শব্দহীন সংলাপ
নীহারিকার ঘরটায় আজকাল নীরবতাই রাজত্ব করে। একটা ছোট্ট টেবিল, জানালার পাশে একটা চেয়ার, আর খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া গোধূলির কমলা রোদ। সারা ঘর জুড়ে কেমন একটা থমথমে বাতাস।
নীহারিকা চুপচাপ বসে আছে, তার সামনে একটা খাতা খোলা। কলমটা কেবল কাগজের উপর নেচে যায়, শব্দহীনভাবে। পাতা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভাঙাচোরা শব্দ, অসমাপ্ত বাক্য, কখনো বা শুধুই দাগ।
আজ পাঁচদিন হলো, নীলাঞ্জন আর ফোন করে না। শেষবার ওরা দেখা করেছিল পার্কের বেঞ্চে বসে। সে দিনও কথা হয়নি খুব একটা। নীলাঞ্জনের চোখে কেমন একটা শূন্যতা ছিল, যেন সে বহু দূরে চলে গেছে। অথচ নীহারিকার মনে হয়েছিল, ওদের মধ্যকার নীরবতাও একটা ভাষা — অদৃশ্য অথচ স্পষ্ট।
ঘরের কোণে রাখা টেবিল ঘড়িটা টিক টিক করে চলে। নীহারিকা উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ায়। বাইরে আকাশের শেষ আলোটুকু মরে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে যায়, সেই প্রথম দিনের কথা।
নীহারিকার কলেজে প্রথম দিনেই তার পাশে এসে বসেছিল নীলাঞ্জন। কেউ কথা বলছিল না, অথচ মনে হচ্ছিল, একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস শেষে নীলাঞ্জন খাতায় একটা বাক্য লিখে দিয়েছিল —
"কিছু কথা না বললেও শোনা যায়।"
সেই শুরু। ওদের বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম, সবটাই যেন নীরব ভাষায় লেখা হয়েছিল। কথার চেয়ে চোখের ভাষাই ছিল বেশি স্পষ্ট।
নীহারিকা ধীরে ধীরে খাতাটা বন্ধ করে। তার চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে। কিন্তু সে জানে, কান্নাও আজ শব্দহীন।
হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। নীলাঞ্জন! নীহারিকার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেন কানে বাজে। সে ধীরে ধীরে ফোনটা তোলে। ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না। শুধু নিঃশ্বাসের হালকা শব্দ।
নীহারিকা ফিসফিস করে বলে, “তুমি কি কিছু বলবে না?”
ওপাশে অনেকক্ষণ নীরবতা। তারপর, ঠিক যেমনটা ওরা সবসময় করত, নীলাঞ্জন একটা মেসেজ পাঠায় —
"কিছু কথা না বললেও শোনা যায়।"
নীহারিকার চোখ বেয়ে নেমে আসে নীরব জলধারা। সে জানে, এই নীরবতা কখনো শেষ হবে না। কারণ ওদের সংলাপ শব্দের নয়, অনুভূতির।
শেষ।