‘উঠছি আম্মু।’ রাইসা বলল। রোজ রাতে দেরী করে ঘুমায়, আর সকালে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে ওঠে। ইংলিশ মিডিয়াম কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী সে। সকালে ক্লাস থাকে, তাই ওর মা, মিসেস রহমান ওকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। বার দশেক ডেকে যখন মিসেস রহমান বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেন, তখন বিছানা ছেড়ে ওঠে রাইসা। সাধারণত রাত জেগে পড়াশোনা করে সে। অন্তত এই মাসখানেক আগেও করত। কিন্তু গত এক মাস যাবত ওর কি যেন হয়েছে। পড়তে বসতে মন বসে না, খালি কান্না পায়। ঘুমুতে গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়, কিন্তু ঘুম নামের সোনার হরিণ ধরা দেয় না।
সমস্যার বয়স অল্প, কেন হচ্ছে তাও রাইসা জানে। ওর বাবার নতুন বডিগার্ড হিমেল-ওর সমস্যার কারণ। ওর বাবা নামকরা ব্যবসায়ী। সব যে এক নম্বরী, তা কিন্তু নয়। আর তাই, বডিগার্ডের প্রয়োজন। সেই বডিগার্ডের উপর আবার ওর বাবা ভরসা খুব কম। কিছুদিন পরপরই তিনি পরিবর্তন করেন। হিমেলের চাকরীর বয়সও অল্প। আসল বয়স কিন্তু অল্প না। প্রায় ৪৫ হবে। চাকরী প্রথমে মি. রহমানের বডিগার্ড হিসেবে হলেও, পরিস্থিতির কারণে এখন হিমেল রাইসার বডিগার্ড। কারণ আর কিছুই নয়, মি. রহমানের বিজনেস প্রতিপক্ষের হুমকী। ব্যবসায়ী বাবা আর সমাজসেবক মায়ের একমাত্র সন্তান রাইসার নিরাপত্তার জন্য ওর বাবা কোন কিছু করতেই দ্বিধা করেন না।
আর তাই হিমেল গত একমাস হল রাইসার নিত্য সংগী। কলেজে যাওয়া আসা, স্যারদের কাছে পরতে যাওয়া-সবকিছুতেই হিমেল এখন রাইসার নিত্যসংগী। রাইসা গল্পের বইতে পরেছিল, কলেজে উঠলে মেয়েরা উলটা পালটা কাজ করে, মন উড়ু উড়ু থাকে। তাই বলে চাচার বয়সী এক লোকের প্রেমে পরে যাবে? এমনটা কোনদিন কল্পনাও করে নি।
হিমেলের প্রতি আকর্ষণটা যেমন মানসিক, তেমনি শারিরীক। রাইসা নারী পুরুষের দৌহিক ব্যাপারে অনভিজ্ঞ নয়। কলেজে পড়লেও, কুমারীত্ব হারিয়েছে আগেই। কিন্তু যাকে চাচা বল ডাকার কথা, এমন একজনের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ অনুভব করবে, এমনটা রাইসা কোনদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি।
অনেকবার চেষ্টা করেছে, সম্পর্কটাকে নিয়ে না ভাববার। খারাপ ব্যবহার করেছে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু নিজেকেই যদি সামলাতে না পারে, তাহলে এসব করে কি লাভ? অনেক চেষ্টা করেও হিমেলকে চাচা বলে ডাকতে পারে নি, শুধু হিমেলটুকুই মুখ দিয়ে বের হয়। চেষ্টা করে যেন ডাকটা মালিকের মেয়ের কর্মচারীকে তাচ্ছিল্য করে ডাকার মত শোনায়। হিমেলও হয়ত তেমনটাই ভাবে। কিন্তু আর কেউ না জানলেও, রাইসা ত নিজের মনের খবর জানে।
হিমেল থাকে ওদের তিনতলা বাড়ীর চিলেকোঠায়। আগে ছাদ নিয়ে রাইসার তেমন মাথাব্যথা না থাকলেও, এখন প্রায়ই ওকে ছাদে দেখা যায়। কলেজ থেকে একে গোসল করেই চলে যায় ছাদে, আবার বিকালে টিউশনির পরও ছাদে চলে যায়। হিমেলকে ওর মনে হয় পৌরুষ্যের এক অনুপম নিদর্শন। ওর কপালের দুই পাশের রুপালী আভা, পাথর কুদে বের করা ছয় ফুট লম্বা শরীর, রশি মত পাকান পেশী আর একটু রুক্ষ চেহারা-উফ, রাইসাকে পাগল করে দেয়। বিশেষ করে ওর চেহারাটা, দেখলেই মনে হয় রাইসার চেনা, পরিচির। হালকা রুক্ষ ভাবটা হিমেলের পৌরুষকে যেন শত গুণে। শুধু একটা দিক রাইসার মনে ভয় জাগায়। তা হল হিমেলের হাসি-ক্রুর হাসিটা দেখলে রাইসার বুকে কাঁপন দেয়, মনে হয় ভয়ের কিছু একটা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের সম্পর্কে খুব একটা তথ্য হিমেল দেয় না। তাই রাইসার চোখে ও রহস্যপুরুষ।
রাইসা নিজেও কিন্তু কম সুন্দরী নয়। পাচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ দুধে আলতা। বয়সে একটু ছোট হলেও, শারিরীক গঠন যুবতীদের ন্যায়। ভরাট গাল, সুউচ্চ বুক আর কমলার কোয়ার মত ঠোট। ঠিক উদ্দাম জীবন যাপন না করলেও, ঠিক নৈতিক জীবনও ত যাপন করে না রাইসা। তাই হয়ত তরুণী দেহে যৌবনের বান ঢেকেছে-কে বলতে পারে।
হয়ত এভাবেই আরও সময় কেটে যেত, কিন্তু এক বিকালের ঘটনায় সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। সেদিন রাইসার কলেজ ছুটি। মি. রহমান রাত করে বাসায় ফিরেন। মিসেস রহমানের প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাওয়াত থাকে। তিনিও একটু রাত করেই বাড়ী ফিরেন। রাইসা বাসায় একাই থাকে। ওহ, একা বলা ত ভুল হল। হিমেলও সাথে থাকে।
