ধীরে ধীরে সময় কেটে যায়। আমার সন্তান হয় না। আমার চেনা সজীবও কেমন বদলে যেতে লাগলো। একটা সময় লোকে বাচ্চা না হওয়া নিয়ে কথা শোনালে রাতে আমি সজীবের বুকে মাথা রেখে কাঁদলে সে বলতো,“কেন কান্না করছো? সারা দুনিয়ায় তুমি কী শুধু একা যার বাচ্চা হচ্ছে না? একা তো নও। তবে কাঁদছো কেন? তুমি বোঝো না তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না। এভাবে কাঁদলে তো আমি বলবো সেই সন্তান আমার লাগবে যে সন্তানকে তোমার অনেক কান্না করে পেতে হবে। এমন সন্তান লাগবে না তো।”
“কী বলছো?”
আমি উঁচু বাক্যে কথাটি বললে সজীব আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলতো,“তুমি এভাবে কাঁদলে আমি এটাই বলবো। বাচ্চা না হওয়ার চেয়ে বহুগুন কষ্টের তোমার এই চোখের পানি।”
সজীব আমাকে ভালোবেসে বোঝাতো। সে আমার চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। দিনশেষে এটাই আমার পাওয়া ছিলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই চেনা সজীব বদলে যায়। তার একটা নোকিয়া ফোন ছিলো। সবসময় সেই ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত থাকতো। আমাকে সময় দেওয়ার কথা ভুলেই যেতো। একদিন যার বুকে মুখ লুকিয়ে আমি আমার কষ্ট ভুলতাম সেই মানুষটি এখন আমার কান্না দেখে বলে,“ন্যাকামি বন্ধ করো তো।”
এই তো সেদিন শাশুড়ী মা আমাকে বাজা সঙ্গে আরও কিছু বাজে কথা বলে। যেসব কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যায়। আমি সেদিন সারারাত কান্না করি। আমার সেই কান্না সজীবের বিরক্তি ছিলো। আমার কষ্টটা তার জন্য ন্যাকামি ছিলো। তার ঘুমে সমস্যা হচ্ছে বলে আমাকে নিচে শুয়ে কাঁদতে বলে। বাচ্চা না হওয়ায়, সবার কথার তীর যতটা না কষ্টের ছিলো তারচেয়ে বহুগুন বেশি কষ্টের ছিলো সজীবের এই বদলে যাওয়া। যেটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। একদিন তো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,“তোমার কী হয়েছে? তুমি আমার সঙ্গে এমন কেন করছো? আমাকে সময় দিচ্ছো না কেন?”
”তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
আমার কিছুই হয়নি। আমি তোমাকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছি।”
এটা বলে সজীব আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আমি তার কাছে আকুতি মিনতি করি। কিন্তু না। আমার আকুতি মিনতি তার কানে যায় না। এভাবে বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর কেটে যায়। একদিন সকালে সজীব আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ দেয়। যেটা দেখে আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি।
দিনটি ছিলো শুক্রবার। সকাল সকাল সজীব বেরিয়ে যায়। ছুটির দিনেও তার বেরিয়ে যাওয়ায় অবাক হই না আর। বছর খানেক ধরে এমনটাই করছে। ছুটির দিনেও বাড়ি থাকে না। আমাকে সময় দেয় না। তাই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিলাম। তবে তার ঘন্টা তিনেক পরে সে ফিরে এলো। এত দ্রুত সে আসে না দেখে একটু অবাক হলাম। তবে এটা যে শেষ নয়। আমার অবাক হওয়া আরও বাকি ছিলো। আমাকে অবাক করে সজীবের পিছন থেকে একটি মেয়ে বের হয়। গায়ে তার কালো বোরকা। আমি তাকে দেখে শান্ত গলায় বললাম,“কে ওনি?”
