👻 ভৌতিক গল্প: "অন্ধকার জানালার ছায়া"

অধ্যায় এক: নিঃশব্দ রাত

শহরের এক কোণে পরিত্যক্ত এক দোতলা বাড়ি। লোকে বলে এই বাড়ির ভেতরে রাত নামলেই অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়—কখনো কারো হাঁটার টুপটাপ আওয়াজ, কখনো কর্কশ দরজা খোলার শব্দ, আবার কখনো মৃদু কান্নার মতো এক রহস্যময় সুর।

বাড়িটি একসময় জমিদার আতিকুল্লার ছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হঠাৎ করেই পুরো পরিবারকে এই বাড়ির ভেতরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কেউ জানে না, কীভাবে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। সেই থেকে বাড়িটি মানুষ এড়িয়ে চলে। গ্রামের মানুষ বলে—ওই বাড়ির জানালা দিয়ে রাতে ছায়া নেমে আসে।

কলেজ পড়ুয়া রাফি সবসময় এসব গুজবকে ভাঁওতা বলে উড়িয়ে দিত। তার বন্ধু নাহিদ আর লিমাও একদিন মজা করে বলে বসে—
“চল, আজ রাতে গিয়ে দেখি, ভূত আছে কিনা। আমরা গিয়ে প্রমাণ করে আনব যে সবটাই মিথ্যে!”

সন্ধ্যা নামতেই তিনজন টর্চলাইট আর মোবাইল ক্যামেরা হাতে পুরনো বাড়ির সামনে দাঁড়াল। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ভ্যাপসা গন্ধে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ভাঙা টেবিল, উল্টে থাকা চেয়ার, মাকড়সার জালে ঢাকা দেওয়াল—সবকিছু যেন মৃত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।

প্রথমে ভয়কে চেপে হাসাহাসি করছিল তারা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই নাহিদের টর্চলাইট হঠাৎ নিভে গেল। সে টর্চটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
“আরে ব্যাটারি ডেড হয়ে গেল নাকি?”

ঠিক তখনই উপরের তলার একটি জানালা হঠাৎ কর্কশ শব্দে খুলে গেল। যেন ভেতর থেকে কেউ জোরে ঠেলে দিয়েছে। বাতাস ছিল না, তবুও জানালার পর্দা হাওয়ায় উড়তে লাগল।

তিনজনে তাকিয়ে দেখে—জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা ছায়ামূর্তি। মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু দুটো চোখ যেন অন্ধকার ভেদ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

লিমার শরীর কেঁপে উঠল, সে কাঁপা গলায় বলল—
“ওটা... ওটা মানুষ নয়...”

রাফি সাহস করে টর্চলাইটটা উপরের দিকে ধরল। মুহূর্তেই ছায়াটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু মিলিয়ে যাওয়ার আগে যেন বাতাসে একটা ফিসফিস শব্দ ভেসে এলো—

"তোমরা কেন এসেছো...?"

তিনজনের বুক ধড়ফড় করে উঠল। চোখাচোখি করতেই মনে হলো, যেন ঘরের ভেতরে আরও কারো উপস্থিতি আছে।

কিন্তু আসল আতঙ্ক শুরু হলো তখনই, যখন নাহিদ হঠাৎ কেঁপে উঠে চিৎকার করে উঠল—
“কেউ... কেউ আমার কাঁধে হাত দিয়েছে!”

অধ্যায় দুই: অদৃশ্য ছোঁয়া

নাহিদের চিৎকারে পুরো বাড়িটা যেন কেঁপে উঠল। রাফি আর লিমা দু’জনেই ওর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
“কী হলো? কেন চিৎকার করছিস?”—রাফি জোরে বলল।

নাহিদের কণ্ঠ কাঁপছে, সে কাঁধটা চেপে ধরে বলল—
“আমি স্পষ্ট টের পেলাম, কেউ আমার কাঁধে হাত রেখেছিল। ঠান্ডা... বরফের মতো ঠান্ডা!”

ওদের তিনজনের শরীরেই তখন ঘাম জমে গেছে। কিন্তু এখন পিছু হটার মতো অবস্থা নেই। তারা সিদ্ধান্ত নিল, যত ভয়ই লাগুক, সত্যিটা বের না করে ফেরা যাবে না।

তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল উপরের তলায়। সিঁড়িগুলো পচে গেছে, প্রতিটি ধাপে পা রাখতেই কর্কশ শব্দ হচ্ছিল। উপরে উঠেই তারা দেখতে পেল জানালাটা এখনো খোলা, আর জানালার নিচে একটি পুরনো টেবিল। টেবিলের ওপরে ধুলো জমে থাকা একটি কালো ডায়েরি রাখা।

লিমা হাত কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরিটা তুলল। পাতাগুলো ভাঁজ হয়ে গেছে, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় সেখানে হাতের লেখা আছে। প্রথম পাতায় লেখা—