রাইসা বাসায় থাকলে সাধারণত হিমেলকে ছুটি দিয়ে দেয়। তক্কেতক্কে থাকে, হিমেল বাইরে গেলেই ওর ঘরে ঢোকার। রহস্যময় স্বপ্ন পুরুষ সম্পর্কে ওর জানতেই হবে। কিন্তু বিধি বাম, হিমেলের সব আগ্রহ যেন রাইসা আর ওর বাবার নিরাপত্তাকে ঘিরেই। ছুটি পেলেও বাড়ীর বাইরে বের হয় না। ‘আজকে ওকে বাইরে পাঠাতেই হবে।’ নিজেকেই নিজে বলে রাইসা।
যেই ভাবা সেই কাজ, বিকাল হতেই রাইসা হিমেলকে ডেকে পাঠায়। বলে, ‘হিমেল, আজকে স্যারের কাছে যাব না। এক কাজ কর বসুন্ধরায় নতুন ডমিনোস খুলেছে। আমার জন্য একটা পেপারোনী পিজ্জা নিয়ে এস।’
হিমেলকে একটু অবাক মনে হল, কেননা ও জানে যে ডমিনোসের নিজস্ব ডেলেভারি সার্ভিস আছে। কিন্তু বড়লোকের খেয়াল মনে করে কিছু এব্যাপারে চুপ রইল। একটু পর বলল, ‘উত্তরা থেকে বসুন্ধরায় যেতে আসতে একটু সময় লাগতে পারে। ঢাকার রাস্তার জ্যাম, কোন ঠিক ঠিকানা নেই।’
‘চাই তো সেটাই।’ মনে মনে বলল রাইসা। মুখে বলল, ‘অসুবিধা নাই। ধীরে সুস্থেই আন।’ এই সুযোগে আমিও একটু গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে নেই-ভাবল রাইসা।
হিমেল বেরিয়ে গেলে রাইসা দৌড়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হিমেলের দরজা লক করার আওয়াজ কানে যেতেই ফিরে এসে বসে পড়ল পড়ার টেবিলে। ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় কাঁপছে। আজকের এই সুযোগটার জন্যই অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছে সে। মাষ্টার কী বাগিয়েছে। এমনকি এক ছেলে বন্ধুকে ধরে ছোট খাট তালা খোলাও শিখে নিয়েছে। আজ বোঝা যাবে, দুই চুমু আর একটু হাত বোলানোর সুযোগের বিনিময়ে শেখা বিদ্যাটা কাজে দিবে কিনা।
আধা ঘন্টার মত অপেক্ষা করে রাইসা উঠল। জানে, দোতালা আর তিনতালায় কোন কর্মচারীর আসার অনুমতি নেই বলে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। চিলেকোঠায় গিয়ে দরজা খুলে ফেলল। চুপি চুপি ঢুকল হিমেলের ঘরে। উত্তেজিত বলে ভ্যাপসা গন্ধটা টের পেল না, শীতল পরিবেশটাও না। উত্তেজনায় তখন ওর পাগল প্রায় অবস্থা।
হিমেল বেশ গোছানো লোক। বিছানা পরিপাটি করে রাখা। ঘর পরিষ্কার। কাপড় গুলো সুন্দর করে আলনায় গুছিয়ে রাখা। বিছানায় বসল সে, চাদরে হিমেলের গন্ধ পাচ্ছে ও। নিজেকে সামলাতে পারল না, হিমেলের গন্ধ যেন ওকে জাদু করে ফেলেছে। বালিশে গিয়ে আদুরে বিড়ালের মত মুখ ঘসল বার বার। হিতাহিত জ্ঞান যেন হারিয়ে ফেলেছে।
কতক্ষণ পর জানে না, সম্বিত ফিরল রাইসার। মনে পড়ল, হিমেলকে কেন বাইরে পাঠিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে হাত দিয়েই যতটুকু সম্ভব, বিছানার চাদর ঠিক করে নিল। এরপর নজর দিল হিমেলের ট্রাংকের দিকে।
কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করার পর খুট করে ট্রাংকের তালা খুলে গেল। ‘খুব একটা লস হয়নি,’ ভাবল রাইসা। তালা খোলার বিদ্যা শেখার গুরুদক্ষিণার কথা মনে পড়ল ওর। নিজেকে সামলে নিয়ে নজর দিল ট্রাংকের দিকে।
কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট গুছিয়ে রাখা। এর নীচেই দেখল একটা ছবি। মনে হল বছর পাঁচেক আগের ছবি। হিমেল স্মার্টলি একটা কলেজের গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছবিটি দেখে সেই চেনা চেনা অনুভূতিটি আরেকবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল রাইসার মনে। কিন্তু কোথায় দেখেছে বুঝতে পারল না।
তন্ময় হয়ে ছবি দেখছে আর ভাবছে-ওকে আমার চাই, যেভাবেই হোক ওকে আমার লাগবে। কিভাবে হিমেলকে পটানো যায় ভাবছে, এমন সময় পিছনে খট করে একটা আওয়াজ হল। রাইসা ফিরে থাকিয়ে হিমেলকে দেখে যেন জমে গেল। হাতে পিজ্জার প্যাকেট নিয়ে হিমেল দাঁড়িয়ে আছে। মুখে সেই ক্রুর হাসি।
এভাবে ধরা পড়ে যাবে, বুঝতে পারেনি রাইসা। মুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল ওর সুন্দর গাল দুটো। দৌড়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল সে। দরজা দিয়ে বেরোবার সময় ওর হাত ধরল হিমেল, ‘রাইসা-।’
টাল সামলাতে না পেরে হিমেলের বুকের উপর গিয়ে পড়ল রাইসা। হিমেলও সামলাতে পারল না। রাইসাকে বুকে নিয়ে পড়ে গেল ও। মুহূর্তের জন্য কাছাকাছি হল ওদের ঠোঁট দুটো।
কয়েক মুহূর্তের জন্য একে অন্যের চোখে তাকিয়ে রইল ওরা দুজনে। হিমেল রাইসার তরুণী নরম দেহটাকে একটু শক্ত করে চেপে ধরল নিজের সাথে। রাইসাও নিজেকে সামলাতে না পেরে টুক করে চুমু গেল হিমেলকে। রক্তে আফ্রোদিতের চীৎকার, নেশায় ঘোরলাগা চোখের দৃষ্টি। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করছে রাইসার। তাই হিমেল যখন ওষূধ হিসেবে এগিয়ে গেল, রাইসা কোন বাঁধাই দিল না।
