Posts

প্রবন্ধ

সম্পদ, সম্পত্তি ও একটি পর্যালোচনা

November 11, 2025

সাজ্জাদুল করিম

179
View

সম্পদ নিয়ে আমাদের আগ্রহের অন্ত নেই। এই পৃথিবীতে বাস করতে হলে সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে। সত্যি বলতে কি সম্পদের জন্যই এই পৃথিবীতে মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা। সম্পদের জন্যই আমাদের এতো পরিশ্রম, এতো সাধনা। হযরত মুহাম্মদ (সা:) সম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে এক হাদিসে বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই সম্পদ। আর পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হচ্ছে সৎ চরিত্রবান নারী’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮৩)। তার একথা নিশ্চিয়ই আমাদেরকে অবাক করবে। কারণ সর্বোত্তম সম্পদ হিসেবে তিনি এমন একটি বিষয়কে সামনে আনলেন যা আমাদের কল্পনাতীত। একইভাবে ‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তী সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অপু বলেছিল-“সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।” এই বাক্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে সম্পত্তি ও সম্পদ তো সমার্থক শব্দ, তাহলে এখানে লেখক শব্দ দুটিকে আলাদাভাবে উল্লেখ করলেন কেন? হ্যাঁ, আভিধানিক দিক দিয়ে যদিও সম্পত্তি ও সম্পদ একই অর্থ প্রদান করে তথাপি এদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ণ পার্থক্য বিদ্যমান। সম্পত্তি ও সম্পদ উভয়ই মূল্যবান হলেও সম্পত্তির তুলনায় সম্পদ আরও বেশি মূল্যবান, আকাঙ্ক্ষিত। একথার বিভিন্ন রকম অর্থ হতে পারে। যেমন- (১) সম্পত্তি হলো এমন জিনিস যার বিনিময় মূল্য আছে অর্থাৎ টাকা-পয়সা বা অর্থমূল্যে যা লাভ করা যায় বা বিনিময় করা যায়। অন্যদিকে সম্পদ হলো অমূল্য অর্থাৎ কোনো কিছুর বিনিময়ে যা লাভ করা যায় না। যেমন- আমাদের জীবন, সময়, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা, মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি ইত্যাদি। এছাড়া আমাদের জীবনের বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যেমন আলো-বাতাস, মাটি- পানি ইত্যাদিকে আমরা কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ বলি, সম্পত্তি বলি না। তার কারণ এগুলোর সত্যিকার বিনিময় মূল্য আমাদের কাছে নেই। (২) আবার এভাবেও বলা যায়- সম্পত্তি হলো এমন বস্তু যা লাভ করতে কোনো চেষ্টা বা পরিশ্রম করতে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- আমরা সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো কিছুর ক্ষেত্রে সম্পদ শব্দ ব্যবহার না করে সম্পত্তি শব্দটি ব্যবহার করি। অন্যদিকে সম্পদ অর্জন করতে হয় অর্থাৎ অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে লাভ করতে হয়। যাই হোক, সম্পদ ও সম্পত্তি উভয়ই আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। জীবন পরিচালনার জন্য এগুলো আবশ্যক। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ধন-সম্পদকে পার্থিব জীবনের শোভা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে (১৮:৪৬)। জীবনকে সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে হলে সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু কথা হলো- সম্পদ সম্পর্কে আমরা কতটা জানি বা সম্পদ বলতে আমরা কী বুঝি? 

২.

