দিন শেষে প্রতিদিন অন্ধকার নামে। ভোরের সুর্য উঁকি দিলে আলোয় ভরে উঠে চারদিক। দুনিয়ার এই নিয়ম।
অন্ধকারের অনেক রকম ভেদ আছে। আমিনুল ইসলাম সেই অন্য রকম অন্ধকারের গল্প বলেছেন তাঁর ‘নীলি-নীলিমা’ উপন্যাসে। জ্ঞানে-গরিমায়, আদর্শে-নেতৃত্বে কিংবা সংগ্রামে বাতিঘরের ভূমিকায় থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আমিনুল ইসলাম গল্পটা শুরু করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই, সব অর্থেই যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। নীলি-নীলিমার অন্ধকারের গল্পটা শুরু হয়েছে সেই ক্যাম্পাস থেকেই।
নীলিমা নামের একটি মেয়ে ক্যাম্পাসের কিছু ছেলেদের অত্যাচারে অতিস্ট হয়ে শিক্ষকদের কাছে বিচার দিতে গিয়ে ধাক্কা খায় এমন এক বেড়ার, যে বেড়া নিজেই ক্ষেতের ফসল সাবাড় করতে উদ্যত থাকে। রক্ষকই সেখানে সবচেয়ে বড় ভক্ষক।
এরপর লেখক তাঁর গল্পের মোড় ঘোরাতে থাকেন। গল্পের বাঁকে বাঁকে আমরা দেখতে পারি, সমাজের প্রতিটি কোনায় কানায় সেই অন্ধকার, জমাটবদ্ধ হয়ে আছে। আছে বঞ্চনার দীর্ঘ হাহাকার। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে নীলিমাকে কখনও কখনও সাতকাহনের দীপাবলির বর্ধিত রূপ মনে হচ্ছিলো। একটা নারী প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে সমসাময়িক সমস্যাগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। যদিও গল্পটা ভিন্ন, শুধু সংগ্রামের গল্পের মিলের জন্য তুলনা চলে আসলো।
লেখক সম্ভবত এই গল্পে ইচ্ছে করেই অনেক অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রায় সামাজিক প্লটের এই গল্পে সড়ক দুর্ঘটনায় নীলিমার বাবা মায়ের মৃত্যু, মামা-মামিসহ মামাতো বোনের আগুনে পুড়ে ভস্ম হওয়া, অপচিকিৎসায় নিজের সন্তানের জীবনাবসান, আজীবন ভিতু স্বামী রাশেদের আন্দোলনে গিয়ে মৃত্যু, এ সকল কিছুকে একই সূতায় গেঁথেছেন। গল্পকে পাঠকের কাছে অধিক হৃদয়গ্রাহী করার জন্য অনেকগুলো চরিত্রের মৃত্যু সামাজিক এই গল্পের প্রেক্ষাপটে বেশি নাটকীয় মনে হয়েছে। লেখক এ বিষয়ে আরও অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে পারতেন। তবে এটাও ঠিক, এটা এমন এক দেশ, মৃত্যু যেখানে খুব সহজ, মৃত্যু ব্যতিত অন্য আঘাত পাঠককে খুব বেশি নাড়া দিতে পারত বলে মনে হয় না।
প্রধান চরিত্র নীলিমার পর দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র মনে হয়েছে গল্পের কাহিনী যেখানে গড়ে উঠেছে, সেই নাখালপাড়াকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাতে আমরা জানি, লেখক এখানে বেড়ে উঠেছেন। এই গল্পে তিনি সেই বেড়ে ওঠার, ভালো লাগার বিষয়কে অন্য অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে সম্ভবত নাখালপাড়ার গল্প বলে সেটার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। যাদের নাখালপাড়ায় সংযোগ আছে, তাদের কাছে এটি বিশেষ ভালো লাগা কাজ করবে। তবে হ্যাঁ, এই গল্পকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য কাল্পনিক এলাকার নাম অতটা যুতসই হতোনা।
লেখককে ধন্যবাদ দিতে চাই। পশ্চিমের একটি আধুনিক রাষ্ট্রে বসবাস লেখককে আত্মতুষ্টি দেয়নি। বরং সেখানে বসে দেশমাতৃকার কথা ভেবে ভেবে অহর্নিশ পুড়ছেন। সেই পোড়াগন্ধের অনুভূতি থেকেই জন্ম নিয়েছে নীলি-নীলিমার মত একটি উপন্যাস। যে গল্প পাঠককে ছুঁয়ে যাবে, সমাজের বিদ্যমান অন্ধকার সম্পর্কে জানান দিবে, সেই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার তাগিদ তৈরি করবে। পাঠকের মধ্যে একটি মানবিক বোধ তৈরি করে দিবে, যে বোধ আমাদের খুব দরকার।
নীলি-নীলিমার মাধ্যমে সেই বোধ তৈরির আপ্রাণ চেষ্টার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই।