জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কষ্ট সঙ্গী হয়েছিল বোশির। শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত তার জীবনে সুখের স্মৃতি খুব কম। বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন ছোটবেলায়। দাদির কোলে মানুষ হয়েছে সে, কিন্তু অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
গ্রামের কুঁড়েঘরে বেড়ে ওঠা বোশিরের ইচ্ছা ছিল সে একদিন বড় হবে, শহরে যাবে, ভালো চাকরি করবে। ছোটবেলায় যখন অন্য ছেলেরা খেলাধুলা করত, তখন বোশির মাঠের কাজ করত, বাজারে কুলির কাজ করত। নিজের ভবিষ্যতের জন্য নয়, দাদির মুখে একবেলা খাবার তুলে দেওয়ার জন্য।
একদিন স্কুল থেকে ফিরেই দেখে দাদি মাটিতে পড়ে আছেন। তার পেটের ক্ষুধা তখন শূন্যে মিলিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে পাড়ার হাকিম চাচাকে ডেকে আনল। তিনি এসে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “দাদি আর নেই, বোশির।”
বুকটা ছিঁড়ে গেল বোশিরের। তার একমাত্র আপনজন, যে তাকে আগলে রেখেছিল, আজ সে নেই। দাদির নিথর শরীরের পাশে বসে বোশির কাঁদতে লাগল। সেদিন থেকে সে একা হয়ে গেল, পুরোপুরি একা।
দাদির মৃত্যুর পর গ্রামের স্কুল ছাড়তে হলো তাকে। বেঁচে থাকার জন্য তাকে শহরে আসতে হলো কাজের সন্ধানে। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় কাজ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত সে। কেউ গালমন্দ করত, কেউ তাড়িয়ে দিত। তবু সে হাল ছাড়েনি।
অবশেষে এক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “কাজ চাই, কিছু খাবারের বিনিময়ে কাজ করব।” হোটেলের মালিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “থালা-বাসন পরিষ্কার করতে হবে। পারবি?” বোশির সোজা মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।
সেই থেকে তার জীবন শুরু হলো হোটেলের রান্নাঘরে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থালা-বাসন পরিষ্কার করত, মেঝে মুছত। তার বিনিময়ে পেত একবেলা ভাত আর রাতে হোটেলের কোণায় ঘুমানোর জায়গা।
কিন্তু বোশিরের ইচ্ছা ছিল বড় কিছু করার। সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল, মানুষ হতে চেয়েছিল। হোটেলের কাজের ফাঁকে সে পরিত্যক্ত পুরনো বই পড়ত। মাঝে মাঝে ক্রেতাদের ফেলে যাওয়া পত্রিকা পড়ত, চোখের পানিতে পাতা ভিজে যেত। “আমি কি কোনোদিন পড়াশোনা করতে পারব না?” প্রশ্নটা তার মনে প্রতিনিয়ত কাঁটার মতো বিঁধত।
একদিন হোটেলে খেতে এলেন এক ভদ্রলোক। বোশির খেয়াল করল, লোকটি তাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদাভাবে দেখছেন। খাওয়া শেষে লোকটি তাকে ডাকলেন, “তোর নাম কী?”
“বোশির।” মাথা নিচু করে উত্তর দিল সে।
লোকটি মুচকি হেসে বললেন, “তোর চোখে কিছু আলাদা দেখছি। পড়াশোনা করিস?”
বোশিরের চোখ ভিজে উঠল, “পড়তে চাই, কিন্তু আমার কেউ নেই, স্যার।”
লোকটি তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুই পড়বি। আমি তোর সব খরচ দেখব। কিন্তু একটা শর্ত আছে, মন দিয়ে পড়তে হবে, জীবনে বড় হতে হবে।”
অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল বোশিরের। তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা যেন সত্যি হতে চলেছে। সে ভদ্রলোকের পায়ের কাছে বসে পড়ল, “আমি মন দিয়ে পড়ব স্যার, আমি বড় হতে চাই।”
সেই থেকে বোশিরের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। ভদ্রলোকের নাম ছিল মাকসুদ সাহেব। তিনি বোশিরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন, নতুন জামাকাপড় কিনে দিলেন, ভালো স্কুলে ভর্তি করালেন।
বোশির মনপ্রাণ দিয়ে পড়তে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, এই সুযোগ সে কখনোই হারাতে পারবে না। দিনরাত পরিশ্রম করত, ক্লাসের সবার চেয়ে ভালো ফল করত। স্কুলের শিক্ষকরা তার মেধা দেখে অবাক হতেন।
বছর কয়েক পর বোশির এসএসসিতে প্রথম হলো। মাকসুদ সাহেব তাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, “তুই একদিন বড় হবে, বোশির। আমার স্বপ্ন তুই পূরণ করবি।”
বোশিরের চোখে আনন্দের জল, কিন্তু সেই জল ছাপিয়ে উঠে এল দাদির মুখ। “আজ দাদি বেঁচে থাকলে কত খুশি হতেন!” মনে মনে বলল সে।
এভাবেই সময় গড়িয়ে গেল। বোশির উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। তার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, একটা ভালো চাকরি করবে, মাকসুদ সাহেবের উপকারের প্রতিদান দেবে।
কিন্তু বিধাতা কি তার জন্য সুখ লিখে রেখেছিলেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে থাকতে হঠাৎ একদিন খবর এলো—মাকসুদ সাহেব স্ট্রোকে মারা গেছেন। বোশিরের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তার অভিভাবক, তার সবকিছু আজ নেই।
মাকসুদ সাহেবের মৃত্যুর পর তার পরিবারের কেউ বোশিরকে মেনে নেয়নি। তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো। আবারও অনিশ্চয়তায় ভরে গেল তার জীবন।
বোশির হাল ছাড়ল না। টিউশনি করে পড়াশোনা চালাতে লাগল। কিন্তু টাকার অভাবে ঠিকমতো খেতে পারত না, কখনো কখনো না খেয়েই কাটাতে হতো। তারপরও সে স্বপ্ন দেখতে ছাড়েনি।
শেষবর্ষের পরীক্ষার আগে তার শরীর ভেঙে পড়ল। হাসপাতালে নেওয়া হলো, ডাক্তার জানালেন, “পুষ্টির অভাবে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। বিশ্রাম দরকার।”
বোশিরের চোখে অশ্রু। তার স্বপ্ন কি তবে অধরাই থেকে যাবে? এতদিনের পরিশ্রম, এত লড়াই কি তবে বৃথা হবে? হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সে কাঁদছিল, “দাদি, তুমি আমাকে এত কষ্ট দিয়ে কেন রেখে গেলে? আমি বড় হতে চাই, মানুষ হতে চাই। কেন আমার জীবনটা এত কঠিন?”
কিছুদিন পর পরীক্ষা দিতে গিয়ে বোশির অজ্ঞান হয়ে পড়ল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, ডাক্তার জানালেন, “শরীর আর সায় দিচ্ছে না। এই মুহূর্তে বিশ্রাম দরকার, নাহলে বড় বিপদ হবে।”
বোশিরের স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। চোখ বুজে সে মনে মনে দাদির কাছে প্রার্থনা করল, “আমাকে নিয়ে যাও, দাদি। আমি আর পারছি না।”
অতঃপর, এক সন্ধ্যায় বোশির চিরতরে চোখ বন্ধ করল। তার স্বপ্নগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নটা তার মনেই থেকে গেল। মৃত্যুর আগে তার ঠোঁটে একফোঁটা হাসি ছিল, কারণ সে জানত, তার লড়াইটা সে শেষ পর্যন্ত করেছিল।