পরবর্তি দুই মাস কেটে গেল নতুন এক ঘোরে। বাচ্চারা যেভাবে নতুন কোন খেলনা পেলে সেটাকে নিয়ে মেতে থাকে, রাইসা আরর হিমেলও একে অন্যকে পেয়ে সব কিছু ভুলে বসল। বডিগার্ড, সবসময় বডির সাথেই থাকে। তাই আদিম খেলা খেলতে কোন অসুবিধাই হল না। রাইসা ওর বাবাকে বলে, ওর গাড়ীর ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি নিজেই এখন থেকে গাড়ী চালাব, আর সমস্যা হলে হিমেল সাহেব ত আছেই।’ আদুরে মেয়েকে মি. রহমান মানা করতে পারলেন না। রাজী হয়ে গেলেন।
ব্যাস, ওদেরকে আর পায় কে? মি. আর মিসেস রহমান বাসায় না থাকলেতো কথাই নেই। আর থাকলেও টিউশনির নাম করে বেরিয়ে পড়ত দুজনে। হিমেলের পরিচিত কোন হোটেল গিয়ে উঠত। মেতে উঠত নিজেদেরকে নিয়ে।
একদিন বিকালে উদ্দাম মিলনের পরের ঘটনা। হোটেলের কামরা হিমেলের বুকে মুখ গুজে রাইসা চিন্তিত সুরে বলল, ‘ জান ডার্লিং, দিন দিন কেমন জানি লাগছে।’
হিমেল ধড়ফড় করে উঠে বলল, ‘কি.. কি... হয়েছে? বাচ্চা-কাচ্চা কিছু?’
‘আরে না সেসব কিছু না। আমাকে কি বোকা পেয়েছে? প্রথম থেকেই পিল খাচ্ছি।’
‘তাহলে?’
‘আজকাল মাথাটা খুব ব্যাথা করে। খুব দুর্বল লাগে নিজেকে। অল্প একটু পরিশ্রম করলেই বুক ধড়ফড় করে উঠে। কানেও কেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ পাই।’
হিমেল তার ক্রুর হাসি হেসে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ তেমনটাই ত চাই।’
হিমেলের এই হাসিটাকে রাইসা ভয় পায়, অপার্থিব ভয়। আজকেও ব্যতিক্রম হল না। চমকে উঠে বলল, ‘কি বললে?’
হিমেল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘এমনটা ত চাই না। আমার জন্য আমার জানের কোন অসুবিধা হোক, এমনটা আমি চাই না। আজকেই ডাক্তার দেখাবে চল।’
হিমেলের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই রাইসা ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য হয়। ডাক্তার দুই একটা পরীক্ষা করে ওকে বললেন, ‘আপনার সমস্যা হচ্ছে রক্ত শূন্যতা। এই ওষুধ কটি খান। আশা করি ঠিক হয়ে যাবেন।’ হিমেলকে দেখে মনে হচ্ছিল, বুক থেকে যেন পাষানভার নেমে যাচ্ছে।
আফসোস, সুখের দিন চিরস্থায়ী হয় না। হিমেলের দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়েই হোক, বা সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীর জেলে যাবার কারণেই হোক-মি. রহমান হিমেলকে রাইসার বডিগার্ড থেকে নিজের বডিগার্ড বানালেন। মি. রহমান বেশীরভাগ সময় বাড়ীর বাইরেই থাকেন। আর হিমেলকে সবসময় বাড়ীতে রাখার প্রয়োজনও মি. রহমানের নেই। রাইসা এখন একমাত্র ছুটির দিন বাদে হিমেলের দেখা পায় না। এদিকে দিন দিন আরও শুকিয়ে যাচ্ছে সে। বায়ান্ন কেজি থেকে ওজন হারিয়ে দুই মাসেই পয়তাল্লিশ কেজি হয়ে গিয়েছে।
হিমেল আবার ডাক্তার দেখাবার কথা বলতেই রাইসা বলল, ‘আর ডাক্তার দেখাতে হবে না। দুশ্চিন্তায় এমন হচ্ছে। তোমার থেকে দূরে থাকতে আমার কষ্ট হয়।’ হিমেলের অক্ষম দীর্ঘশ্বাস রাইসার কষ্টকে যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
পরবর্তি তিনমাস ছিল দুই জনের জন্যই বীভিষিকাময়। মি. রহমান বিজনেস ট্রিপে সিংগাপুরে গেলেন। সাথে নিয়ে গেলেন হিমেলকে। তিনমাস হিমেলকে কাছে না পেয়ে রাইসা বুঝতে পারল, হিমেলকে ও কতটা ভালবেসে ফেলেছে। ছেলেদের সাথে শারিরীক মেলামেশা আগেও করেছে, কিন্তু হিমেল! হিমেল যেন ওর আত্মার সাথি। হিমেলকে না পেলে, সে অপূর্ণ।
হিমেল ফিরে এলে, রাইসা ছুটে গেল ওর কাছে। হিমেলের আলিঙ্গনের মাঝে যেন গলে গেল রাইসা। আবারও বুঝতে পারল, হিমেলকে ছাড়া ওর চলবে না। হিমেলের বুকে মুখ খুঁজে আদুরে বিড়ালের মত বলল, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাচব না। আমার পরিবার তোমাকে মেনে নেবে না। চল পালিয়ে যাই।’ দয়িতের বুকে মাথা খুঁজে নির্ভরতা খুজল রাইসা। ভাগ্য ভাল মুখ গুঁজে ছিল। না হয়, হিমেলের ক্রুর অপার্থিব হাসি রাইসা সহ্য করতে পারত না।
‘বিশ্বাস কর আমাকে? ভালবাস?’ হিমেল জিজ্ঞাসা করল।
‘নিজের চেয়েও বেশী বিশ্বাস করি। ভালবাসি জীবনের চেয়েও বেশী।’
‘তাহলে চল, আজরাতেই পালিয়ে যাই। আমার বাড়ী বরিশাল। আজ রাতে লঞ্চে উঠলে আগামীকাল সন্ধ্যার মাঝে বাড়ী পৌছে যাব। আমার পরিবারে কেউ নেই। ভিটেবাড়ী তালাই দেয়া আছে। কোন সমস্যা হবে না। সব ঠিক থাকলে পরশু থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী।
রাইসা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুখ লুকাল হিমেলের পুরুষালী বুকে।
