প্রজাতন্ত্রের খোঁজে
"প্রজাশূন্য যে রাষ্ট্রের কথা গল্পে বিধৃত হবে তার একটা ধারণা দেওয়া যেতে পারে। একদা অসংখ্য প্রজার যুক্তিতর্ক ও হইহুল্লোড়ে দেশটি মুখরিত ছিল। একদিন ভোরে সবাই আবিষ্কার করে প্রত্যেক প্রজার হাতে শোভা পাচ্ছে নিজেদের অস্তিত্বকে অদৃশ্যকরণের তাবিজ। প্রজাদের এভাবে আচমকা তাবিজের কবলে পড়ার ঘটনা আবিষ্কারের পর থেকে হারিয়ে যেতে থাকে পুরো একটা রাষ্ট্র। কেবল রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠী, যশঃপ্রার্থী কিছু প্রজাসেবক, বেওয়ারিশ কুকুর, জঙ্গলের জীবজন্তু ও পোকামাকড়ের নিঃসঙ্গ উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।"
'গান্ধর্ব গল্পগুচ্ছ'এর ৬৭ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত প্রথম প্যারা এটি। ফজলুল কবিরীর প্রায় আড়াই দশকের বহুমাত্রিক ঢঙে জীবনকে দেখার, স্পঞ্জের মতো কয়েক দশকের নানাবিধ ঘটনাবলীকে শুষে গল্পকথনে মত্ত হওয়ার অভিযান সচেতন পাঠক পাবেন এ গ্রন্থে।
বইটিতে গল্পের সংখ্যা ২৭। বিগত প্রায় দুই দশকের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে ডমিনো ইফেক্টের মত আমাদের আজকের বাংলাদেশ সাজিয়েছে সেসবের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উল্লেখ আছে গ্রন্থে। আছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, ঐতিহাসিক নানামুখি টানাপোড়েনের কথা। মানুষ নামক জটিল প্রাণীটির জটিলতর মনস্তাত্ত্বিক ঘূর্ণিকে বইয়ের মলাটে ধরার কঠিন প্রচেষ্টা তো আছেই।
বিভিন্ন এন্টারটেইনার, ইনফ্লুয়েন্সারদের লেখকযাত্রার ভিড়ে লেখক গল্পকথন করেছেন বাংলার মাটির, ঐতিহ্যের, ইতিহাসের, সেই সাথে কিছু প্রায় অমোচনীয় দুর্দশা ও দুর্ভাগ্যের। উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিংবা অ্যাম্বিশনকে প্রচলিত অর্থে এদেশে নেতিবাচকতার সুরে গাওয়া হয়। তবে ফজলুল কবিরীর লেখালেখি সেইসব সুরের ধার না ধেরে প্রথাবিরোধিতা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে নিজ সুরে রচনা করতে বেশ খানিকটা বদ্ধপরিকর বলা যায়।
লেখকের স্টোরিটেলিঙের বিবিধ শাখা-প্রশাখা ধরে কখনও গল্পে উঁকি দিয়ে গেছে তনু, কখনও বিশ্বজিৎ আবার কখনও অভিজিৎ। যেন বর্তমান কুয়াশা মোড়ানো বাস্তবতা, যেখানে দুরে দেখা দুষ্কর, আমাদের বেশিরভাগের মাঝেই সেই দুর দেখার ইচ্ছা অল্প, লেখকের জাদুবাস্তবতা এক চিলতে কিন্তু তীব্র রোদ হয়ে কিছুক্ষণের জন্যে সেই কুয়াশাকে ফালি ফালি করে দেয়ার সফল অথবা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে চলেছে।
কবিরীর জাদুবাস্তবতার থিম আমাদেরই রূঢ় বাস্তবতার অনেক অমীমাংসিত ঘটনার বিভিন্ন চরিত্রের অসহায় চিৎকার যেন। যে চিৎকার দরদের সাথে থামানোর সহায় হয়নি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা অথবা আমরা-ই।
গল্পবইটিতে লেখকের পরিশ্রম ও নিষ্ঠার চিহ্ন পাওয়া যায়। অল্প সময়ের জন্য সচেতন পাঠক অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারেন কোন গল্পের অন্যমনস্ক কোন চরিত্রের মতোই। মানুষের মনের ধূসর রঙের নানা সেডের সাথে অনেকটা কোল্ড ব্লাডেড ওয়েতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অভিজ্ঞ এ লেখক।
গান্ধর্ব গল্পগুচ্ছের গল্পগুলি অশ্লীল, আপত্তিকর, অস্বস্তির প্রকরণে ভর্তি। সৎভাবে চেয়ে দেখলে আমাদের জীবনের মতোই। সাহিত্য তো দিনশেষে বাস্তবতার-ই মিমেসিস।
বই রিভিউ
নাম : গান্ধর্ব গল্পগুচ্ছ
লেখক : ফজলুল কবিরী
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০২৫
প্রকাশক : দ্বিমত
প্রচ্ছদ : আল নোমান
প্রুফ ও বিন্যাস : ইরেজার
পরিবেশক : বাতিঘর। বুকস অব বেঙ্গল। রকমারি
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ।