Posts

গল্প

বৃষ্টির দিনে (ছোট গল্প )

April 9, 2025

মোঃ বজলুর রশীদ

Original Author মোঃ বজলুর রশীদ

413
View

হটাৎ আকাশ কালো করে মেঘ করল। বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে ,রাস্তার ধারে ছোট্ট চায়ের দোকান। টিনের চাল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। পাশেই ভিজে একটা কাঠের বেঞ্চ। আমি দাঁড়িয়ে আছি ছাতার নিচে।
কোথাও যাব না আপাতত , মাঝে মাঝে ভাবছি বৃষ্টিতে ভিজবো কিন্তু ঠান্ডা লাগার ভয়ে তা করতে পারতেছি না।

বৃষ্টিটা আস্তে আস্তে প্রচন্ড হচ্ছে যাকে বলে cats and dogs raining এটাকে আমরা বিড়াল আর কুকুরের বৃষ্টি অথবা Tom and Jerry বৃষ্টি বলতে পারি । মুষলধারে বৃষ্টির পিছনে এইসব শব্দ ব্যবহার করার কিছু কারণ আছে তা হলো - ওডিন, যিনি কি না ঝড় বৃষ্টির দেবতা। কুকুর আর বিড়াল ছিলো তাঁর প্রিয় পশু। দেবতা ওডিন যেদিন কোনো নারীর ভালোবাসা পেতেন না, সেদিন ক্ষুদ্ধ হয়ে ঝড় আর বৃষ্টি নামাতেন। তাঁর প্রিয় কুকুর এই ঝড়ো হাওয়াকে বয়ে নিয়ে যেতো আর প্রিয় বিড়ালগুলো সেখান থেকে বৃষ্টি ঝরাতো। সেই থেকে মুষলধারে বৃষ্টিকে বলা হতো বিড়াল আর কুকুরের বৃষ্টি!

বৃষ্টির মধ্যে চা খাওয়ার আনন্দই আলাদা।  প্রচন্ড গরমে দুপুরে চা খাওয়ার যে আনন্দ আর বৃষ্টির মধ্যে চা খাওয়ার আনন্দ এক নয় দুইটির মধ্যে অনেক পার্থক্য।  দোকান থেকে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা নিয়ে বেঞ্চে বসতেই চোখ পড়ল পাশের মানুষটার দিকে।

তিনি একজন বৃদ্ধ ,বয়স কত হতে পারে? সত্তর? হয়তো তারও বেশি।সাদা পাঞ্জাবি পরা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
পায়ের কাছে একটা পুরোনো ছাতা রাখা। তার চা খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে তার কোন তারা নেই ,একদম ধীরে ধীরে চা খাচ্ছেন ।

তিনি হটাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলেন।আমিও  তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসিয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম।

বৃদ্ধ হেসে বললেন, তোমার বৃষ্টি ভালো লাগে?
আমি চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, ভালো লাগে। তবে খুব বেশি হলে বিরক্ত লাগে।

বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন, বৃষ্টি তো কখনো খুব বেশি হয় না। আমরা বিরক্ত হয়ে যাই, তাই মনে হয় বৃষ্টি বেশি হচ্ছে।
কথাটা শুনে চুপ করে রইলাম।

তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, জানো, আগে বৃষ্টি আসলে আমি খুব খুশি হতাম। এখন আর ভালো লাগে না।

আমি অবাক হয়ে তাকালাম,এই ধরনের কথা সাধারণত তরুণরা বলে। বৃদ্ধদের বলা উচিত, বৃষ্টিতে হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যায় এমন কিছু।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কেন?

বৃদ্ধ চায়ের কাপের গায়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললেন, আগে যখন বৃষ্টি আসত, আমার স্ত্রী চায়ের জন্য জোর করত। বলত, এমন দিনে চা না খেলে চলে?
আমি রেগে বলতাম, চায়ের জন্য এত আদিখ্যেতা কেন?
সে হাসত। তারপর নিজেই এক কাপ এনে দিত।

আমি বৃদ্ধির কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম।
বৃদ্ধ একটু থেমে আবার বললেন, বৃষ্টি আসত, আমি চা খেতাম, সে চায়ের কাপে চুমুক দিত আর রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতো।

কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধ হাসলেন ,তারপর আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।

আমি বললাম, এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে, চাও আছে তাহলে ভালো লাগছে না কেন?
বৃদ্ধ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, এখন শুধু চা আছে, বৃষ্টি আছে , শুধু সে নেই।

আমি চুপ করে রইলাম।
দোকানদার গরম সিঙ্গারা ভাজতেছিল আর
রাস্তার ওপাশে কয়েকজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দৌড়াচ্ছিল।

আমাদের সামনে গরম চায়ের কাপগুলো আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছিল। হটাৎ বৃদ্ধ হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তারপর হাই তুলে বললেন তুমি কি জানো, কেউ চলে গেলে, সে আসলে কোথাও যায় না। সে থেকে যায়। প্রতিটা জায়গায়। প্রতিটা মুহূর্তে। শুধু কথা বলে না, হাত ধরে না, হাসে না।বাইরে বৃষ্টি আরও বেড়েছে।

আমি জানি না, আমার চায়ের কাপটা কখন ঠান্ডা হয়ে গেছে।
আমি চুপ করে বসে আছি,বৃদ্ধ ধীরে ধীরে চা খাচ্ছেন।
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে প্রচন্ড জোরে।

রাস্তার ওপাশে একটা ছেলে, বয়স বড়জোর বারো কি তেরো,
খালি গায়ে বৃষ্টিতে নেচে বেড়াচ্ছে।
তার মা চিৎকার করে ডাকছে, ভেতরে আয়! ঠান্ডা লেগে যাবে!