সেইদিন সন্ধ্যাতেই দুই জন পারাবত-৭ লঞ্চে করে বরিশালের দিকে রওনা দিল। বরিশাল সদর থেকে হিমেলের গ্রামের বাড়ী যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। অন্ধকার নামল চারিদিকে। গ্রাম যেমন হয়, রাত আটটা না বাজতেই চারিদিক নিশ্চুপ, হিমেলের ভিটাটা যেন আরও চুপচাপ। রাইসার গ্রামে থাকার অভ্যাস নেই, নাহয় সেও বুঝত কোথাও কোন সমস্যা আছে। হিমেলের বাড়ীর চারিদিকে কোন ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ নেই। নিঝুম এক পুরি। এসিতে অভ্যস্ত রাইসা বুঝতেও পারল না, হিমেলের বাড়ী স্বাভাবিকের চেয়েও বেশী ঠান্ডা। অন্ধকারটাও যেন এখানে একটু বেশী ঘুটঘুটে, যেন আলোও ভিতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। নতুন জীবনের খুশিতে উত্তাল রাইসা এসব কিছুই টের পেল না।
নলকূপে হাত মুখ ধুয়ে, নাকে মুখে দুটো গুঁজে নিল ওরা। মোমের আলোয় এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মোমের আলোয় রাইসার মনে হল, হিমেল যেন এ জগতের কেউ না। কেন জানে না, শিরদাঁড়া বেয়ে অন্যরকম অনুভুতির এক স্রোত বয়ে গেল।
‘চল, তোমাকে আমার ভিটে দেখিয়ে আনি।’ রাইসার খুব ক্লান্ত লাগলেও হিমেলের গলায় এমন কিছু একটা ছিল যে সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। অনেকটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হিমেল রাইসাকে। যেন গোপন কিছু একটা দেখাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। বাড়ীর পিছনে নিয়ে গেল রাইসাকে। নিশ্চুপ হয়ে চারটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে রইল দুইজন।
‘কা... কার কবর এগুলো?’ রাইসা জিজ্ঞাসা করল।
‘ডান দিক থেকে প্রথমটা আমার বাবার, পরেরটা আমার মায়ের আর এরপরেরটা আমার ছোট বোনের।’ চুপ করল হিমেল।
‘আর..আর.. একদম শেষেরটা?’ রাইসা মাথা নীচু করে জিজ্ঞাসা করল, অন্তরাত্মা জানান দিচ্ছে-কোথাও কোন গোলমাল আছে।
হিমেলের কোন জবাব না পেয়ে রাইসা মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল। বড়বড় হয়ে গেল ওর। চোখের সামনে হিমেলের পরিবর্তন দেখতে পেল রাইসা। হটাৎ করেই যেন হিমেলের বয়স দশ বছর করে গিয়েছে। চুলের রূপালীভাবটা আর নেই। ভরাট গাল একটু ডেবে গিয়েছে, পাথরের মত শক্ত দেহটা যেন একটু আবছা আবছা লাগছে। আচমকা যেন রাইসার মাথায় বাজ পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘তু. তু. তুমি?’
রাইসা হিমেলকে চিনতে পারল। আজ থেকে পাচ বছর আগের কথা। তখন মি. রহমান এত বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না। গাড়ী ছিল মাত্র একটি। সাধারণত সেই গাড়ীতে করেই রাইসা স্কুলে যাওয়া আসা করত।
সেই দিন মি. রহমান গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বাসে চরতে অনভ্যস্ত রাইসাকে সেদিন বাসেই ফিরতে হয়েছিল বাসায়। নামার সময় ড্রাইভার হঠাৎ করে ব্রেক করায় সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। এখন বুঝতে পারে যে, সেদিন ওকে বাঁচাবার জন্যই পিছন থেকে একজন জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু অনভ্যস্ত রাইসা বুকে অন্য পুরুষের হাত টের পেয়ে চীৎকার করে ওঠে। আসে পাশের সবাই এগিয়ে এলে ক্রন্দনরত রাইসা খালি এতটুকুই বলতে পারে, ‘আমার.. আমার বুকে..’ উন্মত্ত জনতা সেদিন পিটিয়েই মেরে ফেলে সেই লোকটিকে। কথা বলার কোন সুযোগই সে পায় নি। পরেরদিন পত্রিকায় বেশ করেই ছাপা হয় ঘটনাটা। সেখানেই ত্রিশ বছর বয়সী হিমেলের ছবি প্রথম দেখে রাইসা।
তাহলে.. তাহলে.. শেষ কবরটা কি-’ কথা শেষ করতে পারে না রাইসা।
‘হ্যা, শেষ কবরটা আমারই। বাবা আমি ছোট থাকতেই মারা জান। ছোট বোন আর মাকে আমিই দেখে রাখতাম। ছোট একটা চাকরী করতাম আমি। সেদিন তোমাকে বাঁচাবার জন্যই জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্তু তোমার জন্যই আজ আমি মৃত। আমার মৃত্যুর পর চারপাশের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে আমার বোন আত্মহত্যা করে। ছেলে-মেয়ে হারিয়ে আমার মাও বেশী দিন বাঁচেন নি। আমার পুরো পরিবারের মৃত্যুর কারণ তুমিই।’
‘কিন্তু আমি ত তখন ছোট, বুঝে উঠতে পারি নি।’ রাইসা কম্পিত কন্ঠে জবাব দেয়।
‘আমি মাফ করে দিতাম। কিন্তু যখন দেখলাম বড় হয়ে তুমি আস্তে আস্তে উচ্ছন্নে যাচ্ছ, তখন বুঝলাম-যদি আমার বোন তোমার জন্য মারা যায়, আমার মা তোমার জন্য মারা যায়, তাহলে তোমারও বেচে থাকার কোন অধিকার নেই।’
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রাইসা হিমেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এক পা এগিয়ে এসে ফুঁ দিয়ে মোম নিভিয়ে দিল হিমেল।
অন্ধকার গ্রাস করল ওদের দুজনকে।
রাইসাকে এরপরে আর কেউ কখনো দেখেনি।
