সিংড়ার ছোট্ট গ্রাম হরিপুরে কালা মনসুর ছিল সবার পরিচিত নাম। ছোট থেকে বড়, সবাই তাকে চিনত তার চিরকালীন কাজের জন্য—বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেড়া মেরামত করা। মনসুরের জীবনে কোনো বড় স্বপ্ন ছিল না। তার দিন শুরু হতো বাঁশ কাটার জঙ্গলে গিয়ে আর শেষ হতো গ্রামের চায়ের দোকানে হুক্কা টেনে।
একদিন সকালে চায়ের দোকানে বসে মনসুর শুনল গ্রামের মাইকিং, “প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হবে। সবার হাতে ইন্টারনেট পৌঁছাতে হবে!” মনসুর এসব নতুন কথা কিছুই বুঝল না। তবে সে মনে মনে ভাবল, "এই ডিজিটাল ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বড় কিছুর নাম।"
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস! রাজধানীতে এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রযুক্তি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী ভুল করে ঘোষণা দিয়ে ফেললেন, “আমাদের নতুন আইসিটি মন্ত্রী হলেন মনসুর।” দপ্তরের লোকেরা বোঝার আগেই নামটা পাস হয়ে গেল।
পরদিন সকালে হরিপুরে একটা গাড়ি এসে থামে। গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখে, কালা মনসুরকে নিতে রাজধানী থেকে লোক এসেছে। মনসুর তো ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। লোকেরা তাকে বোঝাল, “তুমি এখন মন্ত্রী! চলো, অফিসে যেতে হবে।”
গাঁয়ের লোকেরা ভিড় করে বলল, “আমাদের মনসুর মন্ত্রী হয়েছে! এখন ডিজিটাল বাঁশের যুগ আসবে।” আর মনসুর? সে শুধু ভাবছিল, “ডিজিটাল আবার কী জিনিস?”
কালা মনসুরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো এক বিলাসবহুল গাড়িতে। জীবনে প্রথমবার গ্রামের বাইরে পা রেখেছে সে। চারপাশের বড় বড় বিল্ডিং দেখে তার মাথা ঘুরে গেল। গাড়ি গিয়ে থামল এক বিশাল দালানের সামনে। গেটে লেখা, "তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়"।
ভেতরে ঢুকেই মনসুরকে একটা চেয়ারে বসিয়ে চা-নাশতা দেওয়া হলো। একের পর এক মানুষ এসে তার সামনে ফাইল পেশ করতে শুরু করল। কেউ বলল, "স্যার, এই প্রকল্পে আপনার সই দরকার।" কেউ আবার বলল, "স্যার, নতুন প্রযুক্তি নিয়ে মিটিং আছে।" মনসুর বুঝতে পারল না কিছুই।
এক পর্যায়ে এক কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আপনার প্রথম নির্দেশনা কী হবে?” মনসুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “সব কাজ সহজ করতে হলে বাঁশ লাগে। প্রথমে বাঁশের যোগান বাড়াও। বাঁশে যদি তার লাগাও, সবাই ফ্রি ইন্টারনেট পাবে। তার পর আর কেউ আমার মতো বোকা থাকবে না।”
কর্মকর্তারা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল। তবে কেউ কিছু বলল না, কারণ মনসুর এখন মন্ত্রী। তার কথাকে সম্মান জানাতে সবাই "ডিজিটাল বাঁশ প্রকল্প" নামে একটা ফাইল তৈরি করে ফেলল।
দিনশেষে মনসুর নিজের মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কামরায় গিয়ে বসল। চেয়ারটা এত নরম যে, বসেই তার ঘুম পেয়ে গেল। নিজের মনে সে বলল, “মন্ত্রী হওয়া মন্দ নয়। তবে এরা এত ফাইল নিয়ে কেন দৌড়াদৌড়ি করে? বাঁশে যদি কাজ হয়, তাহলে এত ঝামেলা কিসের?”
