ঢাকা আমাকে খুব বেশি হলে ৩ দিন পর্যন্ত সহ্য করে। এরপর রাস্তায় অসহনীয় জ্যামে আটকে রাখে, বাতাসে ভারী লেডের বিষ গিলতে বাধ্য করে বলতে থাকে, পালাও। ‘ইতাক তোকে মানাইছেনা রে, এক্কেবারে মানাইছেনা রে’। আমার হাঁসফাঁস শুরু হয়। সেই আমি এবার পাক্কা ৫ দিন ছিলাম ঢাকায়। অথচ একটা সময় ছিল ঢাকার বাইরে না যাবার বহুত চেষ্টা চালাইছি।
২০০৬ এর শেষের দিকে ঢাকার কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে ‘পার্বতীপুর ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ শুরু করি। ২০০৭-০৮ জুড়ে এলাকার অনেক মানুষের কাছে ছুটে যাই, যারা ঢাকায় বাস করতেন। সেই জনসংযোগ কালের অনেক রকম টক-ঝাল-মিষ্টি অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরপর রুটিরুজির ধান্দায় ঢাকা থেকে বাইরে চলে আসি। ওয়েলফেয়ারের সাথে সংযোগ কমে যায়। এবার ব্যাটে বলে মিলেছে। গত শুক্রবার গাজীপুর সদরের সাজেদা পার্কের পিকনিকে হাজির হই দুপুরের পর পর। অনেক দিন পর অনেক বন্ধু পরিচিত মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়। হৈ হুল্লোড়ে একটা বেলা কেটে যায়। সাজেদা পার্ক একটা দিনের জন্য মিনি পার্বতীপুর রূপ নেয়।
২।
রোববার ৩ দিন ব্যাপি ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিং এর বিষয় ArcGIS. উদ্দেশ্য? সরকারি ভূমি ডিজিটাইজেশন করা, বিশেষ করে নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের বেলায় এটা কার্যকর করা। Google Earth ব্যবহার করে আমরা যে ইমেজ দেখি, ভার্চুয়ালি পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে স্ট্রিট ভিউ করি, এর মূল হল GIS. এই ArcGIS হল সেরকম একটা সফটওয়্যার।
একটা সময় কলেরা ছিল প্রাণঘাতী রোগ। সকলের ধারণা ছিল, অভিশপ্ত বায়ু মানুষের পেটে ঢুকলে কলেরা রোগ হয়। ১৮৭০ সাল, লন্ডনে ডাক্তার John Snow খেয়াল করেন, বেশির ভাগ কলেরার রোগী আসছে Soho নামক জায়গা থেকে। পরে সার্ভেতে বের হয় Soho’র একটি পাম্পের পানির দূষণের কারণে এটা হচ্ছে। এই ঘটনার পর মানুষ জানতে পারে, কলেরা মূলত পানিবাহিত রোগ। কোন অভিশপ্ত বাতাস কলেরার কারণ নয়। ওসামা বিন লাদেনকে হ*ত্যা করার জন্য আমেরিকা মূলত GIS ভিত্তিক অত্যাধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে সম্ভাব্য দুইটা জায়গা চিহ্নিত করে। এর একটি আফগানিস্তানের পারাছিনার, অন্যটি পাকিস্তানের পেশওয়ার। কিন্তু শেষে তাঁকে পাওয়া যায় পাকিস্তানের এবোটাবাদে। শুধু প্রযুক্তি থাকলেই হবে না, তার সঠিক প্রয়োগের উপরে সফলতা নির্ভর করে। ArcGIS শেখানোর পাশাপাশি এরকম অনেক গল্প শুনি ট্রেইনারের বরাতে। ট্রেনিং বেশ উপভোগ্য ছিল, সময় বেশ ভালো কাটে।
৩।