সমস্যার বয়স অল্প, কেন হচ্ছে তাও রাইসা জানে। ওর বাবার নতুন বডিগার্ড হিমেল-ওর সমস্যার কারণ। ওর বাবা নামকরা ব্যবসায়ী। সব যে এক নম্বরী, তা কিন্তু নয়। আর তাই, বডিগার্ডের প্রয়োজন। সেই বডিগার্ডের উপর আবার ওর বাবা ভরসা খুব কম। কিছুদিন পরপরই তিনি পরিবর্তন করেন। হিমেলের চাকরীর বয়সও অল্প। আসল বয়স কিন্তু অল্প না। প্রায় ৪৫ হবে। চাকরী প্রথমে মি. রহমানের বডিগার্ড হিসেবে হলেও, পরিস্থিতির কারণে এখন হিমেল রাইসার বডিগার্ড। কারণ আর কিছুই নয়, মি. রহমানের বিজনেস প্রতিপক্ষের হুমকী। ব্যবসায়ী বাবা আর সমাজসেবক মায়ের একমাত্র সন্তান রাইসার নিরাপত্তার জন্য ওর বাবা কোন কিছু করতেই দ্বিধা করেন না।
আর তাই হিমেল গত একমাস হল রাইসার নিত্য সংগী। কলেজে যাওয়া আসা, স্যারদের কাছে পরতে যাওয়া-সবকিছুতেই হিমেল এখন রাইসার নিত্যসংগী। রাইসা গল্পের বইতে পরেছিল, কলেজে উঠলে মেয়েরা উলটা পালটা কাজ করে, মন উড়ু উড়ু থাকে। তাই বলে চাচার বয়সী এক লোকের প্রেমে পরে যাবে? এমনটা কোনদিন কল্পনাও করে নি।
হিমেলের প্রতি আকর্ষণটা যেমন মানসিক, তেমনি শারিরীক। রাইসা নারী পুরুষের দৌহিক ব্যাপারে অনভিজ্ঞ নয়। কলেজে পড়লেও, কুমারীত্ব হারিয়েছে আগেই। কিন্তু যাকে চাচা বল ডাকার কথা, এমন একজনের প্রতি দৈহিক আকর্ষণ অনুভব করবে, এমনটা রাইসা কোনদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি।
অনেকবার চেষ্টা করেছে, সম্পর্কটাকে নিয়ে না ভাববার। খারাপ ব্যবহার করেছে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু নিজেকেই যদি সামলাতে না পারে, তাহলে এসব করে কি লাভ? অনেক চেষ্টা করেও হিমেলকে চাচা বলে ডাকতে পারে নি, শুধু হিমেলটুকুই মুখ দিয়ে বের হয়। চেষ্টা করে যেন ডাকটা মালিকের মেয়ের কর্মচারীকে তাচ্ছিল্য করে ডাকার মত শোনায়। হিমেলও হয়ত তেমনটাই ভাবে। কিন্তু আর কেউ না জানলেও, রাইসা ত নিজের মনের খবর জানে।
হিমেল থাকে ওদের তিনতলা বাড়ীর চিলেকোঠায়। আগে ছাদ নিয়ে রাইসার তেমন মাথাব্যথা না থাকলেও, এখন প্রায়ই ওকে ছাদে দেখা যায়। কলেজ থেকে একে গোসল করেই চলে যায় ছাদে, আবার বিকালে টিউশনির পরও ছাদে চলে যায়। হিমেলকে ওর মনে হয় পৌরুষ্যের এক অনুপম নিদর্শন। ওর কপালের দুই পাশের রুপালী আভা, পাথর কুদে বের করা ছয় ফুট লম্বা শরীর, রশি মত পাকান পেশী আর একটু রুক্ষ চেহারা-উফ, রাইসাকে পাগল করে দেয়। বিশেষ করে ওর চেহারাটা, দেখলেই মনে হয় রাইসার চেনা, পরিচির। হালকা রুক্ষ ভাবটা হিমেলের পৌরুষকে যেন শত গুণে। শুধু একটা দিক রাইসার মনে ভয় জাগায়। তা হল হিমেলের হাসি-ক্রুর হাসিটা দেখলে রাইসার বুকে কাঁপন দেয়, মনে হয় ভয়ের কিছু একটা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের সম্পর্কে খুব একটা তথ্য হিমেল দেয় না। তাই রাইসার চোখে ও রহস্যপুরুষ।
রাইসা নিজেও কিন্তু কম সুন্দরী নয়। পাচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ দুধে আলতা। বয়সে একটু ছোট হলেও, শারিরীক গঠন যুবতীদের ন্যায়। ভরাট গাল, সুউচ্চ বুক আর কমলার কোয়ার মত ঠোট। ঠিক উদ্দাম জীবন যাপন না করলেও, ঠিক নৈতিক জীবনও ত যাপন করে না রাইসা। তাই হয়ত তরুণী দেহে যৌবনের বান ঢেকেছে-কে বলতে পারে।
হয়ত এভাবেই আরও সময় কেটে যেত, কিন্তু এক বিকালের ঘটনায় সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। সেদিন রাইসার কলেজ ছুটি। মি. রহমান রাত করে বাসায় ফিরেন। মিসেস রহমানের প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাওয়াত থাকে। তিনিও একটু রাত করেই বাড়ী ফিরেন। রাইসা বাসায় একাই থাকে। ওহ, একা বলা ত ভুল হল। হিমেলও সাথে থাকে।
রাইসা বাসায় থাকলে সাধারণত হিমেলকে ছুটি দিয়ে দেয়। তক্কেতক্কে থাকে, হিমেল বাইরে গেলেই ওর ঘরে ঢোকার। রহস্যময় স্বপ্ন পুরুষ সম্পর্কে ওর জানতেই হবে। কিন্তু বিধি বাম, হিমেলের সব আগ্রহ যেন রাইসা আর ওর বাবার নিরাপত্তাকে ঘিরেই। ছুটি পেলেও বাড়ীর বাইরে বের হয় না। ‘আজকে ওকে বাইরে পাঠাতেই হবে।’ নিজেকেই নিজে বলে রাইসা।
যেই ভাবা সেই কাজ, বিকাল হতেই রাইসা হিমেলকে ডেকে পাঠায়। বলে, ‘হিমেল, আজকে স্যারের কাছে যাব না। এক কাজ কর বসুন্ধরায় নতুন ডমিনোস খুলেছে। আমার জন্য একটা পেপারোনী পিজ্জা নিয়ে এস।’
হিমেলকে একটু অবাক মনে হল, কেননা ও জানে যে ডমিনোসের নিজস্ব ডেলেভারি সার্ভিস আছে। কিন্তু বড়লোকের খেয়াল মনে করে কিছু এব্যাপারে চুপ রইল। একটু পর বলল, ‘উত্তরা থেকে বসুন্ধরায় যেতে আসতে একটু সময় লাগতে পারে। ঢাকার রাস্তার জ্যাম, কোন ঠিক ঠিকানা নেই।’
‘চাই তো সেটাই।’ মনে মনে বলল রাইসা। মুখে বলল, ‘অসুবিধা নাই। ধীরে সুস্থেই আন।’ এই সুযোগে আমিও একটু গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে নেই-ভাবল রাইসা।