সাধারণত সম্পদ বলতে আমরা বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, জায়গা-জমি ইত্যাদি বুঝি কিন্তু অর্থনীতিতে সম্পদ বলতে এমন বস্তু বা দ্রব্যকে বোঝায় যার উপযোগ আছে, যোগান সীমাবদ্ধ এবং যার বাহ্যিক ও হস্তান্তর মূল্য তথা বিনিময় মূল্য আছে। প্রাথমিকভাবে সম্পদ দুই ধরণের যেমন- বস্তুগত সম্পদ (Tangible Asset) ও অবস্তুগত সম্পদ (Intangible Asset)। বস্তুগত সম্পদ বলতে বুঝায় এমন কিছু যার আকার আছে, দেখা যায়, ধরা যায় এবং যা আমাদের জীবন পরিচালনায় মূল্যবান উপকরণ। যেমন: বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, জায়গা-জমি, আসবাবপত্র, ব্যবহার্য সামগ্রী ইত্যাদি। অন্যদিকে অবস্তুগত সম্পদের মধ্যে রয়েছে- আমাদের জীবন, সময়, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, যৌবন, জ্ঞান-বুদ্ধি, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন ইত্যাদি (মুতাসিম বিল্লাহ, সম্পদের চেহারা একাল ও সেকাল)। বস্তুগত সম্পদ সম্পর্কে আমরা জানলেও অবস্তুগত সম্পদ সম্পর্কে আমরা একেবারেই উদাসীন। আমাদের যত চেষ্টা-তদবির, পরিশ্রম-সংগ্রাম সব কিছু বস্তুগত সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে। অবস্তুগত সম্পদ নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তাই নেই। অথচ বস্তুগত সম্পদ প্রয়োজনই হয় অবস্তুগত সম্পদ উপভোগ করার জন্য। 

৩.

অবস্তুগত সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হলো আমাদের জীবন। কেননা জীবন আছে বলেই আমাদের টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। জীবন না থাকলে সম্পদের প্রসঙ্গ অমূলক। এজন্যই আমরা দেখি জীবন যখন বিপন্ন হয়, মৃত্যু যখন অবশ্যম্ভাবী হয় তখন মানুষ তার সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তারপর যেটি মূল্যবান সম্পদ তা হলো ‘সময়’। যদিও সময় জীবনেরই সমার্থক। অর্থাৎ সময়ের এক সামষ্টিক রূপই হলো জীবন। একটি বহুল পরিচিত প্রবাদ রয়েছে- Time is money যা আমরা সবাই জানি। সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে সেটি আমাদের জন্য সম্পদের মতোই মূল্যবান। যারা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করেন সময় তাদের জীবনেই সম্পদ সমতুল্য। যার উদাহরণ আমরা মনীষীদের জীবনী ঘাটলেই পেয়ে যাবো।

জীবন ও সময়ের পরেই ‘শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা’ আমাদের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ যার সত্যিকার বিনিময় মূল্য আমাদের কাছে নেই। মহান স্রষ্টা অত্যন্ত করুণা করে আমাদের এই সম্পদটি দান করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অবশ্যই মানুষকে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত আর কিছুই প্রদান করা হয় নি’ (সুনানে নাসায়ী, ১০৭২) । আর এই কথাটি আমরা তখনই উপলব্ধি করি যখন আমরা অসুস্থ হই। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যখন তার সহায়-সম্পদ, অর্থ-বিত্ত, টাকা-কড়ি তথা সর্বস্বের বিনিময়ে সুস্থতা ফিরে পেতে চায় তখনই সত্যিকারার্থে সে বুঝতে পারে ‘সুস্থতা’ আমাদের জীবনে কত মূল্যবান সম্পদ।

এরপর যেটি আমাদের জীবনকে ঐশ্বর্য্যমন্ডিত করে তা হলো আমাদের যৌবন। মানব জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো তার যৌবনকাল। কারণ সম্পদ অর্জনের জন্য শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে যৌবনে। যেমন অর্থনীতিতে একটি পরিভাষা আছে- Demographic dividend যেখানে একটি দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত বেশি হলে সেদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে থাকে। কাজেই এখান থেকে বিষয়টি পরিস্কার হচ্ছে যে- যৌবনের সাথে ব্যক্তির নিজের ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি যোগসূত্র রয়েছে।   

জ্ঞান-বুদ্ধি তথা মেধা আমাদের জীবনের আরেকটি অন্যতম সম্পদ। কেননা জ্ঞানই মানুষকে সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী করে। জ্ঞান-বুদ্ধি ও মেধা খাটিয়েই মানুষ তার জীবিকা আহরণ করে, ধন-সম্পদ উপার্জন করে। এজন্য আমরা দেখি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় যারা যত এগিয়ে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তত সমৃদ্ধ।  