মনসুর তখনও জানত না, তার এই ‘বাঁশ প্রকল্প’ কীভাবে সবার মাথা ঘুরিয়ে দেবে।
পরদিন সকালেই "ডিজিটাল বাঁশ প্রকল্প" নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছিল, "এটা কী উদ্ভট বিষয়!" অন্যরা বলল, "মন্ত্রী যা বলেন, সেটাই তো করতে হবে।"
কর্মকর্তারা বাঁশের খুঁটিতে ইন্টারনেট ক্যাবল লাগানোর আইডিয়া নিয়ে একটি সভার আয়োজন করল। মনসুর সেখানে উপস্থিত ছিল, আর সে গম্ভীর মুখে বলল, “গ্রামে দেখেছি, বাঁশ অনেক ভারি জিনিসও টানতে পারে। তোমরা যদি তার দিয়ে বাঁশ জুড়ো, সব জায়গায় ইন্টারনেট চলে যাবে। এবার এই কাজ শুরু করো!”
সভা শেষ হতেই একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করল, “স্যার, প্রযুক্তির উন্নয়নে তো আরও অনেক কিছু করা যায়। তবে বাঁশ কেন?” মনসুর চশমা ঠিক করে উত্তর দিল, “গ্রামে বাঁশ ছাড়া কিছুই হয় না। বাঁশ দিয়ে বেড়া হয়, খুঁটি হয়, এমনকি আমার দাদার বাড়িতে তো বাঁশের সাঁকো দিয়েই নদী পার হতাম। তুমি কিছু জানো না। বাঁশ মানেই সাপোর্ট!”
মন্ত্রণালয়ে থাকা সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে খবর ছাপাল, “নতুন আইসিটি মন্ত্রীর ডিজিটাল বিপ্লব—বাঁশে ইন্টারনেট!” সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই সারা দেশে হাস্যরস শুরু হলো। টিভি টক শোতে কেউ বলল, “দেশের ভবিষ্যৎ বাঁশের ওপর নির্ভর করছে!” আবার কেউ বলল, “আমাদের এমন সৃজনশীল মন্ত্রী আগে কখনও হয়নি।”
তবে গ্রামের লোকজন বিষয়টি ভীষণ সিরিয়াসলি নিল। তারা ভাবল, “আমাদের মনসুর মন্ত্রী হয়েছে বলে পুরো দেশ বাঁশ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে!”
এদিকে মন্ত্রণালয়ের ভেতরে প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হলো। প্রকৌশলীরা পরীক্ষা করতে গিয়ে সত্যিই দেখল, বাঁশের খুঁটি সস্তা, টেকসই এবং গ্রামে সহজলভ্য। মনসুরের কথায় মজার কিছু দেখালেও, কিছু বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে বেশ বাস্তবসম্মত ভাবতে শুরু করল।
মনসুর নিজের চেয়ারে বসে খুশি মনে ভাবছিল, “দেখলি তো! বাঁশের দাম এখন সোনার মতো হয়ে যাবে!”
মনসুরের "ডিজিটাল বাঁশ প্রকল্প" যখন আলোচনার শীর্ষে, তখন একদিন প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে ফোন দিলেন। মনসুর ভয়ে ঘামতে ঘামতে ফোন তুলল। প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, “শুনেছি তুমি বাঁশ দিয়ে ইন্টারনেট দিতে চাচ্ছ?”
মনসুর মাথা চুলকে বলল, “জি আপা, এই বাঁশই তো গ্রামে সব সমস্যার সমাধান করে। আপনারা শহরে থাকতে বুঝবেন না। বাঁশ শক্ত জিনিস, আর সস্তাও। এটা ঠিকমতো লাগালে ইন্টারনেটও শক্ত আর টেকসই হবে।”
প্রধানমন্ত্রী একটু থেমে বললেন, “ঠিক আছে, তুমি কাজ চালিয়ে যাও। তবে খেয়াল রেখ, হাসির পাত্র যেন না হও!” মনসুর ফোন রেখে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। সে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলল, “এবার তো প্রধানমন্ত্রীরও অনুমতি পাওয়া গেল। এখন কাজ শুরু করো!”
কাজ শুরু হলো দ্রুত। প্রথমে ঢাকার একটি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে বাঁশের খুঁটিতে ইন্টারনেট ক্যাবল লাগানো হলো। পুরো প্রক্রিয়া দেখতে নিজে উপস্থিত ছিল মনসুর। লোকজন জড়ো হয়ে বলছিল, “এই প্রকল্প কাজ করবে তো?”
