই হোক পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি) আসবে না। গুরুজনদের  সেই বাণী আমার কাছে অজানাই ছিলো। অনেক আগে থেকে বাজার করি বলে নিজেকে বাজার-পাশ ভাবতেই ভালো লাগে। বাজার-পাশ হলেই কি তাঁকে বাজারি বলা যাবে? সেটা অবশ্য জানা নেই। বাজারে যাই পেটের দায়ে। রোজ রোজ ক্ষুধার যে খোরাক, তা এই বাজারেই মিলে। বাজারে কি অন্য রকম ঘটনা ঘটতে পারে? একদিন সদাই কিনতে বাজারে গিয়ে তারই কিছু কিছু জবাবের সন্ধান খুঁজে ফিরি।  

২.

বাসায় বাজার সদাই নাই। একটা ব্যাগ ও ফর্দ নিয়ে সেই বাজারের নিয়াতে রিকশায় উঠি। মাছের রাজা ইলিশ, জামাইয়ের রাজা পুলিশ। সবই পাওয়া যায় এই বাজারে। পুলিশ যখন বাজারে যায়, ইলিশ-পুলিশ দুইজনকেই পাওয়া যায়। বাজারে ঢুকে সোজা সবজির বাজারের দিকে চলে যাই। কলমি শাক, পালং, কাঁচ-কলা, বরবটি, টমেটো কিনি। সবচেয়ে বেশি শব্দের হল্লা চলে মাছ-বাজারে। ইচ্ছে না থাকলেও সেখানে যেতে হয়। আমার বাসার ছোটবড় সকলের ছোট মাছের ভক্ত। কিন্তু মাছ বাজারে এলেই মনে খচখচ করে, বেশি দামে পচা মাছ গছিয়ে দিলো নাকি! তবুও খোদার উপর ভরসা রেখে মাছ কিনতে হয়। কিছুটা দেখে আর বাকিটা খুব মাছ চিনি ওরকম ভাব নিয়ে টেংরা-কই-গচি-পোয়া পাঁচ-মিশালি মাছ কিনি। 

আগের আমলের যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এই খান আমির, শাহরুখ কিংবা সালমান খান নয়। পরিবার ভেঙে ‘যার যার তার তার’ হয়ে গেছে। সেই জন্য বাজার হয়েছে ‘যার যার তার তার’ পরিবারের যৌথ প্রযোজক। বাজার নিজ দায়িত্বে হলুদগুড়া, মসলাগুড়া থেকে শুরু করে অনেক কিছুই রেডি করে দিচ্ছে। এমনকি বাজারে আছে সুলভে মাছ কাটার সুব্যবস্থা। মাছ পাল্লায় উঠানোর সাথে সাথে মাছ কাটার খালারা ডাকতে থাকেন। প্রায়শই একজন খালার কাছে মাছ কেটে নেই। সেই খালা মাছ কাটতে খুব এক্সপার্ট। তবে ছোটমাছ কাটতে বেশ সময় লাগে। খালাকে মাছ কাটতে দিয়ে বাকি বাজার সারতে থাকি। অনুপস্থিতিতে মাছ সরানোর কোন ভয় নাই। আবার  অন্য কোন কাজ না থাকলে পাশে অপেক্ষাও করি কখনও কখনও। 

খালার কাছে জানতে চাই, মাছ কিনে ঠকলাম কিনা। বরাবর খালা মাছ কেনার প্রশংসা করেন। কখনও মনে হয়, মাছ খারাপ  হলেও মিছামিছি প্রশংসা করে। মাছ পচা বলে আমাকে কিংবা মাছের দোকানদার কাউকে রুষ্ট করতে চায় না। এর সাথে জড়িয়ে আছে খালার রুটি-রুজি। বড় মাছ হলে নাড়ি-ভুড়ি, চর্বি, কলিজা একপাশে সুন্দর করে রেখে দেয়। সম্ভবত এসব দিয়ে তাদের আমিষের অভাবও পূরন হয়।

৩.