সজীব আমার প্রশ্নের জবাব দেয় না। ইতিমধ্যে শাশুড়ী মা চলে আসে৷ সে এসেই বলে,“দেখি দেখি। আমার নতুন বৌমা চলে এসেছে। তার মুখখানা দেখি।”
এটা শুনে আমি পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সজীবের তো কোন ভাই নেই। দুই বোন আছে। তাহলে তার নতুন বৌমা। আমার মনের মধ্যে জাগা প্রশ্নের জবাব সজীব দেয়। সে বলে,“এটা আমার দ্বিতীয় বউ। তোমার বোনের মতো। আমি চাই তোমরা দু’জন মিলেমিশে থাকো।”
কথাটা শুনে আমি দুই পা পিছিয়ে যাই। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। গত কয়েক বছর ধরেই শাশুড়ী মা, শ্বশুড় সজীবকে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা বলে। আমাকেও বলছিলো তাকে রাজি করাতে। তবে আমি তা করিনি। সেই সঙ্গে আমার বিশ্বাস ছিলো সজীব কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করবে না। আমার ভালোবাসা সে ভাগ হতেই দিবে না। আমার সেই বিশ্বাসটা আজ সজীব ভেঙে দিলো। আমি সেখানে দাঁড়াতে পারলাম। এক দৌঁড়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলাম। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সেই সময়ে সজীব আসে। আমার কাধে হাত রাখে। আমি তার হাতটি সরিয়ে দিয়ে বলি,”আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলে সজীব?”
“আমি তোমাকে ঠকাইনি।
বাবা ডাক শোনার সাধ সবারই আছে। পৃথিবীর প্রত্যেক পুরুষ বাবা হতে চায়। আমিও চেয়েছি। যেহেতু তুমি পারছো না। তাই বিয়ে করলাম। বিষয়টা তুমি স্বাভাবিকভাবে নাও। আমি তোমাদের দু'জনার প্রতিই যথাযথ দায়িত্ব পালণ করবো। দু'জনকে সমান ভালোবাসা দিবো।”
“তাই?
তাকে বিয়ে করার আগেই তো আমার প্রতি সব দায়িত্ব ভুলে গেলে? এখন তাকে নিয়ে এসে বলছো সব দায়িত্ব পালন করবে? দু’জনকে সমান ভালোবাসবে?”
আমার কথায় অবাক হয়ে সজীব বলে,“তোমার দায়িত্ব ভুলে গেছি মানে? কোন দায়িত্ব পালন করিনি?”
“শুধু খাওয়া পড়া দিলেই দায়িত্ব নেওয়া হয় না সজীব৷ এটা তুমিই আমাকে শিখিয়ে ছিলে। আজ সেটা ভুলে গেছো।”
“তুমি একটু বেশি ভাবছো।
বিষয়টা সহজভাবে নাও। দেখবে সবটা সহজ। আমি কোন বিবাদ চাই না। চাই তোমরা দু'জন মিলেমিশে থাকো।”
“বিয়ে করার আগে একবার আমাকে জানাতে পারতে।”
আমার এই কথাটার মাঝে কত অভিমান, কত অভিযোগ ছিলো তা সজীব দেখেও দেখলো না। আমিও কথা বাড়ালাম না। সেদিনই বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। তবে সে করেনি। বাবার ঘরে যে আমার জায়গা হবে না বুঝতে পেরে যাই। এটা সজীব জানতো। তাই তো সে খুশি মনে বিয়ে করেছে। কারণ সে জানে আমি তাকে ছাড়তে পারবো না। আমার তাকে ছাড়া গতি নাই। এই কথাগুলো সে ভালোভাবে বলে আমাকে সবটা মেনে নিতে বললো। আমি কথা বাড়াতে পারলাম না। সবটা শুধু শুনলাম। একটা সময় পর সজীব বলে,“তুমি তোমার জিনিসপত্র নিয়ে পাশের ঘরে যাও। বুঝতেই তো পারছো, নতুন বউ। ওকে ভালো ঘরটা দেওয়া উচিত।”
