বাবার হোটেলে বিনে পয়সায় ফ্রি ফ্রি খাওয়ার দিন শেষ। বাবার কোটি টাকা আছে, সন্তান গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। এমনকি বাপের টাকায় বিয়ে শাদি করে বাচ্চা পর্যন্ত পয়দা হয়ে যাচ্ছে। সেই দিন আর বেশি দিন নাই। শহরে গ্রামে এখন এরকমই দিন বদলের হাওয়া বইছে।
আর পশ্চিমের দুনিয়ায় সেই লু হাওয়া বহু আগে থেকে বইছে। স্কুল পাশ দিয়েই ওরা পড়াশোনার পাশে কাজে লেগে যায়। কেউ বার্গার কিং, কেএফসি, এম&এম এর মত খাবারের দোকানে, কেউবা জাস্টিন বুটস, লুচিসের মত ফ্যাশন আইকনের শোরুমে। শুধু নামি ব্রান্ডে নয়, পার্ট টাইম কাজের সুযোগ আছে প্রায় সকল শহরে, শহরতলীতে, স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে। সেখানে কাজ করে, পয়সা কামানোর মর্ম বোঝে। টাকা জমায়, সেই টাকায় দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায়।
সেটার বিপরীতে আমাদের চালু সংস্কৃতি যথেষ্ট মানবিক কিন্তু পরের প্রজন্মকে দুই পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে এক রকম বাধা হিসেবে কাজ করে। আমরা যখন ভার্সিটিতে পড়ি তখন দেখেছি ছেলে/মেয়েকে বাবা মায়েরা গেট পর্যন্ত দিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা নিজেরা ভার্সিটির ফর্ম কিনে, পরীক্ষা দিয়ে, ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করে দিয়েছি। ভার্সিটিকে আমরা নিজে নিজে বরণ করে নিয়েছি, সেই অর্থে আমরা স্বয়ংবরা। আর ওরা গ্রহণ করেছে বাপমায়ের পছন্দে। সেই দিন এখনও আছে কিনা জানা নেই।
বাপের হোটেল যখন উঠে যায় যায় অবস্থা, তখন চালু হয়েছে চাচার হোটেল। আমাদের যেহেতু বাপের হোটেল নেই (বাপ দুনিয়াতেই নেই, হোটেলও নাই), হাজির হই চাচার হোটেলে। দিন দুয়েক আগের ঘটনা।

চাচার হোটেল রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার চৌধুরানী বাজার সংলগ্ন বকসি বাজারে অবস্থিত। দুপুর বেলা সাইটে সাইটে কাজ কর্ম দেখে খাওয়ার সময় হয়ে গেলে চাচার হোটেলে যাওয়া মনস্থির করি। এই আমার প্রথম চাচার হোটেলে যাওয়া। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। গিয়েই চাচার হোটেলের মকবুল চাচাকে পেয়ে যাই। তখন তিনি একটা ইন্টার্ভিউ দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে চাচা ভাইরাল। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসে। চাচার সাথে কথা বলে।
হাজার টাকা খরচ করে দুইশ টাকার ভাত খায়।এ যেন চাচার প্রতি ভালোবাসার বিশেষ নমুনা। আমরাও খাই। শুধু ভাত নয়, ছিল পোলাও। সাথে ৭/৮ রকমের ভর্তা, সবজি এবং হাসের মাংস। এর বাইরেও আছে ভাত আর ডাল। সর্বসাকুল্যে বিল ২০০ টাকা। এবার একটু অবাক লাগে। রংপুর শহরেও শুধু ভর্তা সবজির দাম পড়বে প্রায় ২০০ টাকা। খাবার নিজের বাড়ির মতই, বেশ সুস্বাদুও।
চাচাকে কাছে ডাকলাম। জানতে চাইলাম, এত কমদামে কেন খাওয়াচ্ছেন। তিনি জানালেন, এই ব্যবসা থেকে লাভ ওনারা ঘরে নিয়ে যান না। লাভ যা হয় সপ্তাহে একদিন বিনে পয়সায় গরীব মিসকিনদের খাইয়ে দেন। লাভের মধ্যে ওনারা নিজেরা (বুড়াবুড়ি) খান। আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার যে সামাজিক ব্যবসার কনসেপ্ট সেটার সাথে খুব মিলে যায়। হিসেব করে দেখলাম, চাচা সত্যিকার অর্থে সামাজিক ব্যবসা চালু রেখেছেন। মকবুল চাচা নিশ্চয় সেই থিউরি জানেন না, কিন্তু অবলীলায় সেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রায় দেড় যুগ ধরে।
চাচার হোটেলের শুরুর শুনে চমৎকৃত হলাম।কল্লোল লাহিড়ীর 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল' এর গল্প অনেকেই জানি। ক্ষুধায় জর্জরিত অসহায় ইন্দুবালা চলতি পথের ট্রাক ড্রাইভারদের অনুরোধে তাদের জন্য রান্না করে দিয়ে কাজ শুরু করেন। চাচার গল্পের সাথে ইন্দুবালার গল্পের অনেক খানি মিল। বড় লেখকদের অনেক গুন, তাদের কল্পনা অনেক বাস্তব ঘটনার সাথে মিলে যায়।

ফিরে আসার সময় মনে হল, এরকম চাচার হোটেল হাজার হাজার গড়ে উঠুক। চাচার হোটেল মানবিক চাচার হোটেল নামে পরিচিত হোক।