Posts

গল্প

"শেষ চিঠির ঠিকানা"

February 17, 2025

AKM Mehedi Hasan Chowdhury

111
View

সন্ধ্যার নরম আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। বাইরে পাখিরা ডানায় ভর করে নীড়ে ফিরছে। রুমার চোখের কোণে জল জমেছে, সে ধীরে ধীরে একটা পুরোনো ডায়েরি খুলল। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, যেন অনেক দিনের স্মৃতির ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। ডায়েরির পাতা উল্টাতেই একখানা চিঠি বের হয়ে এল।

চিঠিটা হাতের মুঠোয় ধরে তার বুক কেঁপে উঠল। এটা রায়হানের শেষ চিঠি। সেই চিঠি, যেটা আজও তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। রায়হান ছিল তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা, যার সাথে সুখের স্বপ্ন বুনেছিল সে। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো আর কখনোই পূর্ণ হবে না, কারণ রায়হান আর নেই।

চার বছর আগে রায়হান হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ডাক্তার জানালেন, তার লিভার ক্যান্সার হয়েছে। রুমা বিশ্বাস করতে পারেনি, এত প্রাণবন্ত একটা মানুষ এমন কঠিন রোগে আক্রান্ত হতে পারে? রায়হান তখনও হাসিমুখে বলেছিল, “তুমি ভয় পেও না, আমি ঠিক হয়ে যাব।” কিন্তু তার সেই সাহসী কথাগুলো সময়ের সাথে সাথে ম্লান হতে থাকল।

চিকিৎসা চলতে থাকল, কিন্তু রায়হানের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। রুমা প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে তার পাশে বসে থাকত। রায়হানের হাতটা ধরে বলত, “তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না, আমাদের তো কত স্বপ্ন এখনও বাকি!” রায়হান হেসে উত্তর দিত, “তোমার স্বপ্নগুলো আমার চোখে থাকবে।”

একদিন রাতে হঠাৎ করেই রায়হান বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বললেন, “ওর খুব একটা সময় বাকি নেই।” রুমা ভেঙে পড়ল, কিন্তু রায়হান তখনও শক্ত ছিল। সে রুমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল, “যেদিন আমি থাকব না, সেদিন এটা পড়বে। আমি তোমার কাছেই থাকব, সবসময়।”

রুমার বুকটা ফেটে গেল, কিন্তু চোখের সামনে নিজেকে শক্ত রাখতে হলো। রায়হান চোখ বন্ধ করে গভীর স্বরে বলল, “রুমা, আমাকে ভুলে যেও না, কিন্তু সামনে এগিয়ে যেও। তোমার হাসি আমার কাছে সব থেকে দামি।” সেই রাতেই রায়হান চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়ল।

আজ চার বছর পর রুমা সেই চিঠিটা খুলল। হাত কাঁপছে, বুকের ভেতরটা ব্যথায় ভরে উঠছে। চোখের জল ডায়েরির পাতায় পড়ছে। চিঠিটা খুলতেই রায়হানের হাতের লেখা—খুব সুন্দর আর পরিপাটি।

“প্রিয় রুমা,
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে, আমি তখন তোমার সামনে থাকব না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, তোমার প্রতিটি হাসিতে, প্রতিটি অশ্রুতে।
তুমি জানো, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম—তোমার জন্য, আমাদের জন্য। কিন্তু জীবনের নিয়ম মেনে নিতে হয়। আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু তোমার স্মৃতিতে বেঁচে থাকব।
তুমি খুব শক্ত মেয়ে, জানি তুমি আমাকে ছাড়া একদিন ঠিক থাকতে শিখে যাবে। নিজের যত্ন নিও, আমার প্রিয় স্মৃতিগুলোকে বুকে রেখে নতুন করে স্বপ্ন দেখো।
তোমার হাসি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আমি তোমার সেই হাসি দেখতে চাই, সবসময়। আমার জন্য নয়, নিজের জন্য হাসো।
ভালো থেকো, রুমা।
তোমার রায়হান।”

চিঠির প্রতিটি শব্দে রুমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। চার বছর ধরে নিজেকে শক্ত রেখেছিল সে, কিন্তু আজ আর পারল না। বাঁধ ভেঙে অঝোরে কাঁদল, “তুমি কেন চলে গেলে, রায়হান? কেন আমাকে একা রেখে গেলে?”

জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। মনে হলো, রায়হানের স্পর্শ এখনও তার চারপাশে ঘুরছে। সে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

বাইরে আকাশটা ধূসর হয়ে আসছিল। পাখিরা নীড়ে ফিরছিল, কিন্তু রুমার হৃদয়টা শূন্যতায় ভরে গিয়েছিল। রায়হান হয়তো শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তার স্মৃতি, তার ভালোবাসা, তার হাসি—সবকিছুই রুমার হৃদয়ের গহীনে বেঁচে থাকবে, চিরকাল।

Comments

    Please login to post comment. Login