মনসুর হাত উঁচিয়ে ঘোষণা দিল, “বাঁশ দিয়েই হবে সেরা বিপ্লব। আমার কথা মনে রাখবেন।”
পরীক্ষার ফলাফল এল এক সপ্তাহের মধ্যে। দেখা গেল, প্রকল্প বেশ ভালোই কাজ করছে! খরচ কম, স্থায়িত্ব বেশি। এবার প্রকল্পকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো।
এদিকে টিভি আর খবরের কাগজে মনসুরকে নিয়ে আলোচনা থামছে না। কেউ বলছে, “এ লোক পাগল!” আবার কেউ বলছে, “অন্য রকম চিন্তা না করলে বড় কিছু হয় না।”
গ্রামে প্রথমবার যখন বাঁশের খুঁটিতে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হলো, তখন সবাই অবাক। মনসুর নিজেই গ্রামে এসে বলল, “এই দেখ, বাঁশে শুধু বেড়া হয় না, ইন্টারনেটও চলে!”
গ্রামের বাচ্চারা মোবাইলে ইউটিউব চালাতে শুরু করল। বুড়োরা টিকটক একাউন্ট করল। আর মনসুর? সে চা দোকানে বসে হুক্কা টানতে টানতে বলল, “দেখলি তো, আমার বাঁশ কেমন কাজ করে?”
বাঁশে ইন্টারনেট আসার পর হরিপুর গ্রাম পুরো বদলে গেল। বাচ্চারা মোবাইল ফোনে গেম খেলতে শুরু করল, স্কুলের শিক্ষকরা ইউটিউব দেখে ক্লাস নিতে লাগল, আর চা দোকানে বসে বুড়োরা ফেসবুকে ছবি আপলোড করার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠল।
গ্রামের সবার মুখে এখন শুধু একটাই কথা—"আমাদের মন্ত্রী মনসুর ভাই সারা দেশে হরিপুরের নাম উজ্জ্বল করে দিলেন!" মনসুরও এই প্রশংসা উপভোগ করতে লাগল। সে হরিপুরে এসে চা খেতে খেতে বলত, “আমি তো বলেছিলাম, বাঁশ দিয়েই সব হবে। তোমরা এখন বুঝছ, কেন আমি বাঁশের ওপর ভরসা করি।”
তবে শহরের দিক থেকে কিছু সমস্যাও দেখা দিতে লাগল। টিভি টক শোতে এক বড় প্রযুক্তিবিদ বললেন, “বাঁশ দিয়ে ইন্টারনেট স্থায়ী হবে না। এটা একটা হাস্যকর উদ্যোগ।” আরেকজন বললেন, “বাঁশ টেকসই হলেও, এটা আধুনিক প্রযুক্তির বিকল্প হতে পারে না।”
এই সব শুনে মনসুর গম্ভীর মুখে মন্ত্রণালয়ে ফিরে এল। সে কর্মকর্তাদের ডেকে বলল, “তোমরা কি মনে করো আমার বাঁশের কাজ টিকবে না?” এক কর্মকর্তা ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার, কিছু লোকের সন্দেহ থাকতেই পারে। তবে প্রকল্প এখনো ভালো চলছে।”
মনসুর রাগে বলল, “বাঁশ তো বাঙালির গর্ব। এখন তোমরা বলো, বাঁশ টিকবে না? এবার নতুন কিছু করতে হবে। বাঁশের সঙ্গে এমন কিছু যোগ করো, যাতে শহরের লোকজনও অবাক হয়!”
কর্মকর্তারা তার কথা শুনে আবার নতুন উদ্ভাবনের জন্য কাজে লেগে গেল। এদিকে মনসুর গ্রামে ফিরে গিয়ে বলল, “তোমরা চিন্তা করো না। আমি বাঁশ দিয়ে এমন কিছু করব, সারা দেশের লোক দেখবে!”
এরপর থেকে গ্রামে লোকজন মনসুরকে "ডিজিটাল গুরু" বলে ডাকা শুরু করল। আর মনসুর? সে একদিন চায়ের দোকানে হুক্কা টানতে টানতে বলল, “দেখ, শহরের মানুষ যাই বলুক, বাঁশ কখনো হার মানবে না!”