"যদি কেউ এই ডায়েরি খোলে, তবে সে আর ফিরে যেতে পারবে না।"

তিনজনের গলা শুকিয়ে গেল। হঠাৎ করেই জানালার বাইরে থেকে শোনা গেল মৃদু কান্নার শব্দ... যেন কোনো নারী কাঁদছে।

তারা ডায়েরির পাতা উল্টাল—
আরো ভেতরে লেখা আছে—
"এই বাড়িতে যে মারা গেছে, তাদের আত্মা জানালার ছায়ায় বন্দি হয়ে আছে।"

হঠাৎ ঘরের বাতি-মতোন অন্ধকারে টর্চলাইট নিভে গেল। চারদিক ঘন অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের ভেতরে কানে ভেসে এলো একই ফিসফিস—

"তোমরা কেন এসেছো...?"

অধ্যায় তিন: ডায়েরির ইতিহাস

টর্চলাইট আবার জ্বালাতেই তারা দেখতে পেল ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারী মূর্তি। লম্বা চুল মুখ ঢেকে রেখেছে, সাদা পোশাক জড়ানো, আর পা দুটো মাটিতে ছোঁয়া নেই—মাঝ আকাশে ভাসছে।

লিমা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে চিৎকার করল, “ও... ওটা মানুষ না!”

নারী মূর্তিটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। হঠাৎ করেই তার মুখ দেখা গেল—চোখ দুটি রক্তলাল, আর মুখ থেকে ভেসে আসছে ভয়াবহ চিৎকার। তিনজনই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল।

নীচে নেমে এসে তারা আবার ডায়েরিটা খুলল। তাতে লেখা—

"আমি হুমায়রা। আমি এই বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ ছিলাম। এক অদ্ভুত রাতে জমিদারের লোভের কারণে আমাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আমার আত্মা এখনো মুক্তি পায়নি।"

পাতার শেষ দিকে লেখা—
"যে কেউ এই বাড়িতে প্রবেশ করে, সে যদি জানালার ছায়া দেখে ফেলে, তবে তাকে আমার সঙ্গেই থেকে যেতে হবে... চিরদিনের জন্য।"

রাফি ডায়েরি হাতে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“মানে আমরা... আমরা কি এখান থেকে বের হতে পারব না?”

ঠিক তখনই চারদিকে সব দরজা একসাথে ধাম করে বন্ধ হয়ে গেল।

অধ্যায় চার: ছায়ার ফাঁদ

তিনজন আতঙ্কে ছটফট করতে লাগল। বাইরে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। তারা বুঝল, এখন কেবল ডায়েরির রহস্য উন্মোচন করেই হয়তো মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা—
"আমার আত্মা মুক্তি পাবে তখনই, যখন কেউ আমার অশ্রু মুছে দেবে এবং আমার সত্যিকার কাহিনী বিশ্বকে জানাবে।"

কিন্তু পাতা পড়া শেষ হতেই চারপাশ থেকে অসংখ্য ছায়া ঘিরে ধরল ওদের। জানালার কাচে প্রতিফলিত হলো শূন্য চোখওয়ালা মানুষের মূর্তি।

নাহিদ আর লিমা ভয়ে অচেতন হয়ে পড়ল। রাফি একাই টর্চলাইট হাতে চিৎকার করে বলল—
“আমরা তোমার কাহিনী সবাইকে জানাবো! আমাদের ছেড়ে দাও!”

হঠাৎ সব ছায়া থেমে গেল। নারীমূর্তিটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল—
"তাহলে প্রতিজ্ঞা করো... এই বাড়ির ইতিহাস তোমরা সবাইকে বলবে।"

রাফি কাঁপা গলায় প্রতিজ্ঞা করল।

তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেল।

অধ্যায় পাঁচ: অন্ধকার জানালার ছায়া

তিনজন ছুটে বের হয়ে এল বাড়ির বাইরে। চারপাশে আবার স্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। কিন্তু তাদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ অমোচনীয়।

ডায়েরিটা এখনো রাফির হাতে। সে বুঝতে পারল, প্রতিজ্ঞা পূরণ না করা পর্যন্ত ছায়ারা ওদের ছেড়ে দেবে না।

কিন্তু বাড়ির দিকে তাকিয়ে লিমা হঠাৎ ফিসফিস করে বলল—
“তোমরা শুনছো? ওরা এখনো আমাদের দেখছে...”

আর সত্যিই—উপরে সেই জানালায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে হুমায়রার ছায়ামূর্তি...
রক্তলাল চোখ নিয়ে।

✅ সমাপ্তি, কিন্তু এক ভয়ংকর সত্য রয়ে গেল—
ওরা কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছিল? নাকি ছায়ার ফাঁদ এখনো তাদের ঘিরে রেখেছে…