সর্বম্ দুঃখম্ দুঃখম্
২১ মে ২০২৪
আরিফ রহমান
মায়ানমারের মংকেত শহরকে কেন্দ্র করে ৩৫০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকলে সেই বৃত্তটার ভেতরে যত মানুষ বাস করে বাকি গোটা দুনিয়ায় তার চাইতে কম মানুষ বাস করে। যদিও এই ৩৫০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্তের ক্ষেত্রফলের অর্ধেক এলাকা জুড়েই আছে সমুদ্র।
এই অর্ধবৃত্তের ভেতরে বাস করে দুনিয়ার অধিকাংশ বুদ্ধ, হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারী মানুষেরা। এই বৃত্তের ভেতরে দুনিয়ার অধিকাংশ মিঠাপানির সংস্থান হয়। এই বৃত্তের ভেতরেই দুনিয়ার অধিকাংশ ফসল ফলে। এই বৃত্তের ভেতরেই আছে দুনিয়ার অধিকাংশ নদী। মানুষকে যদি একটা ফসল হিসাবে চিন্তা করি তাহলে মানুষ সবচেয়ে ভালো ফলে এই অঞ্চলে, এর পেছনে সবচেয়ে বড় সাফল্য নদীর। মাটির সাথে বোঝাপড়া সবচেয়ে ভালো এইখানকার মানুষের। এই বৃত্তের মধ্যেই জন্মেছিলেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ!
মহামতি তথাগত গৌতমের বোধিলব্ধ প্রথম সত্য (যেটাকে ধর্মীয় পরিভাষায় বলে আর্যসত্য) হলো- 'সর্বম্ দুঃখম্ দুঃখম্'। অর্থাৎ এই সংসারের সবকিছু দুঃখময়। জীবের জীবন দুঃখে পরিপূর্ণ। জন্ম, জরা, বিচ্ছেদ এবং মৃত্যু সবই দুঃখময়। দুঃখ মানব অস্তিত্বের নিত্যসাথী। কার্ল মার্ক্স যেমন উদ্বৃত্ত মূল্যের হারিয়ে যাওয়া উৎসকে আবিষ্কার করেছিলেন, ঠিক সেই মাপের দুনিয়ার আর একটি মাত্র আবিষ্কারই হয়েছিল বলে চিহ্নিত করেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন, সেটা হল দুঃখের সার্বজনীনতা।
বুদ্ধ মতে সুখ কখনোই দুঃখের বিপরীত কিছু নয়, সুখও এক ধরণের দুঃখ। উনি সুখকে বলেন দুঃখের ছদ্মবেশ বা ছদ্মবেশি দুঃখ। বুদ্ধের মতে এই সংসার যেহেতু অনিত্য এবং যা কিছু অনিত্য তাই দুঃখময়, ফলে সবকিছুই দুঃখময়। সর্বগ্রাসী এই দুঃখের কারণ আর দুঃখ থেকে মুক্তির উপায়ই গৌতম বুদ্ধের সাধনার লক্ষ্য। গৌতম বলছেন:
'জন্মে দুঃখ, নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখ, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়জনের বিয়োগ দুঃখময়। সকল কিছুই দুঃখময়।' (মহাসতিপতানসূত্ত/২২/১৮)
এই দুঃখ অল্প নয়, প্রচুর, ধম্মপদে বুদ্ধ বলছেন:
'এ (দেহরুপ) গৃহের নির্মাতাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে (জ্ঞানাভাবে) তাকে না পেয়ে বহু জন্ম এই সংসার পরিভ্রমণ করলাম। বারবার জন্ম নেয়াটাও দুঃখজনক, কষ্টদায়ক।' (ধম্মপদ/জরাবর্গ/৮)
সবকিছুতে দুঃখ দেখতে পায় বলে অনেকে বৌদ্ধদর্শনকে নৈরাশ্যবাদী (নিহেলিস্ট) দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়, এ চাওয়াটাই যে বিরাট একটা সাধনাকে নালিফাই করার একটা ব্যর্থ চেষ্টা, বৌদ্ধদর্শন যে আশাবাদে পরিপূর্ণ এবং এ দুঃখরোগের নিরোধ যে আছে সেটা ধম্মপদে বুদ্ধ স্বয়ং বলছেন:
'প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোন কিছুতেই অনুরক্ত হয়ো না। কারণ প্রিয়বস্তুর অদর্শন এবং অপ্রিয়বস্তুর দর্শন উভয়ই দুঃখজনক। তাই প্রিয়ানুরাগী হয়ো না। প্রিয়বিচ্ছেদ দুঃখজনক। যাঁর প্রিয়-অপ্রিয় কিছুই নেই তাঁর কোন বন্ধন থাকে না। প্রিয় থেকে শোকের উৎপত্তি হয়, প্রিয় থেকে ভয়ের উৎপত্তি হয়।
যিনি প্রিয়াসক্তি থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কিভাবে?
প্রেম থেকে, আসক্তি থেকে শোকের উৎপত্তি হয়। প্রেম থেকে, তৃষ্ণা থেকে ভয়ের উৎপত্তি হয়। যিনি প্রেম, আসক্তি, কাম, তৃষ্ণা থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কিভাবে?' (ধম্মপদ/প্রিয়বর্গ/২-৮)।
দুঃখ জিনিসটা আসে আকাঙ্ক্ষা থেকে। অপ্রিয় মানুষকে না দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আবার প্রিয় মানুষকে দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দুটো ঘটনায় দিনশেষে জীবনকে দুঃখময় করে তোলে। বুদ্ধ বোঝাতে চাইছেন সুখ জিনিসটাও দুঃখের ছদ্মবেশ। একজন আধুনিক বুদ্ধ মঙ্ক বিষয়টা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন বন্ধুদের সাথে পিৎজা খাবার প্ল্যান করার একটা গল্প দিয়ে।