📖 অন্ধকার জানালার ছায়া

🌑 ভূমিকা

মানুষের মনে ভয় নামের একটা অনুভূতি সবসময় লুকিয়ে থাকে। অন্ধকারে হঠাৎ হাওয়া বইলে, রাতে জানালায় কারো ছায়া পড়লে বা খালি ঘরে কারো ফিসফিসানি শোনা গেলে সেই ভয় জেগে ওঠে। কেউ কেউ বলে—ভূত নেই, সবই মনের ভুল। আবার কেউ কেউ বলে—মৃত আত্মারা আমাদের মাঝেই থাকে, শুধু মাঝে মাঝে তাদের ছায়া দেখা যায়।

এই গল্প শুরু হচ্ছে একটি পুরনো বাড়িকে ঘিরে। গ্রামের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাড়িটি অনেক আগেই জনশূন্য হয়ে গেছে। তবুও রাত নামলেই বাড়িটা যেন জেগে ওঠে। লোকেরা বলে—সেই বাড়ির জানালার কাছে দাঁড়ানো যায় না, কারণ জানালায় এক অদ্ভুত ছায়া এসে ভেসে ওঠে।

সায়মা, এক তরুণী মেয়ে, এই বাড়িতেই কিছুদিন কাটাতে আসে। সে জানে না, তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ের দিনগুলো শুরু হতে চলেছে সেই রাত থেকেই...

🕛 অধ্যায় এক: রাত বারোটার শব্দ

রাত তখন প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। চারপাশের গ্রাম নিস্তব্ধ, কেবল দূরে এক-আধটা কুকুরের ডেকে ওঠা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সায়মা তার দাদার পুরনো বাড়িতে এসেছে কয়েক দিনের জন্য। পড়াশোনার চাপ থেকে মুক্তি পেতে, একটু নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য সে এখানে এসেছে।

বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা নিরীহ মনে হয়, ভেতরে ঢুকলে একটা অদ্ভুত গা ছমছমে অনুভূতি হয়। দেয়ালের পুরনো দাগ, মাকড়সার জাল, আর জানালার ধুলো জমা কাচ যেন এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস লুকিয়ে রেখেছে।

সেদিন রাতে সায়মা তার ঘরে একা বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ ঠক ঠক শব্দ হলো জানালার কাঁচে।
প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো কোনো ডাল বা বাদুড় এসে লেগেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার সেই শব্দ—আরও জোরে।

সায়মা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানালার দিকে তাকাল। কাঁচের ওপারে এক কালো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা শরীর, ঝুলে থাকা হাত, মুখ দেখা যাচ্ছে না।
তার বুক ধক করে উঠল। সে উঠে দাঁড়িয়ে কাছে যেতেই ছায়াটা ধীরে ধীরে হাত তুলল, আর আঙুল দিয়ে কাঁচে আঁকতে লাগল এক অদ্ভুত দাগ। মনে হলো, ভেতরে ঢুকতে চাইছে!

হঠাৎ বাতাস বয়ে গেল ঘরের ভেতর দিয়ে। সায়মা টের পেল, সে একা নয়। ঘরের ভেতর কারো উপস্থিতি স্পষ্ট।
সে পিছনে ফিরতেই তার গলা শুকিয়ে গেল।

ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই একই ছায়া—এবার আর জানালার ওপারে নয়, বরং ঘরের ভেতরেই।
কোনো মুখ নেই, শুধু গভীর অন্ধকার।

ছায়াটা ফিসফিস করে বলল—
“জানালা খুলো না... ওখানেই আমার মৃত্যু হয়েছিল।”

সায়মার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। তার মনে হলো, জানালার কাঁচে হালকা রক্তের দাগ ফুটে উঠছে।

🕯️ অধ্যায় দুই: লুকানো কক্ষ

সায়মা সারারাত জানালার ছায়াটার কথা ভেবে ঘুমাতে পারেনি। অন্ধকার ঘরে বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের আলো ফোটার পর সে কিছুটা স্বস্তি পেল। নিজেকে বোঝাল—সবই হয়তো দুঃস্বপ্ন ছিল।

কিন্তু সকালে উঠে জানালার কাঁচের দিকে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠল।
কাঁচে স্পষ্ট লালচে দাগ লেগে আছে, যেন কারো রক্তাক্ত আঙুল দিয়ে আঁকা রেখা।

সে কাঁপতে কাঁপতে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেল। কাঁচটা ঠান্ডা, কিন্তু দাগটা যেন একটু উঁচু হয়ে আছে, যেমন শুকনো রক্ত দেয়ালে লেগে থাকে।

সারা দিন অস্বস্তি কাটাতে পারছিল না। বিকেলে বাড়িটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো তার। হয়তো এর পেছনে কোনো যুক্তি আছে—নিজেকে বোঝাতে চাইল সে।

পুরো বাড়িটা ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পৌঁছাল দোতলার পুরনো করিডরে। করিডরটা খুব অদ্ভুত—দেয়ালগুলো কেমন বেঁকে গেছে, আর মেঝে ভাঙাচোরা। হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ল—একটা দেয়ালের কোণায় হালকা ফাঁকা জায়গা।

কৌতূহলী হয়ে সে হাত বাড়িয়ে দেয়ালে চাপ দিল। অবিশ্বাস্যভাবে দেয়ালটা ভেতরে দুলে উঠল, আর একপাশ সরে গিয়ে খুলে গেল এক গোপন দরজা!