খালাকে মাছ কাটতে দিয়ে যাই মুদির দোকানে। মুদির দোকানে দাড়াতেই গোটা কয়েক ছোকড়া আমাকে ঘিরে ধরে। গৃহস্থ বাড়িতে সাগাইয়ের জন্য মুরগী জবাই করলে আশেপাশের কাঁক সমাজে খবর চলে যায়। গিন্নি সেই মুরগির ঠ্যাং কিংবা নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিলে সেটার দখল নিতে কাঁকদের মাঝে লড়াই শুরু হয়। গাঁও গ্রামে গেলে এরকম দৃশ্য চোখে পড়তে পারে। আর বাজারে গেলে এদের দেখতে পাই।  ব্যাগ ভরে যে বাজার নিচ্ছি সেটা বয়ে নিতে আমার কষ্ট হবে। ওরা আমার কষ্ট লাঘব করতে চায়। ওদের মধ্যে কয়েক জনের বয়স আবার একদম কম। ৭-৮ বছর হলেও হতে পারে। শার্ট-প্যান্ট ময়লা, মাথার ঝাকড়া চুল একদম অগোছালো। এসব দেখতে দেখতে অন্য কিছু খেয়াল করা সম্ভব হয় না। মলিন মুখটাতে হাসি হাসি ভাব করে একজন বলে, 'স্যার, ব্যাগ টানা লাগবে?' 

আজকে বাজারের তালিকা অত লম্বা ছিল না। ব্যাগের ওজনও খুব বেশি হবে না। ব্যাগ টানতে হবে না বলতে গিয়েও চুপ থাকি। লাগবে না, বললে মুখের অবস্থা কি হবে সহজেই পড়ে নিতে পারি। 

তবুও একটু রাগ রাগ ভাব নিয়ে একজনকে বলি, 'তুই পারবি?'

 'মাথায় উঠায় দিলে একদম মেইন রোডে পৌছে দিবার পারিম, স্যার।' ঝটপট উত্তর দেয়। ব্যাগ দিতে রাজি হয়েছি বুঝতে পেরে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 

 ওদেরই অন্য একজন ব্যাগ মাথায় তুলতে সাহায্য করে। বাকিরা অন্য ব্যাগের সন্ধানে চলে যায়। বেশ করিতকর্মা। মেইন রোডে রিকশা ঠিক করে ব্যাগ উঠায়ে দিয়েছে। দশ টাকা নিয়ে খুশি মনে ফিরে যায়। আমার মত অন্য কারও খোঁজে, নতুন ব্যাগের সন্ধানে।

৪.

সময় ঘুরে ঘুরে ঈদের মৌসুম আসে। উৎসবের এই সময়টায় বউ-বাচ্চা নিয়ে ঈদের শপিং এ বের হই। শপিং মলের দোকানগুলোতে নতুন নতুন ছেলেদের আমদানি হয়েছে। ঈদ-পূজা এলে শপিং মল জুড়ে মৌসুমি চাকরির ব্যবস্থা হয়। এদের মধ্যে যারা একটু বড় তারা দোকানের ভিতরে কাজ করে। তাদের কাজ মূলত কাস্টমারকে দেখানোর পর অগোছালে শার্ট, প্যান্ট কিংবা থ্রি-পিছ গুছায়ে রাখা। অন্যদিকে দুয়েক জন থাকে কাস্টমার আসলে দোকান/শোরুমের গেট খোলা-বন্ধ করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়তি কিছু ফুট-ফরমায়েশ তামিল করতে হয়। সেদিন এক পিচ্চির কাছে জানতে চাইলাম, 'কত দেয়?' রোজা শেষে ফিক্সড আড়াই হাজার দিবে। ব্যবসা হাউজফুল হলে আরও কিছু পাবে। এমন আশায় কাজ করে যাচ্ছে।

৫.

