মধ্যরাত্রি। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে গাড়ির হর্ন আর মানুষের পদচারণায় দমবন্ধ অবস্থা। কিন্তু এক প্রান্তে, পুরনো একটি বিল্ডিং—একটি অন্ধকার নীরবতা—খুবই ভিন্ন। শহরের সব কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল সেটি। কেউ আর সেখানে ভাড়া নিতে চাইত না, কারণ সবার বিশ্বাস ছিল—এই বিল্ডিংয়ের ভিতরে কিছু অজানা, কিছু ভয়ঙ্কর রহস্য রয়েছে।
অয়ন, একজন তরুণ প্রযুক্তিবিদ, শহরের ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানিতে কাজ করত। তার দিনগুলো একঘেয়েমি হয়ে উঠেছিল, সারাদিন একের পর এক কোডে ডুবে থাকা আর সন্ধ্যায় সঙ্গী হিসেবে তার ল্যাপটপ। একদিন, সে সিদ্ধান্ত নিল, এই রহস্যময় বিল্ডিংটিকে ঘিরে আর্টিকেল লিখবে। সে জানত, এটি কিছুটা ভুতুড়ে হতে পারে, কিন্তু তার মনস্থির ছিল। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সে প্রতিটি রহস্যের উন্মোচন করতে চায়।
তাহলে, এক রাত, অয়ন তার ক্যামেরা, স্মার্টফোন এবং ড্রোন নিয়ে পুরনো বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তার ফোনের স্ক্রীনে আলো জ্বলছিল, ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন সক্রিয় ছিল। ভিতরে প্রবেশ করতেই, অয়ন কিছু অদ্ভুত অনুভূতি পেল। পুরনো কাঠের মেঝে, ছেঁড়া কুশন, আর অদ্ভুতভাবে মাখানো ধোঁয়ার গন্ধ—সব কিছুই জানিয়ে দিচ্ছিল যে এখানে দীর্ঘদিন ধরে কেউ ছিল না।
হঠাৎ, তার ফোনের স্ক্রীনে কিছু অস্বাভাবিক ছবি আর ধ্বনি উঠতে শুরু করল। মৃদু সুর বাজতে লাগল, আর তারপর তার সামনে একটি ছায়া ফুটে উঠল। এটি কোনও ভৌতিক উপস্থিতি নয়, বরং এক ধোঁয়াশা—এক তরুণী। তার শরীরের আশপাশে সাদা আলোর আভা ছিল, এবং তার মুখ ছিল অন্ধকারে ঢাকা। তরুণীটি অবধি কিছু বলল না, শুধু তার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। অয়ন কিছু না বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
"তুমি কি আমাকে মুক্তি দিতে পার?" – হঠাৎ, তরুণীটির কণ্ঠ ভাঙল।
অয়ন খুব অবাক হয়ে গেল, কারণ সে কোন ভুত-প্রেত দেখতে আসেনি। কিন্তু তার ভেতর এমন কিছু ছিল যা তাকে থামতে দিচ্ছিল না।
তরুণীটি বলল, "এ বাড়ির মধ্যে আটকে আছি। আমি এখানে ছিলাম, বহু বছর আগে। এক সফটওয়্যার প্রকল্পে কাজ করতে এসে এমন কিছু ঘটেছিল যা আমি বুঝতে পারিনি। আমার আত্মা এখন এখানে বন্দি, আমি মুক্তি চাই।"
অয়ন তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল, এটি কোনও অতিপ্রাকৃত ঘটনা নয়। এটি ছিল একজন মানুষের আত্মা, যার জীবনে কিছু অপ্রকাশিত রহস্য ছিল। তরুণীটি তার ডেভেলপার জীবন নিয়ে তার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এই বাড়িতে আটকে পড়েছিল।
তবে তার মুক্তির জন্য অয়নকে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে—তাকে ওই তরুণীর হারানো কোডগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে, যা বিল্ডিংয়ের পুরনো সার্ভারে লুকানো ছিল। "তোমাকে কোডগুলি খুঁজে বের করতে হবে," তরুণীটি বলল। "তবে সময় কম, যদি না পারো, আমি চিরকাল এখানেই আটকে থাকব।"
অয়ন বুঝতে পারল, এই কোডগুলি না পেলে তরুণী মুক্তি পাবে না। সে তার ফোনের স্ক্রীনে বিভিন্ন পুরনো ডাটাবেসের দিকে নজর দিল। একটার পর একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত কোডস্নিপেট সামনে এলো, কিন্তু কিছুতেই পূর্ণ কোড পায়নি। সে প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু হঠাৎ, একটি পুরনো সিস্টেমে ইনপুট করা ফাইল খুঁজে পেল—একটি সফটওয়্যার ফাইল যা এত বছর ধরে লুকানো ছিল।
অয়ন সেই কোডটি ইনপুট করল এবং মুহূর্তের মধ্যে একটি আশ্চর্যজনক পরিবর্তন ঘটল। বিল্ডিংয়ের চারপাশে আলোর ঝলকানি শুরু হল, আর তরুণীটির উপস্থিতি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল। তার মুখে এক সুখী হাসি ফুটে উঠল, এবং সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পুরনো বিল্ডিংটি তখন শান্ত হয়ে গেল, যেন অনেক বছরের চাপ একেবারে মুক্ত হয়ে গিয়েছে। অয়ন যেন এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অর্জন করে এল। গ্রামে ফিরে এসে সে আর্টিকেল লিখে সবাইকে জানাল। তবে, একদিনও সে সেই বিল্ডিংয়ের দিকে ফিরে তাকাল না। তার মনে হয়েছিল, কিছু কিছু রহস্য এমনিতেই চিরকাল রহস্যই রয়ে যায়।