Posts

গল্প

গার্জ-এ-তামান্না

March 8, 2025

সায়হাম রহমান শান্ত

Original Author সায়হাম রহমান শান্ত

18
View

১৫ই জুলাই,২০২৪। বিকেল ছয়টা বেজে আঠাশ মিনিট। আজকের আকাশটা বেশ অদ্ভুত রকমের রঙ ধারণ করে আছে। এমন আকাশ সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। শাহানা নিজেও তার এই বত্রিশ বছরের জীবনে কখনো এমন আকাশ দেখেনি। তাইতো নিজের দশ বছরের ছেলে শাওনের একবার অনুরোধের পরই রাজি হয়ে গেলেন ছাদে আসার জন্যে।অন্য কোনোদিন হলে হয়তো শাওনের আরো দশবার অনুরোধ করার পর।শাহানা ছাদে আসার জন্যে সম্মতি প্রদান করতেন। কারণ শাহানার দৃঢ় বিশ্বাস, ছোট বাচ্চাদের আবদার যদি তাদের প্রথম অনুরোধেই অভিভাবকরা মেনে নেন তাহলে তারা নষ্ট হয়ে যায়। আজকের ব্যাপারটা খানিকটা অন্যরকম। জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে নিজেকে আর ঘরের কোণে আটকে রাখতে পারলেন না শাহানা।মা-ছেলে স্থির হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আকাশ দেখছেন। ছোট্টো শাওন হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ শাহানা সেটা লক্ষ্য করে ছেলের মুখ হাত দিয়ে আলতোভাবে বন্ধ করে দেয়, আর মুচকি হেসে বলে,"এভাবে হা করে থাকলে তোমার মুখে তো কাক পটি করে দেবে বাবা!" ছোট্টো শাওন অভিমান করে মায়ের থেকে দূরে সরে যেতে চায়।শাহানা তা হতে দেয় না। শাওনকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে। শাওনেরও অভিমান ভেঙে সুখের নদী বয়ে যেতে থাকে মনে। সেও মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে থাকে। হঠাৎই শাহানার ফোনে জামিল সাহেবের একটা কল আসলো।

— হ্যালো,শাহানা?

— জ্বী,বলেন।আপনি ঠিক আছেন? দুপুরে খেয়েছিলেন?

— হ্যাঁ,হ্যাঁ। তুমি আর শাওন খেয়েছো?নকি করছো?

— জ্বী। আমরা একটু ছাদে আসলাম ঘুরতে।

— আচ্ছা শোনো,তুমি আর শাওন ফ্ল্যাটে চলে যাও। আর ফেসবুকে যদি কিছু দেখো তাহলে কিছু লেখার দরকার নেই। কেমন?

— আচ্ছা। আপনি সাবধানে থাকবেন।

— আচ্ছা। লাভ ইউ সো মাচ!

— লাভ ইউ টু!

ফোন কেটে গেলো। জামিল সাহেব শাহানার স্বামী। তাদের বিয়ের পর প্রায় এগারোটি বসন্ত পার হয়েছে। শাওন তাদের একমাত্র ছেলে। জামিল সাহেব ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যাত্রাবাড়ী থানায় এসআই পদে কর্মরত।বিয়ের সময় শাহানা উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করতেন। জামিল সাহেব তখন উনত্রিশে পদার্পন করা এক সুদর্শন যুবক। শাহানার গায়ের রঙ দুধে-আলতা না হলেও চাহনিতে অদ্ভুত এক মায়া রয়েছে। সেই মায়াতেই আটকা পড়েছিলেন জামিল সাহেব। তাই, অন্য কোনো জায়গায় আর পাত্রী দেখতে গিয়ে সময় নষ্ট করেননি। যেদিন শাহানাকে দেখতে এসেছিলেন সেদিনই কাজী ডেকে পারিবারিকভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন।


শাহানা শাওনকে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে গেলেন। ফেসবুকে ঢুকে শাহানার মাথা ঘুরে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ নৃশংস হামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুই করতে পারেনি। ছাত্রীরাও এই হামলা থেকে রক্ষা পান নি। শ'খানেকের মতো আহত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শাহানার হার্টবিট বেড়ে গেল।তার চাচাতো ভাই আবিদও এই আন্দোলনে যুক্ত ছিল। আবিদের কিছু হয়নি তো? শাহানার কোনো আপন ভাই নেই। আবিদ যখন খুব ছোট,তখন তার বাবা-মা দুজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন আবিদ বেঁচে যায়। আবিদের বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। ছোটবেলা থেকেই আবিদ তাদের বাসায় বড় হয়েছে। শাহানার বাবা আবিদকে খুব আদর করতেন। শাহানাও নিজের ছোট ভাইয়ের মতো যত্ন করতেন আবিদকে। আবিদও তার শাহানা আপুর পাগল। জামিল সাহেবও তার শালাকে খুব আদর করতেন। প্রায়ই ফোন করে খোঁজ নিতেন। শাহানার মা অবশ্য আবিদকে খুব একটা সহ্য করতে পারতেন না। একারণেই অনার্সে ঢাকা কলেজে ভর্তি হবার পর ছেলেটাকে হলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শাহানা আর তার বাবা শত অনুরোধ করেও শাহানার মায়ের মন গলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আবিদের নম্বরে অতিদ্রুত কল করলো শাহানা। অপর পাশ থেকে শোনা গেলো,

"আপনি যেই নম্বরে ফোন করেছেন, তাতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন!"

শাহানা চিন্তায় একাকার হয়ে যায়। চোখ তার হয়ে ওঠে জলে টইটম্বুর করতে থাকা কোনো বিল। আরেকটু জল জমলেই যেনো বানের জলে ভেসে যাবে পুরো এলাকা। ছোট্ট শাওন তার মাকে এমন চিন্তিত অবস্থায় এর আগে কখনো দেখেনি। মাকে এমন অবস্থায় দেখে ভয় পেয়ে যায় ছোট্ট শাওন। হঠাৎই নিজের কোলে শাওনের উপস্থিতি অনুভব করে শাহানা।দু'হাত দিয়ে জাপটে ধরে শাওনের নাকে-মুখে অসংখ্য চুমু খেতে থাকে শাহানা। শাওন কিছুটা স্বাভাবিক হয় এবং মাকে চুমু খায়। মায়ের কোল থেকে উঠে পাশের ঘরে খেলতে যায় ছোট্ট শাওন। শাহানা তার স্বামীকে কল করে, আবিদের কথা বলে। জামিল শাহানাকে আশ্বস্ত করে যে, পুলিশ এখন পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। আর আবিদের কিছু হয়নি। তবুও শাহানার মন মানতে চায় না। পাহাড়ের কোল ঘেষে গড়িয়ে পড়া ঝর্ণার মতো গাল বেয়ে কান্নার স্রোত বইতে থাকে শাহানার। চোখ বন্ধ করলেই একে একে মনে পড়তে থাকে আবিদের সাথে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি স্মরণীয় মুহূর্ত।


মাগরিবের আজান হচ্ছে। আজকের আকাশ দেখে মনে হচ্ছে, আন্দোলনে ঝরতে থাকা রক্ত দেখে খোদাও বুঝি আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলেন না।তাই নগ্নভাবে সমগ্র দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরলেন ছেলেপুলেগুলো কিভাবে বেদম মার খাচ্ছে পাওনা বুঝে নেয়ার দাবী তোলায়। একটু পর শাহানার ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসলে সাধারণত রিসিভ করেন না শাহানা। কিন্তু ইতিমধ্যে তার অবস্থা পাগল প্রায়।একপ্রকার অস্থির হয়ে যত দ্রুত সম্ভব কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠল,

— আপু, আমি আবিদের বন্ধু।

— (অস্থির হয়ে) এই, আমার আবিদের কি হয়েছে? ও ঠিক আছে তো?ফোন বন্ধ করে রেখেছে কেন গাধাটা?

— আপু, আবিদ..

— (ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে) কি হয়েছে আবিদের? তুমি কিছু বলছো না কেন?ফোনটা আবিদকে দাও। আজকে ওকে এমন বকা দেব!

— আপু, আবিদ আর নেই।

কথাটা শুনে শাহানার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। শাহানা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল। এই শব্দে ছোট্ট শাওন দৌড়ে অন্য রুম থেকে মায়ের কাছে আসল। মায়ের এই পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে সে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। শাহানা তার শাওনকে জড়িয়ে ধরে, পুনরায় ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,

— (নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে) না,না,না। তুমি মিথ্যা বলছো। আবিদ তোমাকে দিয়ে এই কথা বলাচ্ছে তাই না? আমার সাথে দুষ্টুমি করার জন্যে? ওকে আমি পেয়ে নেই, দাঁড়াও।

— আবিদ আর আপনাকে কখনো আপু বলে ডাকতে পারবেনা, আপু।(কান্নায় ভেঙে পড়ে)


শাহানা এবার আর নিজেকে সামলে নিতে পারল না। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল ছোট্ট শাওনকে জড়িয়ে ধরে। তাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকা ভাড়াটিয়ারা দরজা নক করলে, শাওন তার মায়ের কোল থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তারা শাহানাকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে। শাহানা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করতে থাকে। জামিল সাহেবকে কল করে শাহানা বারংবার জিজ্ঞেস কর‍তে থাকে,

"আর কতজন আবিদকে খাওয়ার পর আপনাদের পেট ভরবে, স্যার?"

Comments