গ্রামের নাম ছিল ধনেশ্বরীপুর। ছোট্ট, শান্ত একটি গ্রাম — চারপাশে সবুজ ধানক্ষেত, পুকুরে পদ্মফুল, আর বিকেলের দিকে বাতাসে লাউপাতার গন্ধ। সেই গ্রামেই থাকত রাহাত আর নীলা। দুজনেই শৈশবের বন্ধু। একসাথে স্কুলে যেত, মাঠে খেলত, নদীর পাড়ে বসে সূর্য ডোবা দেখত।
সময় গড়াতে গড়াতে বন্ধুত্বটা যেন ধীরে ধীরে অন্য এক রূপ নিল। রাহাত বুঝতে পারল, নীলাকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারে না। কিন্তু নীলা সবসময় বলত, “রাহাত, এখন শুধু পড়াশোনার সময়, ভালো করে মানুষ হবি, তারপর না হয় ভবিষ্যতের কথা ভাবা যাবে।”
রাহাত নীলার কথাটা মনে রাখল। সে শহরে চলে গেল পড়াশোনার জন্য। বছর কেটে গেল পাঁচটা। এর মধ্যে নীলা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছে। রাহাতও চাকরি পেয়েছে ঢাকায়। কিন্তু তারা কেউই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ হারায়নি। প্রতি মাসে একদিন চিঠি লিখত, যদিও এখন সবাই ফোনে কথা বলে — তবুও তাদের চিঠির ভালোবাসা আলাদা ছিল।
একদিন রাহাত ঠিক করল, এবার সে গ্রামে ফিরবে, নীলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। হৃদয়ে কত স্বপ্ন, কত আশা। কিন্তু গ্রামে গিয়ে শুনল নীলা অসুস্থ। তার চোখে জল এসে গেল। ছুটে গেল নীলার বাড়ি।
নীলা বিছানায় শুয়ে আছে, মুখে ম্লান হাসি। রাহাত হাত ধরে বলল, “আমি ফিরে এসেছি, এবার কিছুতেই তোকে ছেড়ে যাব না।” নীলা মৃদু হেসে বলল, “রাহাত, আমি তো জানি তুই ফিরবি। কিন্তু আমি হয়তো এবার যাত্রা করব অন্য পথে... তুই প্রতিশ্রুতি দে, আমার স্বপ্নটা তুই পূরণ করবি — গ্রামের বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করবি।”
রাহাত কেঁদে ফেলল। সেই বিকেলেই নীলা চোখ বন্ধ করল, আর রাহাতের জীবনের আকাশটা নিঃশেষে মেঘে ঢেকে গেল।
আজও রাহাত ধনেশ্বরীপুর স্কুলে পড়ায়। গ্রামের বাচ্চারা তাকে “রাহাত স্যার” বলে ডাকে। বিকেলে পুকুর পাড়ে বসে রাহাত সূর্যাস্ত দেখে — ঠিক যেমনটা সে আর নীলা একসাথে দেখত। তার চোখে তখনো ভেসে ওঠে সেই শেষ বিকেলের প্রতিশ্রুতি।
---