আমার যে না বলার উপায় নাই। তাছাড়া আমি না বললেও সজীব শুনবে না। যেখানে মানুষটা তার হয়ে গেল। সেখানে ঘরের মায়া করলে হবে। তাই তো না চাইতেও ছাড়তো হলো। এই ঘরটাজুড়ে আমার কত আবেগ, কত স্মৃতি, আমাদের কত সুন্দর মূহুর্ত। সবকিছু সজীব ভুলে গেছে। তাই তো আমাকে এই ঘর থেকে তাড়াতে দু'বার ভাবেনি। অতঃপর আমার জায়গা হলো পাশের ঘরটায়। ঠিক সেদিনের পর বুঝেছি, নিজের ভালোবাসার মানুষ ভাগ করা কতটা যন্ত্রণার। আমার চোখের সামনে আমার ভালোবাসা অন্যকারো সাথে হাসছে, মজা করছে, তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। তাকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। আর আমি। তার বাড়ির চাকর হয়ে গেলাম। শাশুড়ী মা ঘরের সব কাজ করাতো সেটায় দুঃখ ছিলো না। এটা আমার সংসার কাজটা আমিই করবো। কিন্তু না। শাশুড়ী মা এতে থেমে ছিলো না। সে আমাকে দিয়ে আমার সতীনের জামাকাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কাজ করাতো। আর আমার সতীন সে শুয়ে বসে খেতে লাগলো। আমাকে শাশুড়ী মায়ের মতোই হুকুম দিতে ছিলো। এসবে বিরক্ত হয়ে আমি তাকে বলেছিলাম,“আমি তোমার গোলাম নই। হুকুম করবে না।”
ব্যাস সেই কথাটাই কাল হলো। সেদিন সজীব বাড়ি ফেরার পর সে এমন বানিয়ে বানিয়ে বলেছে যে সেদিন প্রথম সজীব আমার গায়ে হাত তোলে। আমার গায়ে হাত তুলে বলে,“তুই তো আমাকে সন্তান দিতে পারলি না। যেই সন্তানের ব্যবস্থা করতে ওকে নিয়ে আসলাম, এখন ওর সঙ্গে বিবাদ করছিস।”
সজীবের সেই ব্যবহারের কথা ভাবলে আজও গায়ে কাটা দেয়। এভাবেই দিন যায়। সাতদিন একসাথে ছিলাম। তার মাঝেই জীবন কতটা যন্ত্রণাময় হতে পারে সেটা বুঝে গেছি। এরই মাঝে সতীনের কথায় বুঝতে পারি, সজীবের সঙ্গে তার দেড় বছরের প্রেমের পর বিয়ে হয়েছে। এটা শুনে আমি আরও একবার ভেঙে পড়লাম। এতদিন অব্দি তাও মনকে বুঝ দিচ্ছিলাম, আমি সন্তান দিতে না পারায়, আমার ব্যর্থতায় সজীবের ভালোবাসা ভাগ হয়েছে। কিন্তু না। শুধুমাত্র সন্তান এখানে বিষয় নয়। যদি হতো তাহলে তার সঙ্গে এত দীর্ঘ প্রেম চলতো না। আসলে সজীব আমার জায়গাটা তাকে দিয়েছিলো বলেই সন্তানের অজুহাত দেখিয়ে তাকে ঘরে তুলেছে। সবটা বুঝতে পেরে আমি আরও ভেঙে যাই। তবে সজীবকে এই নিয়ে কোন প্রশ্ন করি না। না তাকে বলি আমার গর্ভের সন্তানের কথা। হ্যাঁ যেই সন্তানের অজুহাতে তারা আমাকে এত এত কথা শুনিয়েছে, সজীব বিয়ে করেছে সেই সন্তান আমার গর্ভে আসলো। আমি যখন বুঝতে পারি আমি গর্ভবতী তখন আমার সন্তানটাকে অনেক দোষ দিয়েছি।সে আরও কিছুদিন আগে কেন আমার গর্ভে আসলো না। তাহলে এতসব কিছু হতো না। তবে আমি ভুল ছিলাম। সে আমার গর্ভে আরও আগে আসলেও সজীব বদলে যেতো। তার বদলানো পরিবর্তন হতো না। না সে দ্বিতীয় বিয়ে না করে থাকতো। আর সেটা বুঝতে পেরেই সজীবের প্রতি সব ভালোবাসার ইতি টেনে তার ঘর ছাড়ি। বাবা-মায়ের ঘরে জায়গা হবে না জানতাম, তাই দূর সম্পর্কের এক আত্নীয়র কাছে সাহায্য চাই। অতঃপর তার সাহায্য ছোটখাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। তবে হ্যাঁ চলে আসার আগে সজীবকে জানাইনি তার সন্তান আমার গর্ভে। কারণ আমার মনে হয়েছে এই সন্তানের আগমনের কথা জানার অধিকার তার নেই। এই অধিকার সে হারিয়েছে। অথবা বলা যায় তার উপর থাকা চাপা অভিমান থেকেই তাকে সন্তানের কথা জানাইনি।
___
এতক্ষণ মায়ের কথা শুনে আমি এবং খুশি মনমরা হয়ে গেলাম। মায়ের জীবনটা এত কষ্টের। অথচ সে আমাকে কখনো বুঝতে দেয়নি। চেষ্টা করেছে আমাকে ভালো জীবন দেওয়ার। মা কথাগুলো বলতে গিয়ে কেঁদে দেয়। আমি মায়ের চোখের পানি মুছে দেই। মা ম্লান হাসে। সে বলে,“নিজের স্বামীকে অন্য এক মেয়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছি আমি। আমি জানি, এটা কত যন্ত্রণার।”
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন। কেমন হলো?)