রমজান মাসের সময়টাতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেশ পরিবর্তন আসে। আমার মত মানুষেরও ধর্মীয় অনুশাসনে চলার বেশ চেষ্টা থাকে। বাজারের পাশে মসজিদ। সেখানে এশা ও তারাবির নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষে হাটতে হাটতে একটা স্কুলের সামনে চলে আসি। সেই মোড়ে রয়েছে একটি বঙ্গবন্ধুর ম্যূরাল। সাম্য শান্ত দৃষ্টি। আয়তনে বিশাল। সুদৃশ্য। মুরালের পাশে মহাসড়ক। রাত দিন সেই মহাসড়কে আসা যাওয়া হাজারও মানুষের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।  পাশে একটা চায়ের টং দোকান। আগেই সময় দেয়া থাকে। একে একে সেখানে জড়ো হয় কয়েক জন বন্ধু। বন্ধুর কলিগ। কলিগের বন্ধু। সেখানে বসলেই পাশের টং এর মামা চা দিয়ে যায়। কখনওবা আখের রসও খাই। মসজিদ থেকে মুরালের পথে রাস্তার পাশে কয়েক জন বয়স্ক লোক বসে। কেউ বেঁচে শাক, কেউবা কলা। বাজারের চেয়ে বেশ কম দামেই এখানে শাকসবজি কিংবা কলা পাওয়া যায়। কয়েক দিন থেকে খেয়াল করছি, রাত ১০টা বাজে বাজে। পাশে বৃদ্ধ চাচা ছোট একটা কুপি জ্বালিয়ে নিজের ও তার দোকানের অস্তিত্ব জানান দেয়। আন্দাজ করি বয়স ৭০ ছুই ছুই হবে। সম্ভবত বাসায় কলা আছে। তবুও সেই চাচার দোকানের সামনে দাড়াই। দুইটা কলা কিনে খাই। খেতে খেতে চাচার বাড়ি-ঘর, সংসারের হদিস জানতে চেষ্টা করি। চাচার ৩ মেয়ে, ২ ছেলে। ছেলেরা দেখে কিনা এই প্রশ্নও করে বসি।

 'সবার সংসারত অভাব বাহে, কায় কাক দেখে'?

ঠিক এভাবেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন চাচা। চাচা জানেন এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নেই। উনাকে দেখে বুঝতে পারি, তিনি জবাব আশাও করেন না। হয়ত সেই প্রশ্ন অদৃষ্টের কাছেই করে রাখেন। মনে মনে একবার ভাবি, চাচাকে কয়টা টাকা দিয়ে সাহায্য করি। আবার চিন্তা করি, চাচা ব্যবসা করে সংসার চালান। যদি এরকম অযাচিত অনুগ্রহ নিতে অস্বীকার করেন? সেটা মাথায় আসতেই ঐ চিন্তা থেকে পিছু হটি। আর আমার যৎ-সামান্য অর্থ চাচাকে রাত জেগে কুপি জ্বালিয়ে কলা বেচা থেকে রেহাইও দেবে না। বাসার জন্য আরও কয়টা কলা নিই। কলার দাম মিটিয়ে সামনে চলে যাই। 

৬.

এমন লাখো মানুষ সারা দেশে। একটা করে বছর আসে, সাথে নিয়ে আসে ঈদ। সেই ঈদ আনন্দময় করার জন্য মজুর-মুটে-রিক্সাচালক-দোকানের ছোকরা-কুপি জ্বালিয়ে কলা বেচতে থাকা চাচা কাজ করে যায়। বাজারের হাজারও উপাদানের মধ্যে ওরাও থাকে। এক একটা ঈদ নিয়ে আসার কথা অনাবিল আনন্দ। বয়ে যাওয়ার কথা প্রশান্তির ধারা। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়না। বাজারে জিনিসপত্রের লাগামহীন দামে নাভিশ্বাস উঠে। দুনিয়ার এই বাজারে এঁরা যেন পায়ে গলানো জুতার মত। ঘরে-বাইরে চলতে গেলে যে জুতা শরীরকে রক্ষা করে নোংরা হওয়া থেকে। সেই জুতা আনন্দের সাথে নোংরা নিজের গায়ে মেখে নেয়। তবু তার নিস্তার নেই। সেটা ছিঁড়ে গেলে ডাস্টবিনে ছুড়ে দিয়ে নতুন এক জোড়া পায়ে গলিয়ে নেই।

মোড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর ম্যূরালের দিকে ফের দৃষ্টি যায়। আয়তনে বিশাল। সুদৃশ্য। মুরাল তাঁর সাম্য শান্ত দৃষ্টি নিয়ে অপলক চেয়ে থাকে।  (সমাপ্ত)