হিমেল বেরিয়ে গেলে রাইসা দৌড়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হিমেলের দরজা লক করার আওয়াজ কানে যেতেই ফিরে এসে বসে পড়ল পড়ার টেবিলে। ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় কাঁপছে। আজকের এই সুযোগটার জন্যই অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছে সে। মাষ্টার কী বাগিয়েছে। এমনকি এক ছেলে বন্ধুকে ধরে ছোট খাট তালা খোলাও শিখে নিয়েছে। আজ বোঝা যাবে, দুই চুমু আর একটু হাত বোলানোর সুযোগের বিনিময়ে শেখা বিদ্যাটা কাজে দিবে কিনা।
আধা ঘন্টার মত অপেক্ষা করে রাইসা উঠল। জানে, দোতালা আর তিনতালায় কোন কর্মচারীর আসার অনুমতি নেই বলে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। চিলেকোঠায় গিয়ে দরজা খুলে ফেলল। চুপি চুপি ঢুকল হিমেলের ঘরে। উত্তেজিত বলে ভ্যাপসা গন্ধটা টের পেল না, শীতল পরিবেশটাও না। উত্তেজনায় তখন ওর পাগল প্রায় অবস্থা।
হিমেল বেশ গোছানো লোক। বিছানা পরিপাটি করে রাখা। ঘর পরিষ্কার। কাপড় গুলো সুন্দর করে আলনায় গুছিয়ে রাখা। বিছানায় বসল সে, চাদরে হিমেলের গন্ধ পাচ্ছে ও। নিজেকে সামলাতে পারল না, হিমেলের গন্ধ যেন ওকে জাদু করে ফেলেছে। বালিশে গিয়ে আদুরে বিড়ালের মত মুখ ঘসল বার বার। হিতাহিত জ্ঞান যেন হারিয়ে ফেলেছে।
কতক্ষণ পর জানে না, সম্বিত ফিরল রাইসার। মনে পড়ল, হিমেলকে কেন বাইরে পাঠিয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠে হাত দিয়েই যতটুকু সম্ভব, বিছানার চাদর ঠিক করে নিল। এরপর নজর দিল হিমেলের ট্রাংকের দিকে।
কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করার পর খুট করে ট্রাংকের তালা খুলে গেল। ‘খুব একটা লস হয়নি,’ ভাবল রাইসা। তালা খোলার বিদ্যা শেখার গুরুদক্ষিণার কথা মনে পড়ল ওর। নিজেকে সামলে নিয়ে নজর দিল ট্রাংকের দিকে।
কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট গুছিয়ে রাখা। এর নীচেই দেখল একটা ছবি। মনে হল বছর পাঁচেক আগের ছবি। হিমেল স্মার্টলি একটা কলেজের গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছবিটি দেখে সেই চেনা চেনা অনুভূতিটি আরেকবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল রাইসার মনে। কিন্তু কোথায় দেখেছে বুঝতে পারল না।
তন্ময় হয়ে ছবি দেখছে আর ভাবছে-ওকে আমার চাই, যেভাবেই হোক ওকে আমার লাগবে। কিভাবে হিমেলকে পটানো যায় ভাবছে, এমন সময় পিছনে খট করে একটা আওয়াজ হল। রাইসা ফিরে থাকিয়ে হিমেলকে দেখে যেন জমে গেল। হাতে পিজ্জার প্যাকেট নিয়ে হিমেল দাঁড়িয়ে আছে। মুখে সেই ক্রুর হাসি।
এভাবে ধরা পড়ে যাবে, বুঝতে পারেনি রাইসা। মুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল ওর সুন্দর গাল দুটো। দৌড়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করল সে। দরজা দিয়ে বেরোবার সময় ওর হাত ধরল হিমেল, ‘রাইসা-।’
টাল সামলাতে না পেরে হিমেলের বুকের উপর গিয়ে পড়ল রাইসা। হিমেলও সামলাতে পারল না। রাইসাকে বুকে নিয়ে পড়ে গেল ও। মুহূর্তের জন্য কাছাকাছি হল ওদের ঠোঁট দুটো।
কয়েক মুহূর্তের জন্য একে অন্যের চোখে তাকিয়ে রইল ওরা দুজনে। হিমেল রাইসার তরুণী নরম দেহটাকে একটু শক্ত করে চেপে ধরল নিজের সাথে। রাইসাও নিজেকে সামলাতে না পেরে টুক করে চুমু গেল হিমেলকে। রক্তে আফ্রোদিতের চীৎকার, নেশায় ঘোরলাগা চোখের দৃষ্টি। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা করছে রাইসার। তাই হিমেল যখন ওষূধ হিসেবে এগিয়ে গেল, রাইসা কোন বাঁধাই দিল না।
পরবর্তি দুই মাস কেটে গেল নতুন এক ঘোরে। বাচ্চারা যেভাবে নতুন কোন খেলনা পেলে সেটাকে নিয়ে মেতে থাকে, রাইসা আরর হিমেলও একে অন্যকে পেয়ে সব কিছু ভুলে বসল। বডিগার্ড, সবসময় বডির সাথেই থাকে। তাই আদিম খেলা খেলতে কোন অসুবিধাই হল না। রাইসা ওর বাবাকে বলে, ওর গাড়ীর ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি নিজেই এখন থেকে গাড়ী চালাব, আর সমস্যা হলে হিমেল সাহেব ত আছেই।’ আদুরে মেয়েকে মি. রহমান মানা করতে পারলেন না। রাজী হয়ে গেলেন।
ব্যাস, ওদেরকে আর পায় কে? মি. আর মিসেস রহমান বাসায় না থাকলেতো কথাই নেই। আর থাকলেও টিউশনির নাম করে বেরিয়ে পড়ত দুজনে। হিমেলের পরিচিত কোন হোটেল গিয়ে উঠত। মেতে উঠত নিজেদেরকে নিয়ে।
একদিন বিকালে উদ্দাম মিলনের পরের ঘটনা। হোটেলের কামরা হিমেলের বুকে মুখ গুজে রাইসা চিন্তিত সুরে বলল, ‘ জান ডার্লিং, দিন দিন কেমন জানি লাগছে।’
হিমেল ধড়ফড় করে উঠে বলল, ‘কি.. কি... হয়েছে? বাচ্চা-কাচ্চা কিছু?’
