Posts

প্রবন্ধ

অতীতের আলো

March 14, 2025

Md Imtiaz Alam

135
View

আমরা যা দেখি, যা অনুভব করি, তা মূলত আলোর প্রতিফলনের খেলা। প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি বস্তুর রঙ ও আকার আমাদের চোখে ধরা পড়ে আলোর প্রতিফলনের কারণে। কিন্তু এই আলো আমাদের সামনে আসার আগেই একটি সময় পার করে আসে—যার অর্থ হলো আমরা সবসময় অতীত দেখছি।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের চেতনার প্রতিটি মুহূর্তই অতীতের অংশ। এই ধারণাটি শুধু দার্শনিক নয়, বরং কঠিন বৈজ্ঞানিক সত্যও বটে। আমরা যখন আকাশের তারা দেখি, তখন আসলে আমরা তাদের বর্তমান রূপ দেখছি না। কোনো নক্ষত্রের আলো আমাদের চোখে পৌঁছাতে কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ বছর সময় নেয়। তার মানে, যে তারা আমরা এখন দেখছি, সেটি হয়তো বহু বছর আগেই নিভে গেছে। এই নক্ষত্রের আলো আমাদের চোখে পৌঁছাতে যে সময় নিচ্ছে, সেই সময়ের ব্যবধানের কারণে আমরা সবসময় অতীতকে প্রত্যক্ষ করি।

মানবদৃষ্টির সীমাবদ্ধতা

আমাদের চোখের সামনে যা কিছু ঘটে, তাৎক্ষণিক মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা অতীতের ঘটনা। এমনকি আমাদের চারপাশের মানুষদের মুখের হাসি, কথা বলা—সবই এক মুহূর্ত পিছিয়ে থাকে। কারণ, আলো এবং শব্দ আমাদের চোখ ও কানে পৌঁছাতে কিছুটা সময় নেয়। এই সময়টি হয়তো খুবই ক্ষুদ্র, মিলিসেকেন্ডের ব্যবধান মাত্র, কিন্তু তা যথেষ্ট এই সত্যটি উপলব্ধি করার জন্য যে, আমরা আসলে "বর্তমান" কখনোই দেখতে পাই না।

ধরা যাক, আপনি যদি এক মুহূর্তের জন্য নিজের হাতের দিকে তাকান, তাহলে আপনি যা দেখছেন তা একেবারে বর্তমান নয়। আলোর গতি প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড, কিন্তু এই আলো আপনার হাতে প্রতিফলিত হয়ে চোখে পৌঁছাতে যে ক্ষুদ্র সময় নেয়, সেটিই বলে দেয় যে আপনি অতীত দেখছেন। যদিও এই পার্থক্য এতটাই নগণ্য যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তা উপলব্ধি করা যায় না, তবুও এটি এক গভীর সত্যকে তুলে ধরে।

সময়ের একমুখী প্রবাহ

এই আলো ও সময়ের সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—আমরা কেবলমাত্র অতীত দেখতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যৎ নয়। সময় একমুখী প্রবাহিত হয়, অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে। আমরা হয়তো কল্পনায় ভবিষ্যৎ দেখতে চাই, কিন্তু আমাদের চোখের সামনে যা ধরা পড়ে তা শুধুই অতীতের প্রতিফলন।

যখন আমরা আকাশের দিকে তাকাই, তখন আমরা মহাবিশ্বের ইতিহাস দেখছি। মিলিয়ন বছর আগে ছুটে আসা আলোর কণাগুলো আমাদের সামনে এক বিশাল কসমিক ইতিহাসের দরজা খুলে দেয়। প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির আলো আমাদের চোখে পৌঁছানোর আগেই হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। এটি বোঝায় যে, আমরা যত দূরে তাকাই, তত গভীর অতীতে ফিরে যাই।

মানব জীবনে অতীতের প্রতিচ্ছবি

এই ধারণা শুধু পদার্থবিজ্ঞানের নয়, মানবজীবনের বাস্তবতারও প্রতিচ্ছবি। আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের স্মৃতি—সবই অতীতের ছায়া। আমরা যখন কোনো মানুষকে ভালোবাসি, তাদের স্মৃতির আলোই আমাদের হৃদয়ে প্রতিফলিত হয়। আমাদের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা—সবকিছুই অতীতের অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।

এজন্যই বলা হয়, মানুষ তার অতীতের আলোয় পথ চলে। যারা ইতিহাস ভুলে যায়, তারা ভবিষ্যতে দিকভ্রষ্ট হয়। আমরা যখন পুরনো বই পড়ি, পুরনো ছবি দেখি, তখন আসলে অতীতের আলোতেই নিজেদের জীবনকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ: আলোর দৃষ্টিতে

আমরা কি কখনো বর্তমান দেখতে পারি? বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে উত্তর হলো—না। বর্তমান কেবলই একটি সংজ্ঞা, যা সময়ের এক অতিক্ষুদ্র বিন্দুর নাম। সময়ের প্রবাহ এত দ্রুত যে আমরা কখনোই একে স্থিরভাবে ধরতে পারি না। আমাদের চোখ সবসময় অতীতের ঘটনার ছবি আঁকে, আমাদের মনও অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ অনুমান করে।

ভবিষ্যৎও আলোর খেলার মতোই অধরা। আমরা কেবল অতীতের আলো থেকে ভবিষ্যতের পথ অনুমান করতে পারি, কিন্তু একে সরাসরি দেখতে পারি না। ঠিক যেমন, আমরা জানি যে সূর্য আগামীকালও উদিত হবে, কারণ আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এই অনুমান করি। কিন্তু ভবিষ্যৎ ঠিক কেমন হবে, তা জানার কোনো উপায় নেই, যতক্ষণ না সেটি অতীত হয়ে যায়।

উপসংহার

আমাদের দৃষ্টির এই সীমাবদ্ধতা হয়তো কিছুটা হতাশাজনক মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই বাস্তবতা। আমরা অতীতের আলোয় ঘেরা, অতীতের স্মৃতিতে বেঁচে থাকা মানুষ। তবে এই অতীতই আমাদের শিখিয়ে দেয় কিভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।

আলো সময়ের বাহক, এবং আমরা তার প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে পৃথিবীকে দেখি। তাই আমরা কখনোই বাস্তব অর্থে বর্তমানকে দেখতে পাই না, বরং সবসময় অতীতের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে বেঁচে থাকি। অতীতের আলো আমাদের দিকনির্দেশনা দেয়, আমাদের স্মৃতিগুলোকে জীবন্ত রাখে, আর ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়।

Comments

    Please login to post comment. Login