তুষারঝড় আরও তীব্র হয়েছে। হোটেলের জানালাগুলো কাঁপছে, আর ভেতরে চাপা আতঙ্কে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে সবাই। আলো ঝিমিয়ে আসছে বারবার, যেন কোন অদৃশ্য শক্তি সবকিছু গ্রাস করতে আসছে। এমন অবস্থায় হঠাৎই হোটেলের ম্যানেজার রাশেদ সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, “কেউ একজন এখানে নেই!”
হতবাক সবার মুখে বিস্ময়। কাকে খুঁজছেন তিনি? একসাথে তো সবাই লবিতেই ছিল কিছুক্ষণ আগে! কিন্তু হোটেলের কর্মচারী মুকুল তাড়াতাড়ি বলল, “স্যার, আগের অতিথিদের একজন, সেই কালো কোট পরা লোকটাকে তো আর দেখা যাচ্ছে না।”
সবাই যেন আতঙ্কে জমে গেল। কালো কোট পরা লোকটা? যে লোকটি কারো সাথে খুব একটা কথা বলত না, শুধু গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে থাকত। কিন্তু তার ঘরে গিয়ে দেখা গেল, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তাহলে সে গেল কোথায়?
রাশেদ সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, “কেউ একজন দরজা ভেঙে দেখো!” ভেতরে ঢুকে সবাই হতভম্ব। ঘরটি পুরো খালি, কিন্তু জানালার কাচ ভাঙা। কাচের টুকরো গুলো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে, আর তুষারের সাদা আভা ঘরের ভেতর ঢুকে সবকিছু ধূসর করে দিয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার, জানালার বাইরে তুষারের আস্তরণে কোনো পদচিহ্ন নেই। যেন কেউ বেরই হয়নি!
নীরবতা এতটাই গভীর যে শুধু সবার শ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎই আলোর ঝিলিক দিয়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কারো পায়ের ভারি আওয়াজ শোনা গেল করিডোরে। যেন কেউ ভারী বুট পরে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। আতঙ্কিত সবার মনে প্রশ্ন, তবে কি সেই কালো কোট পরা লোকটাই? নাকি... অন্য কেউ?
রহমান সাহেব সাহস করে টর্চ জ্বালালেন, কিন্তু আলো ঠিকমত কাজ করছে না, বারবার কাঁপছে। সেই কাঁপা আলোয় করিডোরের শেষ মাথায় ছায়ামূর্তির মতো কিছু দেখা গেল। দীর্ঘদেহী, মাথায় টুপি, আর গাঢ় কালো কোটে আবৃত। কিন্তু তার মুখ অন্ধকারে ঢাকা। শুধু লাল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
রাশেদ সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, “তুমি কে?”
কোনো উত্তর নেই। বরং ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে করিডোরের দেয়ালের ভেতরে মিলিয়ে গেল, যেন কখনো ছিলই না।
ভয়ার্ত সবাই ছুটে এসে করিডোর দেখল, দেয়াল একদম স্বাভাবিক, কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু মুকুল হঠাৎ বলে উঠল, “এ তো অসম্ভব! দেয়ালের ওই জায়গাটায় তো আগের হোটেলের মালিক আত্মহত্যা করেছিল... ঠিক ওই একই কোট পরে!”
সবাই স্তব্ধ। তাহলে কি সে ফিরে এসেছে? প্রতিশোধ নিতে? নাকি এই তুষারঝড়ের রাতে কোনো অভিশপ্ত অতীত তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে?
তখনই হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা সবাইকে শিউরে দিল। মনে হলো কেউ যেন তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।
হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে আসল, আর আলোর ঝলকানিতে দেখা গেল, লবির মাঝখানে তুষারের উপর রক্তের ছোপ! ঠিক যেন কেউ মাটিতে টেনে নিয়ে গেছে। রক্তের দাগগুলো অনুসরণ করে সবাই হোটেলের পিছনের পুরনো সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সেই সিঁড়ি, যেখানে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা ছিল।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে মাটির নিচে একটা ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে পৌঁছালো তারা। দেয়ালে ছাপানো পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং – “হোটেলের মালিকের রহস্যজনক মৃত্যু”, “আত্মহত্যা নাকি খুন?”, “কালো কোটের অভিশাপ!”
হঠাৎই পেছন থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল! কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, “দরজা বন্ধ হয়ে গেল কিভাবে?” টর্চের আলোতে দেখা গেল, কেউ একজন করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই কালো কোট পরা মানুষ, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
কেউ একজন ফিসফিস করে বলল, “সে তো মৃত! তাহলে...”
আতঙ্কে সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে, আর তুষারের গর্জন আরও তীব্র হয়, যেন সেই মৃত মালিকের আর্তনাদ ধ্বনিত হচ্ছে।
মুকুল হঠাৎ বলে উঠল, “এই সিঁড়ি দিয়েই নাকি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেই রাতে!”
সবাই থমকে যায়। তাহলে কি সেই কালো কোটের ছায়া আসলে অতীতের প্রতিচ্ছবি? নাকি কোনো অভিশপ্ত আত্মা প্রতিশোধ নিতে ফিরে এসেছে?
ছায়ামূর্তিটি আরও কাছে আসতে থাকে, তার লাল চোখ দুটো ভয়াবহভাবে জ্বলজ্বল করতে থাকে। সবাই আতঙ্কে পেছনের দিকে সরে যায়, কিন্তু সিঁড়ির নিচ থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে যেন সবাইকে আটকে দেয়।
আলো নিভে যায়, আর করিডোরের দেয়াল থেকে ভৌতিক ছায়া ভেসে ওঠে। আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে রাশেদ সাহেব ফিসফিস করে বললেন, “আমরা এখানে বন্দি হয়ে গেছি!”
ছায়ামূর্তিটি আরও এক ধাপ এগিয়ে আসে, আর তুষারের ঝাপটা ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়, ঠান্ডা শ্বাস সবার গায়ে লাগতে থাকে।
ঠিক তখনই এক বৃদ্ধের কণ্ঠ শোনা গেল, “যাও! ফিরে যাও! আমার প্রতিশোধ শেষ হয়নি!” দেয়ালের ছায়ামূর্তিগুলো হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল, আর ভৌতিক কণ্ঠগুলো মিলিয়ে যেতে লাগল তুষারের গর্জনের সাথে।
তুষারঝড়ের গর্জন থেমে গেল হঠাৎ। আলো ফিরে এল, আর তারা দেখল, ঘরের মেঝেতে শুধুই তুষার আর রক্তের দাগ। কিন্তু সেই কালো কোট পরা লোকটি কোথায়?
হতভম্ব সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। হঠাৎ মুকুল ফিসফিস করে বলল, “তবে কি আমরা কখনোই এই হোটেল থেকে বের হতে পারব না?”
সবার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কারণ তারা জানত, তুষারঝড়ের রাত শেষ হলেও অভিশাপ এখনও রয়ে গেছে, সেই কালো কোটের ছায়ায়...