আমি বৃদ্ধের দিকে তাকালাম।
তিনি হাসছেন,এখন ছেলেটাকে দেখলে রাগ হয়, তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম, না তো। ছোটবেলায় আমিও এভাবেই ভিজতাম।

বৃদ্ধ মাথা দুলিয়ে বললেন, আমিও। তখন আমার মা এমন করেই ডাক দিত। বলত, বৃষ্টি হলে বাড়িতে থাকতে হয়।
আমি বলতাম, কেন? মা বলত, বাহিরে বজ্রপাত হয় । তারপর একদিন বড় হয়ে গেলাম।

আমি কিছু বললাম না,বৃদ্ধ তাকিয়ে রইলেন ছেলেটার দিকে।
তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বড় হয়ে গেলে মানুষ আর ভিজতে চায় না, ভিজতে ভয় পায়। ছাতা নেয়, রেইনকোট পরে।

আমি এবার বললাম, আপনার স্ত্রী কবে মারা গেছেন?
বৃদ্ধ একটু চমকে তাকালেন,তারপর বললেন, পাঁচ বছর হলো।পাঁচ বছরে তো অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখনো বৃষ্টিতে কষ্ট হয়?

বৃদ্ধ হেসে বললেন, তুমি কি কখনো কাউকে সত্যিকারের ভালোবেসেছ? আমি চুপ করে রইলাম। প্রশ্নটার উত্তর আমি জানি না।

বৃদ্ধ নিজেই বললেন, যদি ভালোবেসে থাকো, তাহলে জানবে সময় চলে যায়, কিন্তু কিছু জিনিস কোথাও হারায় না।
সেগুলো থেকে যায় যেমন এই বৃষ্টি।

আমার চায়ের কাপটা এখন একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে।
তবু আমি খাচ্ছি। বৃদ্ধ এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
তার পুরোনো ছাতাটা হাতে নিলেন।
বললেন তোমার সাথে অনেক কথা হলো, আজ আসি। ভালো থেকো, ছেলে।

আমি বললাম, আপনার বাড়ি কোথায়?
বৃদ্ধ একটু হেসে বললেন, কোথায়? ভালো প্রশ্ন। এখন আমার বাড়ি কই জানো? এই চায়ের দোকান। এই বেঞ্চ।
এই রাস্তা,আর যেখানে বৃষ্টি পড়ে।

আমি তাকিয়ে রইলাম।
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে রাস্তায় নেমে গেলেন।
ছাতাটা খুললেন না,চুপচাপ বৃষ্টিতে হাঁটতে লাগলেন।
তার সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজে যাচ্ছে,চশমার কাচের ওপর পানি জমছে ।

তিনি একবারও পিছনে তাকালেন না।
আমি জানি না, কেন আমার মনে হলো ,এই বৃদ্ধেরও কোনো ঠিকানা নেই।

বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে।
আমার মাথার ভেতর কে যেন বলল,কেউ চলে গেলে, সে আসলে কোথাও যায় না।

বৃদ্ধের চলে যাওয়া দেখছি , সেই ভেজা ব্রেঞ্চে থেকে ।
তখনও বৃষ্টি পড়ছে চায়ের দোকানে আরো কয়েকজন এসেছে, সবাই বৃষ্টির জন্য আশ্রয় খুঁজছে।
কিন্তু তখনও আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে বৃদ্ধের বলা শেষ কথাটি ।

কেউ চলে গেলে, সে আসলে কোথাও যায় না...
আমি দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওই বৃদ্ধকে আপনি চেনেন?দোকানদার বিস্মিত চোখে তাকাল, কোন বৃদ্ধ?

আমি হাত দিয়ে রাস্তার দিকে দেখিয়ে বললাম, এই তো, একটু আগেও এখানে বসে চা খাচ্ছিলেন। সাদা পাঞ্জাবি পরা, মোটা ফ্রেমের চশমা...

দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, আপনি হয়তো ভুল দেখেছেন। আমি তো সকাল থেকেই দোকানে আছি, কোনো বৃদ্ধ লোককে তো আমার চোখে পড়েনি ।

আমার শরীর কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গেল।
কিন্তু... আমি তো তার সাথে কথা বললাম! তিনি এই বেঞ্চে বসেই চা খেলেন!

দোকানদার এবার হেসে ফেলল, আপনার নিশ্চয়ই হালকা ঘুমে স্বপ্ন দেখছেন ভাই । নাহলে বৃষ্টির শব্দে কিছু কল্পনা করেছেন।

আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালাম।
কল্পনা? তাহলে এই বেঞ্চের ওপরে যে পানির ছাপ, সেটা কিসের?চায়ের কাপটা কে রেখে গেল?

বৃষ্টি একটু কমেছে,আমি উঠে দাঁড়ালাম,রাস্তার ওপাশে তাকালাম।

কোথাও কেউ নেই শুধু বৃষ্টিভেজা রাস্তায় একটা পুরোনো ছাতা পড়ে আছে। সাদা একটা ছাতা।

আমি বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করলাম।
মনে হলো, এই বৃদ্ধের সাথে আমার অনেক পুরোনো সম্পর্ক ছিল।কিন্তু কবে? কোথায়?আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না।চায়ের দাম দিয়ে ছাতাটা হাতে নিলাম।তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম......
 

Comments

    Please login to post comment. Login