Posts

গল্প

নীরব যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি

February 17, 2025

AKM Mehedi Hasan Chowdhury

131
View

শাওন আর আয়েশার সংসারটা দেখতে খুব সাদামাটা ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কতটা ঝড় বয়ে গেছে, তা বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারত না। শাওনের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল সুখী পরিবার, যেখানে সে তার স্ত্রী আয়েশাকে সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেবে। কিন্তু বাস্তবতা সবসময় স্বপ্নের মতো হয় না।

আয়েশা খুব হাসিখুশি মেয়ে ছিল। তার মিষ্টি হাসি দেখে শাওন প্রথম প্রেমে পড়েছিল। বিয়ের পর প্রথম ক’টা মাস সত্যিই খুব সুন্দর কেটেছিল তাদের। শাওন অফিস থেকে ফিরলে আয়েশার চোখে মুখে আলোর ঝিলিক ফুটে উঠত। শাওন তার জন্য ছোটখাটো উপহার আনলে আয়েশার খুশি দেখে শাওনের ক্লান্তি উধাও হয়ে যেত।

কিন্তু সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। শাওনের চাকরিটা হঠাৎ করেই চলে গেল। কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে শত শত কর্মচারীর মতো তাকেও ছাঁটাই করা হলো। তখন থেকেই শুরু হলো জীবনের কঠিন অধ্যায়।

চাকরি হারানোর পর শাওন নতুন চাকরির জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে লাগল, কিন্তু কোথাও ভালো সুযোগ মিলল না। একের পর এক ইন্টারভিউতে ব্যর্থ হয়ে তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ল। আয়েশা সারাক্ষণ তাকে সান্ত্বনা দিত, “কষ্ট করো না শাওন, তুমি পারবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কিন্তু শাওনের মনের ভেতরে অশান্তি জমে উঠছিল। সংসারের খরচ, বাড়িভাড়া, বাজার-সদাই—সবকিছুই যেন পাহাড়ের মতো চেপে বসেছিল তার উপর। আয়েশার অলংকারগুলো একে একে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছিল তারা। আয়েশা কখনোই কোনো অভিযোগ করত না, বরং শাওনের মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসি দিত।

কিন্তু শাওনের মনটা খারাপ হয়ে যেত, “কী এমন দোষ ছিল আমার? কেন আমার জীবনটা এতো কঠিন?”

একদিন রাতে শাওন খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। বাড়ির মালিক কয়েকবার ভাড়া চাইতে এসেছে, কিন্তু তার কাছে একটা টাকাও নেই। আয়েশার হাত ধরে বলল, “আমি ব্যর্থ, আয়েশা। আমি তোমাকে কোনো সুখই দিতে পারছি না।”

আয়েশার চোখে জল এল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুমি এমন কথা বলো না শাওন। সুখ শুধু টাকাপয়সায় হয় না। তুমি পাশে আছো, এটাই আমার সবচেয়ে বড় সুখ।”

শাওন আয়েশাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কিন্তু কান্নায় কি সব সমস্যার সমাধান হয়? দিন যত যাচ্ছিল, পরিস্থিতি ততই কঠিন হয়ে উঠছিল। শাওন দিনের পর দিন চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াত, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।

অভাবের তাড়নায় একদিন আয়েশা বলল, “শাওন, আমি টিউশনি করাব। কিছু টাকা হলে তোমার উপর চাপ কমবে।”

শাওন প্রথমে রাজি হতে চায়নি, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হলো। আয়েশার পড়াশোনার হাত ভালো ছিল, তাই কয়েকটা টিউশনি পেয়ে গেল সহজেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আয়েশার পরিশ্রম দেখে শাওনের বুকটা কেঁপে উঠত।

তবুও টাকার অভাব মেটানো যাচ্ছিল না। বাসায় খাবার কমে আসছিল, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ছিল, এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও ঠিকমতো কেনা যাচ্ছিল না। একদিন ফ্রিজ খালি দেখে শাওন চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছিল, “কী করব? কোথায় যাব? এই জীবন শেষ করে দিলে কি সব সমস্যার সমাধান হবে?”

আয়েশা জানত না, শাওনের ভেতরে এতো অশান্তি জমে আছে। সে শুধু জানত, তার স্বামী তাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু শাওন নিজেকে আর সামলাতে পারছিল না। সে একটা ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়াল। নিচে গভীর নদী, হিমশীতল পানি বয়ে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। আয়েশার নাম ভেসে উঠল স্ক্রিনে। শাওন কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল। ফোনটা কাঁপছে, কিন্তু সে ধরছে না। মনে মনে ভাবছে, “এই এক ফোনকলেই সব কিছু বদলে যাবে কি?”

তবুও সে ফোনটা ধরল। ওপাশ থেকে আয়েশার কাঁপা কণ্ঠ, “শাওন, তাড়াতাড়ি এসো! আমার খুব ভয় লাগছে। বাচ্চাটা নড়ছে না... আমি একা... প্লিজ, এসো।”

শাওনের পা হিম হয়ে গেল। সে জানত, আয়েশা অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু এভাবে বিপদ হবে, তা ভাবেনি। নিজের জীবনের সব যন্ত্রণা ভুলে দৌড় দিল বাড়ির দিকে।

বাড়িতে গিয়ে দেখল, আয়েশা মেঝেতে বসে কাঁদছে, পেটটা ধরে আছে। শাওন দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল তাকে। ডাক্তার বলল, “ভাগ্য ভালো, একটু দেরি হলে বাচ্চা বাঁচানো যেত না।”

শাওনের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। মনে পড়ল, ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সে কী ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। যদি ফোনটা না ধরত, তবে আয়েশা হয়তো তাকে হারিয়ে একা হয়ে যেত। আর তাদের অনাগত সন্তান...

কিছুদিন পর আয়েশার কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে একটা মেয়ে। শাওন মেয়েটাকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদল। আয়েশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাঁদছো কেন?”

শাওন মিষ্টি হেসে বলল, “এটা খুশির কান্না, আয়েশা। আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষে আশীর্বাদও দিলেন। আমি আর কখনো ভাঙবো না... তোমাদের জন্য বাঁচব, সব কষ্ট পেরিয়ে।”

আয়েশার চোখেও পানি এল। শাওনকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, “তুমিই আমার সব সুখ, শাওন। তোমার শক্তিতেই আমি বাঁচি। তুমি পাশে থাকলেই আমাদের সব ঝড় থেমে যাবে।”

শাওন মাথা নত করে আয়েশার কপালে চুমু খেল। সত্যিই তো, ভালোবাসাই সব অন্ধকারকে জয় করতে পারে।

Comments

    Please login to post comment. Login