হরিপুরে বাঁশের খুঁটিতে ইন্টারনেট আসার পর গ্রামের মানুষ একের পর এক চমক দেখাতে শুরু করল। গ্রামের এক বালক, পোল্টু, ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে রাতারাতি "ডিজিটাল তারকা" হয়ে উঠল। আরেকজন, বুড়ো রমিজ, টিকটকে নাচানাচি করে সেলিব্রিটি হয়ে গেল।
এদিকে মনসুর ঢাকায় বসে ভাবছিল, “গ্রামে তো বেশ উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু শহরের বড়লোকদের বুঝতে হবে যে, বাঁশে কত ক্ষমতা!” মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে সে গম্ভীর মুখে বলল, “এবার ঢাকার ফুটপাতে বাঁশ দিয়ে ফ্রি ওয়াইফাই দিতে হবে। বাঁশের কদর শুধু গ্রামে থাকবে কেন?”
বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা প্রথমে চোখ গোল গোল করে তাকাল, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করল না। “বাঁশের ওয়াইফাই” নামে নতুন এক প্রকল্প অনুমোদন পেয়ে গেল।
কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকার কিছু জায়গায় বাঁশের খুঁটি বসিয়ে ফ্রি ওয়াইফাই দেওয়া শুরু হলো। লোকজন অবাক হয়ে দেখল, বাঁশের খুঁটি থেকে সত্যি সত্যি ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে!
তবে মজার ব্যাপার হলো, মনসুর প্রকল্পের উদ্বোধনে এসে বলল, “এই দেখ, বাঁশ দিয়ে কাজ শুরু করেছি। এবার বাঁশ দিয়ে রকেট বানানো যায় কিনা, সেটাও ভাবছি!” সাংবাদিকরা তার কথা শুনে অবাক হয়ে হেসে ফেলল।
এদিকে, বাঁশের খুঁটিতে ইন্টারনেট পেয়ে ঢাকার তরুণেরা রাস্তায় বসেই কাজ শুরু করল। কেউ ক্যাফেতে না গিয়ে রাস্তায় বাঁশের নিচে বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছে। টিভি নিউজে খবর হলো, “দেশে বাঁশের বিপ্লব শুরু। রাস্তায় বসেই তরুণেরা ফ্রিল্যান্সিং করছে!”
মনসুর তখন মনে মনে বলল, “বাঁশ তো মানুষকে গরিব থেকে বড়লোক বানায়। আমি সত্যিই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”
তবে সমস্যাও শুরু হলো। একদিন রাতে এক এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে ফোন দিয়ে মনসুর রাগে বলল, “কী হলো? বাঁশের লাইনে সমস্যা কেন?”
কর্মকর্তা বলল, “স্যার, কেউ বাঁশ চুরি করে নিয়ে গেছে। খুঁটি ভেঙে নিয়েছে!”
মনসুর কপালে হাত দিয়ে বলল, “এখন তো বাঁশের সিকিউরিটি দিতে হবে। বাঁশ বাঁচাও আন্দোলন শুরু করতে হবে!”
বাঁশ চুরির খবর সারা দেশে হাসির রোল ফেলে দিল। পত্রিকায় শিরোনাম হলো, “ডিজিটাল বাঁশের নিরাপত্তা কে দেবে?” টিভি টক শোতে কেউ বলল, “এবার হয়তো মন্ত্রী মহোদয় বাঁশে তালা লাগানোর প্রকল্প চালু করবেন!”
তবে মনসুর এসব কথা শুনে চুপ থাকল না। মন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভায় সে বলল, “বাঁশ চুরি মানে দেশের উন্নয়নে বাধা দেওয়া। এবার বাঁশের খুঁটিতে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে!”
কর্মকর্তারা মাথা চুলকাতে চুলকাতে কাজ শুরু করল। কিছুদিনের মধ্যেই বাঁশের খুঁটির মাথায় ছোট ছোট ক্যামেরা বসানো হলো। এবার মনসুর ঘোষণা দিল, “আমাদের বাঁশ এখন স্মার্ট বাঁশ। কেউ চুরি করতে এলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়বে।”
স্মার্ট বাঁশ প্রকল্প আবার সাড়া ফেলে দিল। শহরের তরুণেরা এটা নিয়ে মিম বানাতে শুরু করল। তারা বলল, “বাঁশ এখন আমাদের থেকেও বেশি স্মার্ট!” কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, চুরি বন্ধ হলো।
এই প্রকল্পে মনসুরের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেল। গ্রামের লোকেরা মিছিল বের করল, “জয় হোক মনসুর ভাইয়ের!” আর মনসুর তার চিরচেনা গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, “আমি তো আগেই বলেছিলাম, বাঁশ কখনো মানুষকে বিপদে ফেলবে না।”
কিন্তু ঠিক এই সময়, ঢাকার এক নামি সাংবাদিক তার মন্ত্রণালয়ে এসে সরাসরি প্রশ্ন করল, “মন্ত্রী মহোদয়, বাঁশ দিয়ে কি সত্যিই দেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব?”
