Posts

প্রবন্ধ

নিরাপদ সড়ক কত দূরে

February 22, 2025

সাজিদ রহমান

120
View

‘ট্রাকের ধাক্কায় বিধ্বস্ত ইজিবাইক, চালকসহ ৩ জন নিহত, আহত ১৩।‘ পত্রিকায় কিংবা টিভিতে চোখ রাখলে এরকম খবর নিয়মিত দেখতে পাই। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিত্য নৈমত্তিক বিষয়। ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু হয় (সুত্রঃ বিআরটিএ)। বেশ কয়েক বছর ধরে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থায় এক নতুন আপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিকশা। জাতিসংঘ প্রণীত এসডিজির যে লক্ষমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০% কমিয়ে আনতে হবে। সেটা অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাসড়কে ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিকশার অবাধ চলাচল। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এর হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২-৩% কমে যায়। যার ন্যূনতম আর্থিক মূল্য ৬০ হাজার কোটি টাকা। কোন সংসারের খরচ যদি ১০০ টাকার পরিবর্তে ৮০ টাকায় হয়ে যায়, ঐ ২০ টাকাকে সংসারের বাড়তি আয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারলে সেটা পূরা জাতির জন্য বাড়তি আয় হিসেবে গণ্য হবে। দেখা গেছে, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সবচেয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং একটি দুর্ঘটনা সেই পরিবারকে সারা জীবনের জন্য আর্থিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে।

সড়ক-মহাসড়ককে হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইনের সাথে তুলনা করা হয়। হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক লাইনে অসাবধানবশত কেউ হাত দিলে যেমন মৃত্যু অবধারিত, মহাসড়কে সতর্কতার সাথে চলাচল না করলেও একই পরিণতি হতে পারে। সারা দুনিয়ায় যে কেউ মহাসড়কে পা রাখতে গেলে অনেক নিয়ম কানুনের বেড়াজাল পার হতে হয়। শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স নয়, সড়কের সাইন সিগনাল,গতিসীমা, লেন পরিবর্তন, নির্ধারিত স্থানে গাড়ি দাড় করানোসহ বহুবিধ নিয়মের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’র মত একজন ইজিবাইক কিংবা ব্যাটারি চালিত রিকশা কিনেই মহাসড়কে নেমে পড়ছে। দুই দিন আগেও হয়ত সে জমিতে কামলা দিত। মহাসড়কে নেমে সেটাকে তার কাজের ক্ষেত খামার ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়।  

ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বেকারত্বের হার বেড়ে চলেছে। আপাতদৃষ্টিতে সড়ক মহাসড়কে অবাধে ইজিবাইক চলাচল বেকারত্বের হার কমাচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবো, ইজিবাইক কিংবা ব্যাটারি চালিত রিকশা চালানো একটি অনুৎপাদনশীল খাত। একজন শ্রমিক বিস্কুটের কারখানায় কাজ করলে বিস্কুট তৈরিতে ভূমিকা রাখে, ইজিবাইক/রিকশা চালালে সেটা হয় না। একটি বাসে অনায়াসে ৪০/৫০ জন যাত্রী যেতে পারে, এর বিপরীতে ২ জন ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সড়কে বের হলে দেখতে পাই, প্রতিটি ইজিবাইকে এক বা দুই জন যাত্রী নিয়ে চলছে। সেই অর্থে এটাকে গরীবের প্রাইভেট কারও বলা যায়। মহাসড়কে এদের অবাধ চলাচলের ফলে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, এমনকি মোটরসাইকেলের সাথে সঙ্ঘর্সে হতাহতের পরিমাণ দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। আমাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েই বলছি, এই ইজিবাইক বা ব্যাটারি চালিত রিকশা গণপরিবহন ব্যবস্থার সাথেও সঙ্গতিপূর্ন নয়। 

বেশ কয়েক বছর আগে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের (Accident Research Institution) একটি গবেষণায় দেখা যায়, যানবাহনের অধিক গতি, ঝুকিপুর্ন ওভারটেকিং এবং ড্রাইভারের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ৯০% সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই গবেষণা করার সময়ে সড়ক মহাসড়কে ইজিবাইকের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। বর্তমানে ইজিবাইকের সরব উপস্থিতি এই হারকে নিশ্চিতভাবে ছাড়িয়ে গেছে। শুরুতে মহাসড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। একটি নির্দিস্ট মেয়াদ পর্যন্ত শহরে নির্ধারিত রুটে ও গ্রামীণ ফিডার সড়কে ইজিবাইক চালানোর অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে পর্যায়ক্রমে এর উৎপাদন, আমদানির সুযোগ কমিয়ে আনতে হবে। এই খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্যও বিশেষ নজর দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে গণপরিবহন ব্যবস্থা বা বাস চলাচলের রুট বাড়াতে হবে। ইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত রিকশার ধ্বংসাবশেষ পরিবেশের জন্যেও যথেষ্ট ঝূকিপূর্ন।   

  

দেরিতে হলেও সড়কে শৃংখলা ও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার সড়ক পরিবহন আইন ২০১৭ ও মহাসড়ক আইন ২০২১ প্রণয়ন করেছে। সড়কে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতে ও দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে আইন দুইটির বাস্তবায়ন খুব জরুরী। জাতিসংঘের এসডিজি প্রোগ্রামে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে ৫টি পিলারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো, নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা (Road Safety Management), সড়ক অবকাঠামোগত উন্নয়ন (Infrastructure), নিরাপদ যানবাহন (Safe Vehicle), সড়ক ব্যবহারকারীদের মনোভাবের পরিবর্তন (Road User Behaviour) এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা (Post Crash Care)। এই ৫টি পিলার থেকে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে আমাদের করনীয় সম্পর্কেও একটি স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। উক্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে বিশ্বব্যাংক ও জিওবির অর্থায়নে সরকার তথা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ‘বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প’ শীর্সক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। উক্ত প্রকল্প হতে জাতীয় মহাসড়ক এন-৪ (ঢাকা-টাঙ্গাইল), এন-৬ (হাটিকুমরুল-রাজশাহী), রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ ও খুলনা সড়ক জোনের আওতায় বিভিন্ন জেলায় ৫১৪ কিলোমিটার সড়ক নিরাপত্তা সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় হাইওয়ে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মান, দুর্ঘটনা তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলা, আধুনিক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টসহ দুর্ঘটনা পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। 

‘চাচা ঢাকা কতদূর? ঐ দেখা যায় সদর ঘাট, সামনে নবাবপুর’। বাংলা সিনেমার এই ডায়লগ এক সময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। কিন্তু সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে এনে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সহজ কাজ নয়। সেটা বহু দূরের পথ, ফার ওয়ে টু গো। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সবাই মিলে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে সেটা অর্জন অসম্ভব নয়।              

Comments

    Please login to post comment. Login