অধ্যায় ১: আগমন
রাত তখন প্রায় ১১টা। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে ছোট্ট গ্রাম কৃষ্ণপুর। এক সময়কার প্রাণবন্ত গ্রামটি এখন যেন এক মৃত জনপদ। মানুষের গলা শোনাই ভার। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমেল বাতাস বইতে থাকে। দূরে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি, যার জানালাগুলো ভাঙ্গাচোরা। হঠাৎ, সেই বাড়ির একটা জানালায় ধোঁয়াটে ছায়া নড়ে ওঠে। সে রাতে রুহান নামের এক যুবক প্রথমবারের মতো কৃষ্ণপুরে আসে। কাজের খোঁজে সে এসেছিল, কিন্তু এই নির্জনতা দেখে তার মন কেমন যেন ছমছম করে ওঠে। গ্রামের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ মাধব কাকা তাকে থামিয়ে বলে, — “এই বাড়িতে উঠতে যাচ্ছ? বাছা, ফিরে যা! ওখানে মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই!” রুহান হেসে বলে, “ওসব ভূতের গল্প আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না, কাকা!” কিন্তু সে জানত না, এই বাড়ির অন্ধকার কোণগুলো এক ভয়ানক অভিশাপের সাক্ষী।
অধ্যায় ২: ছায়ার অস্তিত্ব
পুরনো বাড়িটা ধূলিময় আর স্যাঁতসেঁতে। দরজাটা খুলতেই একটা তীব্র পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগে। বিদ্যুৎ ছিল না, তাই মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ঘরটা দেখে রুহান। বাড়ির ভেতর বেশ বড় একটা হলঘর। দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো বিবর্ণ কিছু ছবি ঝুলছে। একেকটার দিকে তাকালেই মনে হয়, যেন ছবির মানুষগুলো তাকিয়েই আছে! রুহান একটা ঘর পছন্দ করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। ঘরের কোণ থেকে আস্তে আস্তে ফিসফিস আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। — “রুহা-аннн…!” সে চমকে উঠে তাকায়। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ করেই মনে হয়, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই কিছুই দেখা যায় না। “ভ্রম হচ্ছে নিশ্চয়ই,” নিজেকে শান্ত করে সে আবার শুয়ে পড়ে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই এক ঠান্ডা নিঃশ্বাস অনুভব করে তার গলার কাছে!
অধ্যায় ৩: অতীতের অভিশাপ
সকালে ঘুম ভেঙে রুহান বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। গ্রামের কিছু মানুষের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করে, কিন্তু সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অবশেষে এক বৃদ্ধা, কমলা দাদি, নিচু স্বরে বলে, — “ছেলে, তুমি যে বাড়িটায় উঠেছ, জানো ওখানে কী হয়েছে?” — “কী হয়েছে?” — “এই বাড়ির মালিক ছিল রাজেন চৌধুরী। অনেক বছর আগে এক মেয়ে তার সাথে কাজ করত, নীলা। লোকমুখে শোনা যায়, রাজেন বাবু নীলার সাথে অন্যায় করেছিলেন, আর সে অপমানে নীলা গলায় দড়ি দেয়। তারপর থেকে তার ছায়া এই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। যে এ বাড়িতে আসে, সে আর বেঁচে থাকে না!” রুহানের মুখ শুকিয়ে যায়। — “আপনি মজা করছেন তো?” — “বিশ্বাস না হলে আজ রাতে তাকিয়ে দেখো জানালার দিকে। ও এখনও আসে…” রুহান আতঙ্কিত হলেও নিজেকে বোঝায়, এসব কুসংস্কার। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
অধ্যায় ৪: জানালার ছায়া
রাত ঘনিয়ে আসে। হিমশীতল বাতাস বইতে থাকে। রুহান ঠিক করে, জানালার দিকে তাকিয়ে দেখবে কমলা দাদির কথাটা সত্যি কিনা। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ২টা ছুঁই ছুঁই। জানালার কাচ ঘামে ঢাকা। বাইরে ঠান্ডা অথচ কেমন একটা ভারী পরিবেশ। হঠাৎ— একটা ছায়ামূর্তি জানালার ওপাশে! রুহান শ্বাস আটকে তাকিয়ে থাকে। ছায়াটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। একটা মেয়ে, লম্বা চুল তার মুখ ঢেকে রেখেছে। পোশাক ছেঁড়াফাটা। চোখের ভিতর গভীর অন্ধকার। — “রু-হা-আ-আ-আন…” আওয়াজটা একবারে স্পষ্ট। রুহান চিৎকার করে ওঠে!
অধ্যায় ৫: মুক্তির উপায়
পরদিন সকালে রুহান আর দেরি না করে মাধব কাকার কাছে যায়। — “কাকা, আমাকে সাহায্য করুন! আমি ভুল করেছি!” মাধব কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, — “ওর মুক্তি ছাড়া তুইও মুক্তি পাবি না। তোর ওপর ওর নজর পড়েছে।” — “কিন্তু কী করব?” — “ওর আত্মা এখান থেকে মুক্তি চায়। সেই অভিশপ্ত রাতে যা ঘটেছিল, তার শেষ করলেই ও শান্তি পাবে।” রুহান এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সে বাড়িতে ফিরে যায়, কিন্তু জানে না, আজ রাতেই তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে…
অধ্যায় ৬: শেষের শুরু রাত নেমে আসে।
রুহান একাই বাড়ির মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে। সে জানে, আজ যদি সে সত্যিটা জানতে না পারে, তবে হয়তো বাঁচতে পারবে না। রাত ৩টা। বাতাস থেমে গেছে। অদ্ভুত নীরবতা ঘরজুড়ে। আবার সেই ছায়া, এবার ঘরের ভেতরে! নীলার আত্মা সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। — “আমার বিচার করো…” রুহান কেঁপে ওঠে, কিন্তু নিজেকে শক্ত করে সে বলে, — “আমি তোমাকে মুক্তি দেব।”
অধ্যায় ৭: অভিশাপের অবসান রুহান কমলা দাদি আর মাধব কাকাকে ডেকে আনে। সবাই মিলে নীলার জন্য পুজো দেয়, তার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। ধীরে ধীরে বাতাস ভারী হতে থাকে। হঠাৎ, এক বিকট চিৎকার! নীলার আত্মা আলোয় মিশে যায়। জানালার কাচ কাঁপতে থাকে, বাতাসে এক শেষ বিদায়ের গন্ধ ভেসে ওঠে। রুহান হাফ ছেড়ে বাঁচে। কৃষ্ণপুরের অভিশপ্ত রাত শেষ হয়। গ্রামের মানুষদের মনে বিশ্বাস জন্মায়, অবশেষে ছায়ার অভিশাপ শেষ হয়েছে। (শেষ)