মনসুর গম্ভীর হয়ে বলল, “আপনি শহরের মানুষ। গ্রামে গেলে বুঝবেন, বাঁশ শুধু খুঁটি নয়, বাঁশ আমাদের আত্মা। বাঁশ দিয়েই আমরা রকেট বানাব। আপনি অপেক্ষা করুন।”
সাংবাদিক হেসে চলে গেল। কিন্তু মনসুর মনে মনে ঠিক করল, এবার সত্যিই এমন কিছু করতে হবে, যাতে সবাই অবাক হয়ে যায়। সে নিজের মন্ত্রিত্বকে ঠাট্টার পাত্র নয়, ইতিহাসের অংশ বানাতে চায়।
মনসুর এবার আরও বড় কিছু করার পরিকল্পনা নিল। সে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে গম্ভীরভাবে বলল, “ডিজিটাল বিপ্লব তো হলো, এবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমাদের দেশের নাম তুলে ধরতে হবে। বাঁশ দিয়েই এমন কিছু করতে হবে, যাতে সারা বিশ্ব চমকে যায়।”
কর্মকর্তারা এবার রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেল। একজন সাহস করে বলল, “স্যার, বাঁশ দিয়ে আর কী করা যায়?”
মনসুর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “বাঁশ দিয়ে স্যাটেলাইট বানানো যায় না?”
বৈঠক কক্ষে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী সাহস করে বলল, “স্যার, স্যাটেলাইট তো অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তি। বাঁশ দিয়ে স্যাটেলাইট তৈরি করা সম্ভব হবে কিনা তা নিশ্চিত না।”
মনসুর তেড়েফুঁড়ে উঠল। “অবশ্যই সম্ভব। বাঁশ দিয়ে যখন রাস্তার কাজ হয়, ফ্রি ওয়াইফাই হলো, স্মার্ট বাঁশ হলো, তখন স্যাটেলাইটও হবে। সমস্যা হলে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডাকো!”
কাজ শুরু হলো। বিদেশি বিজ্ঞানীরা প্রথমে এই পরিকল্পনা শুনে হেসে ফেলল। কিন্তু মনসুরের জেদ দেখে তারা বলল, “ঠিক আছে, পরীক্ষা করে দেখা যাক।”
এরপর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সর্বোচ্চ মানের বাঁশ সংগ্রহ করা হলো। মনসুর নিজে গ্রামে গিয়ে বলল, “এবার আমাদের বাঁশ মহাকাশে যাবে। তোমাদের বাঁশের ওপর দেশ গর্ব করবে!”
গাঁয়ের লোকেরা তো রীতিমতো খুশিতে নাচানাচি শুরু করল। তারা বলতে লাগল, “আমাদের বাঁশ এবার আকাশে উঠবে!”
মাস কয়েকের চেষ্টার পর পরীক্ষামূলকভাবে “বাঁশ স্যাটেলাইট” প্রকল্পের মডেল তৈরি হলো। মনসুর নিজে সেটি দেখতে গিয়ে বলল, “দেখেছ? বলেছিলাম না, বাঁশ দিয়ে সব সম্ভব!”
কিন্তু প্রকল্পের উদ্বোধনের দিন এক মজার ঘটনা ঘটল। সাংবাদিকদের সামনে মনসুর গর্ব করে ঘোষণা দিল, “এই বাঁশ স্যাটেলাইট মহাকাশে পৌঁছে আমাদের দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।”
ঠিক তখনই স্যাটেলাইটের মডেলের একটি বাঁশ খুঁটি হঠাৎ করে ভেঙে পড়ল। সাংবাদিকদের হাসির শব্দে পুরো হল গমগম করে উঠল।
মনসুর একটু থেমে গম্ভীর মুখে বলল, “এইটুকু ত্রুটি কোনো ব্যাপার না। বাঁশ সবসময় মেরামতযোগ্য। আমরা ঠিক করে আবার উৎক্ষেপণ করব!”
