Posts

গল্প

মায়ের শেষ উপহার

February 17, 2025

AKM Mehedi Hasan Chowdhury

127
View


সুমনের ছোট্ট সংসার। স্ত্রী নীলা আর তাদের পাঁচ বছরের মেয়ে পূজা—এই তিনজনকে নিয়েই তার জীবনের সব স্বপ্ন। ছোটখাটো চাকরি করে কোনো মতে সংসার চলে, তবু সুমন কখনো হাল ছাড়েনি। তার চোখে একটা অদম্য ইচ্ছা—মেয়েকে বড় করে মানুষ করবে, তাকে ভালো স্কুলে পড়াবে।

কিন্তু একটা জিনিস সুমনের বুকের ভেতর সবসময় খচখচ করে—তার মা। অনেক বছর আগে বাবা মারা গেছেন, তারপর থেকেই মা একা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বয়স বেড়েছে, শরীরও দুর্বল, তবু মা কখনোই শহরে আসতে চাননি। তিনি গ্রামের মাটিতে, তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতেই থাকতে ভালোবাসেন।

প্রতিবছর ঈদে সুমন গ্রামে যায়। পূজা খুব খুশি হয় দাদির কাছে যাবে বলে। দাদি তার জন্য কতরকমের মিঠাই তৈরি করে, গল্প বলে ঘুম পাড়ায়। মা তাকে স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেন, কিন্তু সুমনের চোখে মায়ের মুখের ক্লান্তি ধরা পড়ে। মনে মনে ভাবত, “কতদিন আর একা থাকবে মা? এ বছর শহরে নিয়ে আসব।”

এইবার ঈদের দুদিন আগে সুমন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হলো। ঈদের বাজারও করতে হবে, আবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মাকে নিয়ে আসতে হবে। পূজা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাবা, দাদি কি এবার আমাদের সঙ্গে থাকবেন?” সুমন মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ রে, দাদি এবার তোর সাথেই থাকবে।”

শহরের দোকান থেকে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনল সুমন। মা সবসময় সাদাসিধে কাপড় পরেন, তাই খুব সুন্দর একটা সাদা শাড়ি নিল। ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভরে উঠল তার মন। মা যখন শাড়িটা পরবেন, তখন কত সুন্দর লাগবে!

পরদিন ভোরে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সুমন, নীলা আর পূজা। রাস্তার ধারে ধারে কাঁচা আমের গন্ধ, খেজুরের গাছ, আর মাটির ঘ্রাণ—সবকিছুতেই সুমনের শৈশবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মায়ের মুখটা মনে পড়তেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল।

গ্রামে পৌঁছেই সুমন বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, “মা! আমি আসলাম!” কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। আশেপাশের প্রতিবেশীরা ছুটে এলো, কেউ কিছু বলতে পারছে না, শুধু মুখে বিষাদের ছাপ। সুমনের বুকটা ধক করে উঠল। ঘরে ঢুকতেই দেখল, মা বিছানায় শুয়ে আছেন—চোখ বুজে, শান্ত মুখ, ঠোঁটে অদ্ভুত এক মমতার হাসি।

মা চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। গত রাতে ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন পরপারে। সুমনের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা আর নেই।

বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল সুমন। “মা, তুমি কথা দিয়েছিলে, আমার সাথে শহরে যাবে! তুমি এমন করে কীভাবে চলে যেতে পারলে?” পূজা অবুঝ চোখে তাকিয়ে আছে, তার বুঝে আসে না, কেন তার বাবা এমন করে কাঁদছে।

মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। সুমন শোকে স্তব্ধ। মায়ের মুখটা বারবার মনে পড়ছে। এত শান্ত মুখ, এত মমতা। মনে পড়ল, মা তাকে বলেছিলেন, “তোর সংসারে তোর জায়গা হোক, আমার জন্য তোকে কষ্ট করতে হবে না।”

মায়ের জিনিসপত্র গোছানোর সময় সুমনের হাতে একটা ছোট্ট পুটলি এল। খুলতেই দেখল, পুরনো একটা চিরকুট, তাতে মায়ের হাতের লেখা—
“সুমন, আমার আদরের ছেলে,
তোর জন্য নতুন শাড়ি কিনতে পারিনি, তবু এই পুরনো শাড়ির আঁচলে তোর শৈশবের গন্ধ লেগে আছে। যখন মনে পড়বে, তখন এটা বুকে জড়িয়ে নিস। মনে করিস, আমি তোর সাথেই আছি।
তোর মায়ের অনেক আদর।”

সুমন চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। মায়ের শেষ উপহার, মায়ের শেষ স্মৃতি। শাড়ির আঁচলটা মুখে নিয়ে শ্বাস নিতেই মায়ের গায়ের গন্ধ পেল।

ঈদের দিন সকালে সুমন মায়ের জন্য কেনা সাদা শাড়িটা বের করল। হাত বুলিয়ে অশ্রু ঝরল। তার মাকে এই শাড়ি পরিয়ে শহরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। পূজা এসে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, দাদির শাড়ি কেন পড়া হলো না?” সুমন চোখের জল মুছে বলল, “দাদি তো অনেক দূরে চলে গেছে, মা। ওখানে তো শাড়ি লাগে না।”

শাড়িটা মায়ের কবরের পাশে রেখে সুমন ফিসফিস করে বলল, “মা, তোর জন্যই কিনেছিলাম। এবার না পারলেও পরের জন্মে তুই এটা পরে আমার কাছে আসিস, ঠিক আছে?”

বাতাসে শাড়ির আঁচলটা উড়ল, যেন মায়ের আশীর্বাদ সুমনের গায়ে এসে পড়ল। সুমন চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা কল্পনা করল—মায়ায় ভরা মুখ, ঠোঁটে মমতার হাসি। মনে হলো, মা যেন বলছেন, “ভালো থাকিস, আমার ছেলে।”

সুমন জানে, মা এখন নেই, তবু মায়ের স্মৃতি, মায়ের ভালোবাসা তার সাথে থাকবে চিরকাল। মায়ের শাড়ির গন্ধে সে খুঁজে পাবে শৈশবের স্নেহমাখা মুহূর্তগুলো।

মায়ের শাড়িটা চোখের জলে ভিজতে ভিজতে সুমন উপলব্ধি করল, মায়েরা কখনো চলে যায় না। তারা স্মৃতির গন্ধে, ভালোবাসার স্পর্শে, সবসময় সন্তানের পাশে থাকে।

Comments

    Please login to post comment. Login