‘আরে না সেসব কিছু না। আমাকে কি বোকা পেয়েছে? প্রথম থেকেই পিল খাচ্ছি।’
‘তাহলে?’
‘আজকাল মাথাটা খুব ব্যাথা করে। খুব দুর্বল লাগে নিজেকে। অল্প একটু পরিশ্রম করলেই বুক ধড়ফড় করে উঠে। কানেও কেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ পাই।’
হিমেল তার ক্রুর হাসি হেসে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ তেমনটাই ত চাই।’
হিমেলের এই হাসিটাকে রাইসা ভয় পায়, অপার্থিব ভয়। আজকেও ব্যতিক্রম হল না। চমকে উঠে বলল, ‘কি বললে?’
হিমেল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘এমনটা ত চাই না। আমার জন্য আমার জানের কোন অসুবিধা হোক, এমনটা আমি চাই না। আজকেই ডাক্তার দেখাবে চল।’
হিমেলের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই রাইসা ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য হয়। ডাক্তার দুই একটা পরীক্ষা করে ওকে বললেন, ‘আপনার সমস্যা হচ্ছে রক্ত শূন্যতা। এই ওষুধ কটি খান। আশা করি ঠিক হয়ে যাবেন।’ হিমেলকে দেখে মনে হচ্ছিল, বুক থেকে যেন পাষানভার নেমে যাচ্ছে।
আফসোস, সুখের দিন চিরস্থায়ী হয় না। হিমেলের দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়েই হোক, বা সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীর জেলে যাবার কারণেই হোক-মি. রহমান হিমেলকে রাইসার বডিগার্ড থেকে নিজের বডিগার্ড বানালেন। মি. রহমান বেশীরভাগ সময় বাড়ীর বাইরেই থাকেন। আর হিমেলকে সবসময় বাড়ীতে রাখার প্রয়োজনও মি. রহমানের নেই। রাইসা এখন একমাত্র ছুটির দিন বাদে হিমেলের দেখা পায় না। এদিকে দিন দিন আরও শুকিয়ে যাচ্ছে সে। বায়ান্ন কেজি থেকে ওজন হারিয়ে দুই মাসেই পয়তাল্লিশ কেজি হয়ে গিয়েছে।
হিমেল আবার ডাক্তার দেখাবার কথা বলতেই রাইসা বলল, ‘আর ডাক্তার দেখাতে হবে না। দুশ্চিন্তায় এমন হচ্ছে। তোমার থেকে দূরে থাকতে আমার কষ্ট হয়।’ হিমেলের অক্ষম দীর্ঘশ্বাস রাইসার কষ্টকে যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
পরবর্তি তিনমাস ছিল দুই জনের জন্যই বীভিষিকাময়। মি. রহমান বিজনেস ট্রিপে সিংগাপুরে গেলেন। সাথে নিয়ে গেলেন হিমেলকে। তিনমাস হিমেলকে কাছে না পেয়ে রাইসা বুঝতে পারল, হিমেলকে ও কতটা ভালবেসে ফেলেছে। ছেলেদের সাথে শারিরীক মেলামেশা আগেও করেছে, কিন্তু হিমেল! হিমেল যেন ওর আত্মার সাথি। হিমেলকে না পেলে, সে অপূর্ণ।
হিমেল ফিরে এলে, রাইসা ছুটে গেল ওর কাছে। হিমেলের আলিঙ্গনের মাঝে যেন গলে গেল রাইসা। আবারও বুঝতে পারল, হিমেলকে ছাড়া ওর চলবে না। হিমেলের বুকে মুখ খুঁজে আদুরে বিড়ালের মত বলল, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাচব না। আমার পরিবার তোমাকে মেনে নেবে না। চল পালিয়ে যাই।’ দয়িতের বুকে মাথা খুঁজে নির্ভরতা খুজল রাইসা। ভাগ্য ভাল মুখ গুঁজে ছিল। না হয়, হিমেলের ক্রুর অপার্থিব হাসি রাইসা সহ্য করতে পারত না।
‘বিশ্বাস কর আমাকে? ভালবাস?’ হিমেল জিজ্ঞাসা করল।
‘নিজের চেয়েও বেশী বিশ্বাস করি। ভালবাসি জীবনের চেয়েও বেশী।’
‘তাহলে চল, আজরাতেই পালিয়ে যাই। আমার বাড়ী বরিশাল। আজ রাতে লঞ্চে উঠলে আগামীকাল সন্ধ্যার মাঝে বাড়ী পৌছে যাব। আমার পরিবারে কেউ নেই। ভিটেবাড়ী তালাই দেয়া আছে। কোন সমস্যা হবে না। সব ঠিক থাকলে পরশু থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী।
রাইসা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুখ লুকাল হিমেলের পুরুষালী বুকে।
সেইদিন সন্ধ্যাতেই দুই জন পারাবত-৭ লঞ্চে করে বরিশালের দিকে রওনা দিল। বরিশাল সদর থেকে হিমেলের গ্রামের বাড়ী যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। অন্ধকার নামল চারিদিকে। গ্রাম যেমন হয়, রাত আটটা না বাজতেই চারিদিক নিশ্চুপ, হিমেলের ভিটাটা যেন আরও চুপচাপ। রাইসার গ্রামে থাকার অভ্যাস নেই, নাহয় সেও বুঝত কোথাও কোন সমস্যা আছে। হিমেলের বাড়ীর চারিদিকে কোন ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ নেই। নিঝুম এক পুরি। এসিতে অভ্যস্ত রাইসা বুঝতেও পারল না, হিমেলের বাড়ী স্বাভাবিকের চেয়েও বেশী ঠান্ডা। অন্ধকারটাও যেন এখানে একটু বেশী ঘুটঘুটে, যেন আলোও ভিতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। নতুন জীবনের খুশিতে উত্তাল রাইসা এসব কিছুই টের পেল না।