ভেতরে এক অন্ধকার সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সিঁড়ির ভেতর থেকে ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এলো, যেন বহুদিন ধরে কেউ দরজাটা খোলেনি।

সায়মা কিছুক্ষণ দ্বিধা করল, কিন্তু অদ্ভুত টান তাকে ভেতরে যেতে বাধ্য করল।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে সে পৌঁছাল এক গোপন কক্ষে। কক্ষটা ছোট, কিন্তু চারদিকে পুরনো আসবাবপত্র, ভাঙা চেয়ার আর মাকড়সার জালে ভরা।

ঘরের মাঝখানে একটা ছোট কাঠের আলমারি। ধুলোয় ঢেকে আছে, কিন্তু তালা ভাঙা।
সায়মা আলমারির দরজা খুলতেই একটা পুরনো ডায়েরি পড়ে গেল।

ডায়েরির মলাট ছেঁড়া, পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে।
সে প্রথম পাতায় খুলল, আর ভেতরে লেখা দেখে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।

লেখা আছে—
“আমি রুখসানা। এই জানালার ঘরেই আমাকে মেরে ফেলা হয়েছিল...”

সায়মার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।
সে বুঝল, ছায়াটা শুধু কোনো অদ্ভুত কল্পনা নয়। এই বাড়ির ভেতরে আসলেই এক ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে।

আর সেই রহস্যের সূত্র লুকানো আছে এই পুরনো ডায়েরির পাতায়।

🕯️ অধ্যায় তিন: ডায়েরির পাতা

সায়মা কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরির প্রথম পাতাটা উল্টালো। পাতার উপরের দিকেই লেখা—
“আমি রুখসানা। এই ডায়েরিতে লিখছি আমার শেষ দিনের কথা।”

সায়মার বুক ধুকপুক করতে লাগল। তার মনে হলো, পাতার অক্ষরগুলো শুধু লেখা নয়, যেন শব্দ হয়ে কানে ফিসফিস করছে।

ডায়েরির পরের পাতায় লেখা—
“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল পাশের গ্রামের রফিকের সঙ্গে। কিন্তু আমি চাইনি তাকে। আমি ভালোবেসেছিলাম অন্য কাউকে। সেই ভালোবাসাই আমার মৃত্যুর কারণ হলো। এক রাতে, এই বাড়ির জানালার কাছে আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়। আমার চিৎকার কেউ শোনেনি। জানালার কাঁচে আমার রক্ত লেগে রইল।”

সায়মার গা শিউরে উঠল। সে ডায়েরির পাতায় হাত বোলাতে গিয়ে টের পেল—পাতাগুলো স্যাঁতসেঁতে, যেন কোনো অদ্ভুত তরলে ভিজে আছে।

হঠাৎ ঘরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। তার কানে ভেসে এল ফিসফিস শব্দ—
“তুমি আমার গল্প পড়ছো... এবার তুমি আমার চোখে সব দেখবে।”

সায়মা বুঝতে পারল, রুখসানার আত্মা কেবল ডায়েরির পাতায় বন্দি নয়—সে এখনো এই বাড়িতে আছে।
আর সেই ছায়াটাই রুখসানার!

হঠাৎ ডায়েরির ভেতরের কালি গলগল করে নেমে এসে মেঝেতে পড়তে লাগল। সেই কালি রক্তের মতো ছড়িয়ে গিয়ে এক নারীর মুখের আকৃতি তৈরি করল। মুখটা ফাঁকা, শুধু চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করছে।

সায়মা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু কণ্ঠস্বর আটকে গেল। ডায়েরির পাতাগুলো হাওয়ায় উল্টাতে লাগল নিজেরাই।
শেষ পাতায় লেখা একটাই লাইন—
“আমার আত্মা এখনো মুক্ত হয়নি... জানালার ছায়ায় আমি বন্দি।”

🌫️ অধ্যায় চার: জানালার ফিসফিসানি

সেদিন রাতে সায়মা ঘুমাতে পারল না। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
ছায়াটা এবার শুধু নীরব নয়, ফিসফিস করে বলতে লাগল—
“ডায়েরি পড়ো... আমাকে মুক্তি দাও... না হলে তুমি-ও জানালার ছায়া হয়ে যাবে।”