একদিন ক্লাস শেষে মিরপুর-১০ যাই। মেট্রো ধরে বইমেলায় যাবো। দুইটা লম্বা লাইন। নিজে নিজে টিকেট কাটা যায় লাইনে দাঁড়ালাম। সময় চলে যায়, লাইন আগায় না। অপার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, অধীর আগ্রহে এদিক ওদিক তাকাই। লাইনে নতুন নতুন মানুষ যোগ হয়, লাইনের দৈর্ঘ বাড়তে থাকে। ঢাকা শহর বিশাল এক জনসমুদ্র, যেদিকে তাকাবেন, পিল পিল করে মানুষকে ছুটতে দেখবেন। একটা শহরে এত মানুষ গাদাগাদি করে থাকতে পারে! রাস্তায় ফুটপাথে, চলতে ফিরতে, একজন আরেকজনের গাঁয়ে ধাক্কা লাগে, পা মাড়িয়ে দেয়। এদিকে লাইন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যারা লাইনের দূরতম এলাকায়, তাদের ধারণা সামনে ভেজাল শুরু হয়েছে। আমরা যারা কাছাকাছি, দেখছি অন্য কিছু। ভেন্ডিং বুথ কাজ করছে না, আমার সামনে মাত্র ২/৩ জন, তখন এই ঘটনা। লোকজনের ধৈর্য বালুর বাঁধের মত ভেঙ্গে পড়ছে। উপস্থিত মেট্রোর স্টাফদের উপর চড়াও হয় হয় অবস্থা।
এর আগে টেস্ট করার জন্য একদিন মেট্রোতে উঠেছিলাম। অসাধারণ অনুভূতি হয়েছিলো। সেদিন উঠি দরকারি কাজে। পৃথিবীর প্রথম মেট্রো (লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড) চালু হয় লন্ডনে, প্রায় ১৬৩ বছর আগে। ওখানে দেখেছি, ব্যাংকের এটিএম কার্ড পাঞ্চ করে ট্রেনে উঠতে (নিজেও ব্যবহার করেছি)। এখানে সেরকম কিছু করতে পারলে দারুণ হবে। সড়কে জ্যাম ঠেলে ১.৫ ঘণ্টার রাস্তা মেট্রোতে ২০ মিনিটে যাওয়া যায়। কিন্তু টিকিট কাটতে ৪০ মিনিট লাগলে বেশ বেকায়দা হয়ে যায়।
৪।
এখনও ‘আলমপনার দরবারে’ আসেনি। এই সুযোগে মেলার এদিক ওদিক ঘুরছি। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে বেশ বড় জটলা। ২/১ জন জিজ্ঞেস করেও জানতে পারলাম না, কি হয়েছে। কিছু বই কেনার জন্য ঘুরছি। এর মধ্যে জানতে পারলাম, কিছুক্ষণ আগে সব্যসাচির শতাব্দী ভব বিষয়ক কাণ্ড ঘটে গেছে। দেশ একটা বিশেষ সময় পার করছে। শাহবাগ বা এর আশেপাশে যখন তখন আন্দোলন দানা বাধছে। সেজন্য ঢাকার মানুষ বইমেলা মুখী হতে চাচ্ছে না। এর মধ্যে ভব বিষয়ক ভাবনা অনেকের মাঝে হতাশা ছড়িয়েছে। কয়েক জনের কথা শুনে মনে হল। দেরি করি না। কয়েকটা বই সংগ্রহ করে ফিরে আসি।
৫।
এই কয়দিনের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, মানুষ খুব বেশি অসহিঞ্চু হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনের উপর মেজাজ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। রিকশা প্রায় আমার গাঁয়ের উপর উঠিয়ে দিয়ে আমার উপরে চিল্লায়ে যাচ্ছে। মানুষ দ্রুত খারাপ সময়কে ভুলে যেতে চায়। সে ভাবে, সেই সময়কে নিয়ে ভাবলে কষ্টই বাড়বে। কিন্তু আসলে হওয়ার কথা ছিল, সেখান থেকে শিক্ষা নেয়া।
আমরা এমন এক জাতি, শিক্ষা নেয়ার চেয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকি। সেটা দিতে গিয়েই লাগছে প্যাচ। জীবন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। একমাত্র বুদ্ধিমত্তার সাথে ধৈর্য ধারণ করলে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি। একমাত্র সর্বশক্তিমানই পারেন, জীবনকে সুন্দর ও স্বচ্ছ করে তুলতে।
212
View
Comments
-
Kazi Eshita
3 months ago
ভালো লেগেছে, আরো পড়তে চাই
-
adnan JT
9 months ago
ভাল লাগলো লেখাটা পড়ে।