স্ত্রী-সন্তান তথা পরিবার আমাদের জীবনের আরেকটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যেমন নবীজী (সা:) চরিত্রবান স্ত্রীকে পার্থিব জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ এবং নেককার সন্তানদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জীবনের জন্য কল্যাণকর (সাদাকায়ে জারিয়া) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে সন্তান-সন্ততিকে মানব জীবনের সৌন্দর্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে (আল কুরআন ১৮:৪৬ ও ২৫:৭৪) । এথেকে বুঝা যায় স্ত্রী-সন্তান তথা পরিবার আমাদের জীবনে কত মূল্যবান।

ভালোবাসা, সম্মান ইত্যাদিও সম্পদ হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভালোবাসা, সম্মান ইত্যাদি প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা আমাদের মজ্জাগত। সচেতন বা অবচেতনভাবে আমরা সবাই ভালোবাসা ও সম্মানের জন্য কাঙাল। এজন্যই দেখা যায় প্রিয় মানুষের ভালোবাসা পেতে সর্বস্ব ত্যাগ করতেও আমরা দ্বিধা করি না। অন্যদিকে সম্মান লাভের আশায়ও অনেকেই তার কষ্টার্জিত সম্পদ খরচ করতে কুণ্ঠা বোধ করে না। তাই তো আমরা দেখি সমাজে কেউ যখন সম্পদশালী হয় তখন তার খায়েশ হয় মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান লাভের। আর এজন্য সে কি না করে, দান-খয়রাত করে, সমাজসেবী হিসেবে আবির্ভূত হয়, নেতা হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়, ক্ষমতা লাভের প্রতিযোগিতা করে ইত্যাদি। 

তাছাড়া বিভিন্ন দক্ষতা ও যোগ্যতা (Soft Skill) যেমন- যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা, পরস্পর মিলেমিশে কাজ করার গুণ, নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এজন্যই আমরা দেখি বিভিন্ন দক্ষতা ও গুণের অধিকারী মানুষকে মানব সম্পদ (Human Resource) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অর্থাৎ জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে যে সকল দক্ষতা বা গুণাবলী অর্জন করতে হয় সেগুলোও আমাদের জন্য মূল্যবান সম্পদ।

সর্বোপরি সুখ-শান্তি আমাদের জীবনের পরম সম্পদ। কেননা আমাদের জীবনের যত প্রচেষ্টা-সংগ্রাম, ত্যাগ-তীতিক্ষা সবকিছুর চূড়ান্ত লক্ষ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তথা শান্তি। অর্থাৎ এই জীবনে আমরা একটু ভালো থাকার জন্য, সুখে থাকার জন্য সর্বোপরি শান্তি লাভের অভিপ্রায়ে এত কিছু করি। বাড়ি-গাড়ি, টাকা-কড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, যশ-ক্ষমতা ইত্যাদি যা কিছুই অর্জন করি তার আসল উদ্দেশ্যই হলো শান্তি।   

৪.

এভাবে আমাদের জীবনে আরও অনেক সম্পদ (resource) রয়েছে যা গুনে শেষ করা যাবে না, অথচ আমরা অনেকেই এসকল সম্পদের কথা জানিই না। স্রষ্টা একেক জনকে একেক ধরণের সম্পদ (নেয়ামত) দেন। যেমন কাউকে অর্থ-বিত্ত, কাউকে ক্ষমতা, কাউকে জ্ঞান-প্রজ্ঞা, কাউকে সন্তান-সন্ততি, কাউকে সুখ-সমৃদ্ধি আবার কাউকে একসাথে একাধিক সম্পদও দিয়ে থাকেন। স্রষ্টা আমাকে কোন সম্পদটি দিয়েছেন তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না ও সেটির সঠিক পরিচর্যা না করে সর্বদা হা-হুতাশ করি। ফলস্বরূপ আমাদের জীবিকা সংকীর্ণ হয়, জীবন হতাশাময় ও নিরানন্দ হয়। তাই আসুন সম্পদ নিয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করি এবং আমার জন্য সত্যিকার সম্পদ কোনটি সেটি আবিষ্কার করে জীবনকে তা দিয়ে প্রাচুর্যময় করে তুলি।   

Comments

    Please login to post comment. Login