তামিমের শৈশবটা খুব সাধারণ ছিল না। মা ছোটবেলাতেই মারা গেছেন, আর বাবা আব্দুল করিম ছিলেন কঠোর শাসনের প্রতীক। তামিম কখনো বাবাকে হাসতে দেখেনি, এমনকি তার জীবনের ছোট-বড় কোনোকিছুতেই বাবার উৎসাহ ছিল না।
বাবা খুব ভোরে উঠে মাঠে চলে যেতেন, সারাদিন কৃষিকাজ করে রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরতেন। তামিমের একটাই ইচ্ছা ছিল—একবার বাবা তাকে আদর করে কোলে তুলে নেবেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন। কিন্তু বাবা যেন পাথরের মূর্তি, কোনো অনুভূতিই প্রকাশ পেত না।
স্কুলে যখন তামিম প্রথমবার প্রথম হয়েছিল, সবাই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল, কিন্তু বাবা শুধু ম্লান চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, “অহংকার কোরো না, পড়ায় মন দাও।” তামিমের মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল, মনের ভেতর কষ্ট জমেছিল। সে মনেপ্রাণে চেয়েছিল, বাবা একটু প্রশংসা করুক, একটু হাসুক।
দিন চলে যায়। তামিম বড় হতে থাকে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। বাবার চোখে কঠোরতা কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুতে বাবা কখনো মাথা ঘামান না। তামিম অনেকবার বাবাকে বলেছে, “বাবা, তুমি আমাকে কেন ভালোবাসো না?” প্রতিবারই বাবার মুখটা কঠিন হয়ে যেত, তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে যেতেন।
কলেজের শেষ বছরে তামিমের বন্ধুরা শিক্ষা সফরে যাবে। খুব ইচ্ছা ছিল তারও যাবে, কিন্তু ভয়ে বাবাকে বলতে পারেনি। একদিন সাহস করে বাবার কাছে গিয়ে বলল, “বাবা, আমার বন্ধুরা সবাই ঘুরতে যাবে। আমিও যেতে চাই।” বাবা সেদিনও কঠোর চোখে তাকিয়ে বললেন, “ফালতু কাজের সময় নেই। পড়ায় মন দাও।”
মন খারাপ নিয়ে তামিম সেদিন রাতে খেতে পারল না। বাবার কঠোরতা তার মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। “বাবা আমাকে একটুও ভালোবাসে না,” মনে মনে ভাবল সে।
এরপর দিনগুলো দ্রুত পার হতে লাগল। কলেজ শেষ করে তামিম ঢাকায় একটা ভালো চাকরি পেল। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে নতুন জীবনের সূচনা হলো তার। মাঝে মাঝে ফোন করত, কিন্তু বাবার স্বভাব বদলায়নি। কঠোর গলায় শুধু বলতেন, “নিজের খেয়াল রেখো, সময়মতো খাবার খেও।” তামিম বুঝত, এটা বাবার আদেশ, ভালোবাসা নয়।
সেই দিনগুলোতে তামিম আরো নিশ্চিত হলো, বাবা তাকে একটুও ভালোবাসেন না। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হতো বাবার মুখের ওপর বলে দেয়, “তুমি আমার কিছু না!” কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা টান কাজ করত।
বছর দুয়েক পর হঠাৎ একদিন ফোন এল গ্রামের এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে, “বাবা খুব অসুস্থ, তাড়াতাড়ি এসে যাও।” খবরটা শুনেই তামিম ছুটল গ্রামের বাড়িতে। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু ডাক্তার জানালেন, খুব বেশি সময় নেই। বাবার ক্যানসার শেষ পর্যায়ে।
তামিমের চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল। বাবার শক্তিশালী শরীরটা ভেঙে গেছে, মুখে গভীর ক্লান্তি। কিন্তু চোখে সেই চিরচেনা কঠোরতা। তামিম বাবার পাশে বসে আস্তে করে বলল, “বাবা, এতদিন আমাকে একবারও বললে না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো?”
বাবা চোখ বন্ধ করলেন, ঠোঁটে একটুখানি কাঁপুনি খেল, কিন্তু কিছু বললেন না। তামিমের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। বাবা কি সত্যিই কোনোদিন তাকে ভালোবাসেননি?
দুদিন পর বাবার মৃত্যুর পর বাড়িতে পরিচ্ছন্নতা করতে গিয়ে তামিম একটা পুরনো সিন্দুক পেল। সিন্দুক খুলতেই তার চোখ ছলছল করে উঠল।
ভেতরে তার স্কুলের সব সার্টিফিকেট, পুরস্কার, এমনকি তার ছোটবেলার ছবি গুছিয়ে রাখা। প্রতিটি কাগজে বাবার হাতের লেখা—“আমার ছেলের প্রথম সাফল্য”, “তামিমের জীবনের প্রথম পুরস্কার”। একটা ডায়েরির পাতায় লেখা,
“আজ তামিম প্রথম হয়েছে। ইচ্ছা ছিল বুকে জড়িয়ে ধরি, কিন্তু ভয় হয়, ও যদি দুর্বল হয়ে যায়? আমার ছেলেকে শক্ত হতে হবে।”
তামিম ডায়েরিটা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বাবা প্রতিটি মুহূর্তে তাকে ভালোবেসেছেন, প্রতিটি সাফল্যে গর্বিত হয়েছেন, কিন্তু কখনো প্রকাশ করেননি। তার কঠোরতার আড়ালে ছিল গভীর ভালোবাসা, যা তামিম কখনো টের পায়নি।
আরেকটা পৃষ্ঠায় লেখা,
“তামিম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন তাকে ভালোবাসি না। সত্যি বলতে, আমি যে কত ভালোবাসি, সেটা বলা হয়নি কখনো। ভয় ছিল, বললে হয়তো ও দুর্বল হয়ে পড়বে।”
তামিমের বুক ফেটে যাচ্ছিল। বাবার কঠোরতার আড়ালে যে অপ্রকাশিত ভালোবাসা ছিল, সেটা সে বুঝতে পারেনি। বাবা তার সমস্ত স্নেহ, মমতা, গর্ব সবকিছুই লুকিয়ে রেখেছিলেন, শুধু তাকে শক্ত মানুষ বানানোর জন্য।
মাটির ঘরে বাবার ব্যবহৃত পুরনো চেয়ারটা পড়ে আছে। তামিম কাঁদতে কাঁদতে সেই চেয়ারের কাছে গিয়ে বসে পড়ল। “বাবা, তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে! তুমি কেন আমায় কিছুই বললে না?”
বাতাসে কেমন একটা শূন্যতা। মনে হলো, বাবা তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, মৃদু হেসে বলছেন, “তুই আমার গর্ব, তামিম। তুই তো আমার সবকিছু।”
চোখের জল মুছে তামিম ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে নিল। বাবার অপ্রকাশিত ভালোবাসা আজ তার হৃদয়ে গভীরভাবে লেখা হয়ে গেল। সে জানে, বাবার ভালোবাসা সবসময় তার সাথেই থাকবে, অদৃশ্য হাতের আশীর্বাদ হয়ে।