এই দৃশ্য রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেল। কিন্তু মজার ব্যাপার, মনসুরের আত্মবিশ্বাসে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বলল, “যদি মনসুর পারে, তাহলে আমরাও পারব!”
বাঁশ স্যাটেলাইট প্রকল্প নিয়ে হাসাহাসি হলেও মনসুর দমে গেল না। সে আরও উদ্যম নিয়ে কাজে নেমে পড়ল। এবার সে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিল, “বাঁশ স্যাটেলাইট শুধু মহাকাশে পাঠানোই হবে না, এর মাধ্যমে পুরো দেশের ইন্টারনেট সংযোগ আরও শক্তিশালী হবে।”
কর্মকর্তারা এবার একটু বেশি সিরিয়াস হয়ে উঠল। প্রকল্পে আরও আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হলো। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি দেশি বিজ্ঞানীরাও মনসুরের জেদ দেখে উৎসাহিত হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এদিকে হরিপুরের লোকেরা প্রায় প্রতিদিন মনসুরের কাছে ফোন করে খবর নেয়, “মনসুর ভাই, আমাদের বাঁশ কি আকাশে উঠবে?” মনসুর তাদের আশ্বস্ত করে বলে, “অবশ্যই উঠবে। শুধু অপেক্ষা করো। এই বাঁশ দিয়ে এমন ইতিহাস গড়ব, তোমাদের নাম সবাই জানবে।”
অবশেষে সেই দিন এলো। নতুনভাবে তৈরি "জাতীর আব্বা স্যাটেলাইট-১" উৎক্ষেপণের দিন ঘোষণা করা হলো। ঢাকার বাইরে বিশেষ উৎক্ষেপণ কেন্দ্র বানানো হলো। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থাকবেন বলে ঘোষণা দিলেন।
উদ্বোধনের দিন পুরো দেশ উত্তেজনায় টগবগ করছে। টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—সব জায়গায় একটাই খবর, “আজ আকাশে উঠবে বাঁশের স্যাটেলাইট!”
উদ্বোধনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মনসুর তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বক্তৃতা দিল, “বাঁশ আমাদের গর্ব, আমাদের শক্তি। আজ এই বাঁশ মহাকাশে গিয়ে দেখিয়ে দেবে, আমরা বাঙালিরা যেকোনো কিছু করতে পারি!”
সবার চোখ উৎক্ষেপণ যন্ত্রের দিকে। কাউন্টডাউন শুরু হলো—১০... ৯... ৮…। গ্রাম থেকে আসা মনসুরের মা, চা দোকানি রহিম আর পোল্টু একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “আমাদের বাঁশ উঠছে!”
৩... ২... ১! একটি বিশাল শব্দে রকেটটি আকাশে উড়ল। সবার মুখে প্রশংসার হাসি। মনসুর গর্বিত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি বলেছিলাম, বাঁশ দিয়েই আমরা ইতিহাস গড়ব!”
মজার ব্যাপার হলো, স্যাটেলাইট সফলভাবে কক্ষপথে পৌঁছাল। আর এর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ আরও সহজলভ্য হলো। পত্রিকায় শিরোনাম এলো, “বাঁশের বিপ্লব: ডিজিটাল বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়”।
গ্রামে ফিরে গিয়ে মনসুর চায়ের দোকানে বসে বলল, “দেখলি? বাঁশ শুধু মাটিতে নয়, আকাশেও যায়। এখন থেকে কেউ আমার বাঁশ নিয়ে হাসাহাসি করলে, তাকে মহাকাশে পাঠিয়ে দেব!”
সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল।
উৎক্ষেপণের পরের দিন পুরো দেশ জুড়ে বাঁশ স্যাটেলাইটের জয়গান। টিভি চ্যানেলগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু শুধু একটাই—"জাতীর আব্বা বাঁশ স্যাটেলাইট।” মনসুর মন্ত্রীর অফিসে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টিভির খবর দেখছিল। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গর্বভরে বলছিল, “স্যার, আপনার মতো মন্ত্রী আর নেই। আপনি ইতিহাস গড়েছেন!”