সায়মা কাঁপতে কাঁপতে জানালার কাছে এগোল। সে দেখল কাঁচের ওপাশে রুখসানার ফ্যাকাশে মুখ, ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই।
তবুও ফিসফিসানি সায়মার কানে স্পষ্ট বাজছে।

“যে ঘরে আমাকে মেরে ফেলা হয়েছিল... সেই ঘর খুঁজে বের করো।”

সায়মার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু কৌতূহলও কাজ করছিল। সে ঠিক করল—এই রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে।

💀 অধ্যায় পাঁচ: ভয়ের ছোঁয়া

পরদিন রাতে সায়মা আবার সেই লুকানো কক্ষে গেল। ডায়েরিটা হাতে নিল।
হঠাৎ সে অনুভব করল—তার গলার চারপাশে ঠান্ডা কিছু একটা শক্ত করে চেপে ধরছে।
সে দম নিতে পারছিল না। মনে হলো কেউ তাকে শ্বাসরোধ করছে।

হঠাৎ ঘরের দেয়ালে রক্তের দাগ ভেসে উঠল—
“আমাকে ফিরিয়ে দাও।”

সায়মা মাটিতে পড়ে গেল, চোখ ঘোলা হয়ে আসছিল। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য দেখল—রুখসানার ছায়া তার উপর ঝুঁকে আছে।

সে যেভাবেই হোক হাতছাড়া করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বুঝল, রহস্যের সমাধান না করলে সে বাঁচবে না।

🏚️ অধ্যায় ছয়: রহস্যের গহ্বর

পরদিন সায়মা গ্রামের প্রবীণ এক মহিলার কাছে গেল।
মহিলাটি তাকে দেখে বিস্মিত হলো—
“তুমি ওই বাড়িতে থেকেছ? জানো না, ওই জানালার ঘরেই বহু বছর আগে এক মেয়েকে খুন করা হয়েছিল?”

সায়মা বলল, “হ্যাঁ, আমি তার ডায়েরি পেয়েছি। নাম রুখসানা।”

মহিলার চোখ ছলছল করে উঠল।
“সে আমার আপন ভাতিজি ছিল। কিন্তু কেউ তার হত্যার সত্য জানতে পারেনি। তার আত্মা এখনো জানালায় বন্দি।”

সায়মা বুঝতে পারল, রহস্যটা আসলেই সত্যি।
কিন্তু কীভাবে সে আত্মাটাকে মুক্তি দেবে?

🩸 অধ্যায় সাত: জানালার রক্ত

সেদিন রাতে হঠাৎ বাড়ির জানালার কাঁচ ফেটে গেল। ভেতরে লালচে তরল ছিটকে এলো।
কাঁচে বড় করে লেখা ফুটে উঠল—
“আমার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করো।”

সায়মা বুঝল, কেবল সত্যি উন্মোচন করলেই রুখসানার আত্মা মুক্তি পাবে।
সে ডায়েরির শেষ পাতায় লুকানো নাম খুঁজে পেল।
নামটা লেখা ছিল কাঁপা হাতে—
“রফিক।”

🌑 অধ্যায় আট: অন্ধকারের ফাঁদ

রাত গভীর হলে সায়মা অনুভব করল, পুরো বাড়িটা বদলে গেছে। দেয়াল ভেঙে পড়ছে, দরজা খুলছে-বন্ধ হচ্ছে।
হঠাৎ ছায়াটা সামনে এসে দাঁড়াল। এবার আর রুখসানা নয়, বরং ভয়ঙ্কর বিকৃত রূপ।

সে গর্জে উঠল—
“সত্য প্রকাশ করো! নইলে তোমাকে টেনে নিয়ে যাব জানালার ওপারে।”

সায়মা ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“রুখসানাকে রফিক খুন করেছিল! আমি সবাইকে জানাবো।”

ছায়াটা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।

🔥 শেষ অধ্যায়: মুক্তি নাকি মৃত্যু

সায়মা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে বলল—
“রুখসানা, আমি তোমার সত্য প্রকাশ করেছি। তুমি মুক্ত হও।”

হঠাৎ বাতাস ঝড়ের মতো বইতে লাগল। জানালার কাঁচ ভেঙে গেল, আর সেই ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আলোয়।

একটা নারীর মৃদু হাসি শোনা গেল—
“ধন্যবাদ... আমি মুক্তি পেলাম।”

ঘরটা আবার শান্ত হয়ে গেল।

কিন্তু শেষ মুহূর্তে সায়মা জানালায় তাকিয়ে দেখল—
কাঁচে তার নিজের ছায়া আটকে আছে।
ছায়াটা ধীরে ধীরে হাত তুলল... আর ঠক ঠক করে কাঁচে আঘাত করল।

শেষ। 👻