একটা ছোট্ট শান্তিপূর্ণ গ্রাম—চারপাশে ধানক্ষেত, মাটির রাস্তা, পাখির ডাক আর মাঝেমধ্যে হালকা কুয়াশা। সেই গ্রামেই বাস করতো রবিন, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে। টিনের ছাউনি দেওয়া এক ঘরে তার মা-বাবা, আর একবেলা খাবার নিয়ে টিকে থাকা সংসার। রবিনের গায়ে দামি জামা ছিল না, পায়ে স্যান্ডেলও ছেঁড়া। কিন্তু তার চোখে ছিল বড় স্বপ্ন, আর হৃদয়ে ছিল ভালোবাসার বিশালতা।
রবিন পড়াশোনা করতো গ্রামের স্কুলে। স্কুলে যাওয়ার আগে বাবাকে খেতে কাজ করে দিতো, স্কুল থেকে এসে গরু ছাগল পাহারা দিতো। দারিদ্র্য তাকে কষ্ট দিতো, কিন্তু সে কখনো থেমে থাকেনি। তার হৃদয়ে ছিল এক আশ্চর্য রকমের আনন্দ আর ভালোবাসা—যেটা সে কাউকে কখনো বুঝিয়ে বলতে পারেনি।
একদিন গ্রামে শহর থেকে আসলো এক ব্যবসায়ী, জমি দেখতে। সাথে ছিল তার মেয়ে মিথিলা। শহরের আধুনিক, ধনী পরিবারের মেয়ে। হালকা গোলাপি সালোয়ার, চোখে সানগ্লাস, আর হাতে স্মার্টফোন। প্রথমবারের মতো মিথিলা গ্রামে এসেছিলো, কিন্তু পরিবেশ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় গ্রামের পাশের বাঁশবন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল মিথিলা। আর অন্যদিকে, গাছে উঠে কাঁঠাল পেড়াচ্ছিল রবিন। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে যায় সে—সোজা গিয়ে পড়ে মিথিলার সামনে। চোখাচোখি—একটা ছোট হাসি।
মিথিলা হেসে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ঠিক আছো?”
রবিন লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ, দুঃখিত। কাঁঠাল ধরতে গিয়ে পড়ে গেলাম।”
মিথিলা আবার হেসে বলল, “তোমার সাহস আছে! গাছে উঠো, আবার আমাকে ভয়ও পাও না?”
সেই হাসিটা রবিনের হৃদয়ে গেঁথে গেল।
এরপর থেকে তারা প্রায়ই দেখা করত। মিথিলা মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ির পেছনে এসে বসতো, রবিন তার জন্য দেশি ফল নিয়ে আসতো। মিথিলা তাকে ইংরেজি শেখাতো, আর রবিন তাকে দেখাতো পাখির বাসা, মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটার আনন্দ। দুজন দুই জগতের মানুষ হলেও, হৃদয়ের বন্ধন তৈরি হয়ে গেল।
মিথিলা একদিন বলল, “রবিন, তুমি জানো? শহরে অনেক কিছু আছে—শপিংমল, পার্ক, সিনেমা হল। কিন্তু এই গ্রামের মত শান্তি কোথাও নেই।”
রবিন বলল, “তুমি থাকলে, আমার সবই আছে।”
ভালোবাসা গাঢ় হতে লাগলো। কিন্তু প্রেমের পথে বাধা আসবেই। মিথিলার বাবা এই সম্পর্ক জানতে পেরে রেগে উঠলেন।
“আমার মেয়ে একজন গরীব ছেলের সাথে প্রেম করবে? এটা হতেই পারে না!”
তিনি মিথিলাকে শহরে নিয়ে গেলেন। ফোন বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
রবিন ভেঙে পড়লো। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। সে প্রতিজ্ঞা করলো—একদিন এমন কিছু করবে, যাতে মিথিলার বাবাও তাকে মেনে নিতে বাধ্য হন। সে শহরে গিয়ে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ নেয়, রাতে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সে নিজের ছোট একটা টি-শার্ট ব্যবসা শুরু করে। কষ্ট, অভাব—সব সহ্য করে সে এগিয়ে যেতে থাকে।
দু’বছর পর রবিন গ্রামে ফিরে আসে। এখন সে সফল এক তরুণ উদ্যোক্তা। গ্রামের মেলায় সে হঠাৎ দেখতে পেল মিথিলাকে—আগের মতোই সুন্দর, তবে চোখে একরাশ অপেক্ষা।
মিথিলা বলল, “তুমি ফিরে এসেছো! আমি জানতাম তুমি আসবে।”
রবিন মৃদু হাসল, “ভালোবাসা ফিরে আসবেই, যদি সেটা সত্য হয়।”
সেইদিন সন্ধ্যায়, গ্রামের কুয়াশায় তারা আবার হাঁটতে বের হলো—একই পথ, একই মাটির রাস্তা, কিন্তু এবার হৃদয়ে শান্তি আর হাতে হাত ধরা।
---
*শেষ।*
আজহার মাহমুদ আকাশ