মনসুর গাম্ভীরভাবে বলল, “এটা তো শুধু শুরু। বাঁশ দিয়ে আরও অনেক কিছু হবে। এবার মহাকাশ থেকে পুরো পৃথিবীকে ইন্টারনেট দেব!”
কিন্তু বিকেলে আচমকা এক অদ্ভুত খবর এলো। স্যাটেলাইটের সংকেত বন্ধ হয়ে গেছে! কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি করে মনসুরকে জানাল, “স্যার, মনে হচ্ছে স্যাটেলাইটে কোনো সমস্যা হয়েছে। আমরা খতিয়ে দেখছি।”
মনসুর রাগে ফুঁসে উঠল, “কী বলছো? বাঁশে আবার সমস্যা হয় নাকি? তাড়াতাড়ি ঠিক করো!”
কিছুক্ষণ পর এক কর্মকর্তা আতঙ্কিত মুখে ঢুকে বলল, “স্যার, বড় বিপদ! স্যাটেলাইট মহাকাশে থাকার বদলে মাটি ছুঁয়ে ফিরে এসেছে।”
মনসুর হতবাক। “ফিরে এসেছে মানে? এটা কোথায় গেল?”
ঠিক তখনই মন্ত্রণালয়ের টিভি স্ক্রিনে “বি পাবলিক বাংলা” নামের একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ দেখানো শুরু হলো। খবরে বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশের প্রথম বাঁশ স্যাটেলাইট ভারতে ঢুকে পড়েছে! সেটি আমাদের চ্যানেলের অফিসে ভেঙে পড়েছে! বাঁশের আঘাতে বি পাবলিক বাংলার এক রিপোর্টারের মাথা কেটে গেছে”
মনসুর স্তব্ধ। স্ক্রিনে দেখানো হলো, বি পাবলিক বাংলার অফিসের মধ্যে পড়ে থাকা বাঁশের টুকরো, যার গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা—“জাতির আব্বা স্যাটেলাইট-১।” অফিসের এক কর্মী ক্যামেরার সামনে বলছে, “আমাদের অফিসে বাংলাদেশি স্যাটেলাইট এসে ভেঙে পড়েছে। আমরা জানি না এটা এখানে কেন এসেছে। তবে এটা দেখে মনে হচ্ছে, বাঁশের কাঠামো বৃষ্টিতে ভিজে দুর্বল হয়ে গেছে।”
মনসুর হতভম্ব হয়ে বলল, “বৃষ্টির পানি? মহাকাশে বৃষ্টি আসবে কীভাবে?”
কিন্তু তখনই একজন প্রকৌশলী লজ্জিত মুখে বলল, “স্যার, মনে হচ্ছে উৎক্ষেপণের সময় বাঁশের ওপর বৃষ্টি হয়েছিল। কাঠামোর ভেতরে পানি ঢুকে যায়নি তো?”
মনসুর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। বি পাবলিক বাংলার রিপোর্টার আরও বলল, “এটা কি স্যাটেলাইট নাকি কোনো বাঁশের বোমা? এর মধ্য দিয়ে ভারতবাসীকে মজা দিচ্ছে বাংলাদেশ? নাকি বিএনপি জামাতি মিনমিন করে কোন স্বরযন্ত্র করছে?”
টিভিতে দেখতে থাকা মনসুরের চোখে পানি চলে এলো। সে হতাশ গলায় বলল, “আমার এত দিনের পরিশ্রমের ফল এভাবে মাটিতে পড়ল? বাঁশের এ কী অবস্থা!”
তখনি পর্দায় আরও একটি খবর এলো। বি পাবলিক বাংলার সেই সাংবাদিক পর্দায় এলো, যে সাংবাদিকের মাথায় বাঁশের আঘাত লেগেছিলস। সাংবাদিক স্লোগান গাইতে শুরু করলো—“থাকবে না বাংলাদেশ, থাকবে না! আমি আজ রেগে কোন কথা বলবো না! আমি আহত! আমি শোকাহত! বাংলাদেশ থাকবে না!”
মনসুর একদম শোকে স্তব্ধ। চুপচাপ বসে শুধু বলল, “আমার বাঁশের স্যাটেলাইটকে অপমান করল! এটা মেনে নেওয়া যায় না।”