নলকূপে হাত মুখ ধুয়ে, নাকে মুখে দুটো গুঁজে নিল ওরা। মোমের আলোয় এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মোমের আলোয় রাইসার মনে হল, হিমেল যেন এ জগতের কেউ না। কেন জানে না, শিরদাঁড়া বেয়ে অন্যরকম অনুভুতির এক স্রোত বয়ে গেল।
‘চল, তোমাকে আমার ভিটে দেখিয়ে আনি।’ রাইসার খুব ক্লান্ত লাগলেও হিমেলের গলায় এমন কিছু একটা ছিল যে সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। অনেকটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল হিমেল রাইসাকে। যেন গোপন কিছু একটা দেখাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। বাড়ীর পিছনে নিয়ে গেল রাইসাকে। নিশ্চুপ হয়ে চারটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে রইল দুইজন।
‘কা... কার কবর এগুলো?’ রাইসা জিজ্ঞাসা করল।
‘ডান দিক থেকে প্রথমটা আমার বাবার, পরেরটা আমার মায়ের আর এরপরেরটা আমার ছোট বোনের।’ চুপ করল হিমেল।
‘আর..আর.. একদম শেষেরটা?’ রাইসা মাথা নীচু করে জিজ্ঞাসা করল, অন্তরাত্মা জানান দিচ্ছে-কোথাও কোন গোলমাল আছে।
হিমেলের কোন জবাব না পেয়ে রাইসা মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল। বড়বড় হয়ে গেল ওর। চোখের সামনে হিমেলের পরিবর্তন দেখতে পেল রাইসা। হটাৎ করেই যেন হিমেলের বয়স দশ বছর করে গিয়েছে। চুলের রূপালীভাবটা আর নেই। ভরাট গাল একটু ডেবে গিয়েছে, পাথরের মত শক্ত দেহটা যেন একটু আবছা আবছা লাগছে। আচমকা যেন রাইসার মাথায় বাজ পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘তু. তু. তুমি?’
রাইসা হিমেলকে চিনতে পারল। আজ থেকে পাচ বছর আগের কথা। তখন মি. রহমান এত বড় ব্যবসায়ী ছিলেন না। গাড়ী ছিল মাত্র একটি। সাধারণত সেই গাড়ীতে করেই রাইসা স্কুলে যাওয়া আসা করত।
সেই দিন মি. রহমান গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বাসে চরতে অনভ্যস্ত রাইসাকে সেদিন বাসেই ফিরতে হয়েছিল বাসায়। নামার সময় ড্রাইভার হঠাৎ করে ব্রেক করায় সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। এখন বুঝতে পারে যে, সেদিন ওকে বাঁচাবার জন্যই পিছন থেকে একজন জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু অনভ্যস্ত রাইসা বুকে অন্য পুরুষের হাত টের পেয়ে চীৎকার করে ওঠে। আসে পাশের সবাই এগিয়ে এলে ক্রন্দনরত রাইসা খালি এতটুকুই বলতে পারে, ‘আমার.. আমার বুকে..’ উন্মত্ত জনতা সেদিন পিটিয়েই মেরে ফেলে সেই লোকটিকে। কথা বলার কোন সুযোগই সে পায় নি। পরেরদিন পত্রিকায় বেশ করেই ছাপা হয় ঘটনাটা। সেখানেই ত্রিশ বছর বয়সী হিমেলের ছবি প্রথম দেখে রাইসা।
তাহলে.. তাহলে.. শেষ কবরটা কি-’ কথা শেষ করতে পারে না রাইসা।
‘হ্যা, শেষ কবরটা আমারই। বাবা আমি ছোট থাকতেই মারা জান। ছোট বোন আর মাকে আমিই দেখে রাখতাম। ছোট একটা চাকরী করতাম আমি। সেদিন তোমাকে বাঁচাবার জন্যই জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্তু তোমার জন্যই আজ আমি মৃত। আমার মৃত্যুর পর চারপাশের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে আমার বোন আত্মহত্যা করে। ছেলে-মেয়ে হারিয়ে আমার মাও বেশী দিন বাঁচেন নি। আমার পুরো পরিবারের মৃত্যুর কারণ তুমিই।’
‘কিন্তু আমি ত তখন ছোট, বুঝে উঠতে পারি নি।’ রাইসা কম্পিত কন্ঠে জবাব দেয়।
‘আমি মাফ করে দিতাম। কিন্তু যখন দেখলাম বড় হয়ে তুমি আস্তে আস্তে উচ্ছন্নে যাচ্ছ, তখন বুঝলাম-যদি আমার বোন তোমার জন্য মারা যায়, আমার মা তোমার জন্য মারা যায়, তাহলে তোমারও বেচে থাকার কোন অধিকার নেই।’
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রাইসা হিমেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এক পা এগিয়ে এসে ফুঁ দিয়ে মোম নিভিয়ে দিল হিমেল।
অন্ধকার গ্রাস করল ওদের দুজনকে।
রাইসাকে এরপরে আর কেউ কখনো দেখেনি।