Posts

গল্প

বাবার শেষ উপহার এর স্মৃতি

February 17, 2025

AKM Mehedi Hasan Chowdhury

Original Author এ,কে,এম মেহেদী হাসান চৌধূরী

124
View

শহরের ব্যস্ততম এলাকায় ছোট্ট ভাড়া বাসায় রাহুল আর তার বাবা রফিক মিয়া থাকত। রাহুলের বয়স মাত্র দশ বছর, কিন্তু তার চোখে স্বপ্নের শেষ নেই। সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, বাবাকে ভালোভাবে রাখবে। কিন্তু এই স্বপ্নের কথা কখনো বাবাকে বলেনি, কারণ রফিক মিয়ার পক্ষে ছেলের এত বড় স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নয়।

রফিক মিয়া দিনমজুর, রাস্তার ধারে ইট-বালু টেনে যা উপার্জন করেন, তাতেই কোনোরকমে চলে যায় তাদের সংসার। তার নিজের স্বপ্ন বলতে একটাই—ছেলে রাহুলকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করা। প্রতিদিন সকালে কাজের জন্য বের হওয়ার আগে রাহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, "ভালো করে পড়িস বাবা, তুই একদিন বড় মানুষ হবি।" রাহুল হাসিমুখে সায় দিত, "হ্যাঁ বাবা, আমি একদিন তোমার সব কষ্ট দূর করব।"

কিন্তু জীবন তো আর স্বপ্নের মতো সহজ নয়। রাহুল যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে, ঠিক তখনই তাদের জীবনে নেমে এলো ভয়াবহ ঝড়। রফিক মিয়া হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানালেন, তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এই অসুস্থতা যে তাদের সবকিছু ওলটপালট করে দেবে, সেটা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

রাহুল কিছুই বুঝতে পারছিল না, শুধু বাবার কষ্ট দেখে তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠত। ওষুধ আর চিকিৎসার খরচ মেটাতে রফিক মিয়া নিজের শেষ সম্বল, মায়ের দেয়া বিয়ের আংটিটাও বিক্রি করে দিলেন। তবুও তার শরীর ভালো হলো না, বরং আরও খারাপের দিকে যেতে লাগল।

একদিন রাহুল বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "বাবা, তুমি এমন অসুস্থ কেন? তুমি তো সবসময় বলো, তুমি সুপারম্যানের মতো শক্তিশালী। তাহলে এমন কেন হলো?"

রফিক মিয়া চোখের জল লুকিয়ে হাসলেন, "আমি তো এখনও সুপারম্যান, দেখবি তোর সব স্বপ্ন পূরণ করব। তুই বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবি, আমাকে কথা দে।"

রাহুল অবাক হয়ে বলল, "তুমি জানলে কিভাবে? আমি তো কখনো বলিনি!"

রফিক মিয়া হেসে বললেন, "বাবারা সব জানে, বাবারা তো সন্তানের হৃদয়ের ভাষা পড়ে।"

দিন দিন রফিক মিয়ার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। একদিন রাতে রাহুল ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি কষ্টভরা চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল—ছেলেকে ছেড়ে কীভাবে চলে যাবেন? কিন্তু বিধির বিধান তো আর বদলানোর শক্তি কারও নেই।

পরের দিন সকালে রাহুল ঘুম থেকে উঠে দেখল, তার বাবা চিরতরে ঘুমিয়ে গেছেন। ঘরের পরিবেশ ভারী হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা এসে রফিক মিয়াকে দাফন করল। রাহুল বোঝেনি যে তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হারিয়ে গেছে। সে শুধু একটানা চিৎকার করছিল, "বাবা, উঠো না! তুমি তো কথা দিয়েছিলে, আমার স্বপ্ন পূরণ করবে!"

বাবা তার কথা রাখেননি, কিন্তু তিনি রেখে গেছেন একটি উপহার। মৃত্যুর আগে তিনি একজন প্রতিবেশীর কাছে একটি খাম দিয়ে বলেছিলেন, "আমি মারা গেলে এটা রাহুলকে দিও।" খামের ভেতর ছিল এক চিঠি আর সামান্য কিছু টাকা।

চিঠিতে লেখা ছিল:
"প্রিয় রাহুল,
যখন তুই এই চিঠি পড়বি, আমি তোর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাব। কিন্তু মনে রাখিস, আমি সবসময় তোর কাছেই আছি, তোর হৃদয়ে। তুই ইঞ্জিনিয়ার হবি, তুই বড় মানুষ হবি—এই স্বপ্ন আমি প্রতিদিন দেখতাম। হয়তো আমার জীবন তোর স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াত, তাই আল্লাহ আমাকে আগে নিয়ে গেলেন।

এই টাকাগুলো খুব অল্প, কিন্তু তুই এটা দিয়ে বই কিনবি। যত কষ্টই হোক, তুই পড়াশোনা চালিয়ে যাস। মনে রাখিস, তুই বড় হলে আমি ওপার থেকে হাসিমুখে দেখব।

তোর বাবা,
রফিক মিয়া"

চিঠির অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে যায় রাহুলের অশ্রুতে। তার মনে হতে লাগল, বাবা যেন এখনও তার পাশে আছেন। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, "বাবা, তুমি কেন চলে গেলে? তুমি কথা দিয়েছিলে, তুমি আমার স্বপ্ন পূরণ করবে!"

বাবা কথা রেখেছেন, রেখে গেছেন শেষ উপহার। রেখে গেছেন একটি স্বপ্ন, যা রাহুলকে বাঁচিয়ে রাখবে।

Comments

    Please login to post comment. Login