ময়নাপুর নামে একটি ছোট গ্রাম ছিল নদীর তীরে। নদীটা ছিল গ্রামের জীবন। মাছ ধরা, চাষবাস, এমনকি গ্রামের গল্পগুলোও নদীকে ঘিরে। কিন্তু নদীর ওপারে একটা পুরোনো জঙ্গল ছিল, যেখানে কেউ যেত না। গ্রামের বুড়োরা বলত, ওখানে কিছু একটা আছে—কেউ বলত ভূত, কেউ বলত অভিশাপ।
গ্রামে থাকত রাহুল, একজন কৌতূহলী ছেলে। তার বয়স ছিল মাত্র আঠারো, কিন্তু তার মনে ছিল অদম্য সাহস। সে প্রায়ই নদীর ধারে বসে ওপারের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ভাবত, "ওখানে আসলেই কী আছে?" একদিন রাতে, যখন গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছিল, রাহুল একটা ছোট নৌকা নিয়ে নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
নৌকা থেকে নেমে রাহুল পা রাখল জঙ্গলের মাটিতে। চাঁদের আলো ছিল ক্ষীণ, আর গাছের ডালপালা সব আলো গিলে খাচ্ছিল। হঠাৎ সে একটা শব্দ শুনল—ঝুপঝুপ, যেন কেউ পড়ে যাওয়া পাতা মাড়াচ্ছে। রাহুল থমকে দাঁড়াল। তার হাতে ছিল একটা ছোট টর্চ। আলো ফেলতেই দেখল, একটা পুরোনো পাথরের মূর্তি। মূর্তিটা ছিল অদ্ভুত—একটা মানুষের মতো, কিন্তু তার মুখ ছিল অর্ধেক ভাঙা।
রাহুল কাছে গিয়ে দেখল, মূর্তির পায়ের কাছে একটা ছোট বাক্স। সে বাক্সটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা পুরোনো চিঠি বেরোল। চিঠিতে লেখা ছিল:
"যে এই জঙ্গলে আসবে, সে আমার রহস্য খুঁজে পাবে। কিন্তু সাবধান, এখানে সময় থেমে আছে।"
লেখাটা পড়ে রাহুলের গায়ে কাঁটা দিল। কিন্তু তার কৌতূহল তাকে থামতে দিল না। সে আরও গভীরে গেল।
জঙ্গলের মাঝে একটা পুরোনো বাড়ি ছিল। দরজা-জানালা ভাঙা, দেয়ালে শ্যাওলা। রাহুল ভেতরে ঢুকল। ঘরের মাঝে একটা বড় আয়না ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই রাহুল দেখল, তার প্রতিবিম্ব নেই! হঠাৎ আয়না থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল:
"তুমি এসেছ কেন?"
রাহুল ভয় পেলেও বলল, "আমি জানতে চাই এখানে কী লুকিয়ে আছে।"
কণ্ঠটা হেসে বলল, "আমি এই জঙ্গলের রক্ষক। অনেক বছর আগে এখানে একটা গ্রাম ছিল। তারা আমাকে ভুলে গিয়েছিল, আর আমি তাদের সময় বন্দি করে দিয়েছি। তুমি যদি আমার নাম বলতে পারো, আমি এই অভিশাপ মুক্ত করব।"
রাহুল ভাবতে লাগল। চিঠির কথা মনে পড়ল। সে জিজ্ঞেস করল, "তোমার নাম কি কালিন্দী?"—নদীর নাম থেকে অনুমান করে।
কণ্ঠটা চুপ করে গেল। তারপর আয়না থেকে আলো বেরিয়ে জঙ্গলটা সোনালি হয়ে উঠল। একটা মেয়ে বেরিয়ে এল, বলল, "তুমি আমাকে মুক্ত করেছ। আমি কালিন্দী, এই নদীর দেবী।"
কালিন্দী রাহুলকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, "তোমার সাহসের জন্য এই গ্রাম আবার জেগে উঠবে।" রাহুল ফিরে এল গ্রামে। সকাল হতেই দেখা গেল, নদীর ওপারের জঙ্গল আর নেই—সেখানে ফুলের মাঠ আর একটা নতুন গ্রাম গড়ে উঠেছে। গ্রামের লোকেরা রাহুলকে নায়ক ভাবল, কিন্তু সে শুধু হাসল। তার মনে রইল কালিন্দীর কথা আর সেই রাতের রহস্য।