রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। গ্রামের ওপর নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। শুধু দূরের ঝোপে ব্যাঙের ডাক আর পুকুরপাড়ের নারকেল গাছের মাথায় হালকা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। এই নিস্তব্ধতার ভিতর দিয়েই আস্তে আস্তে হাঁটছিল অনিক। তার হাতে ছিল একটি পুরোনো হারমোনিয়াম—মায়ের স্মৃতি।
অনিক ছোটবেলা থেকেই গান ভালোবাসে। কিন্তু জীবনে সবকিছু তার মতো হয়নি। বাবা তাকে গান-বাজনা শেখার সুযোগ দেয়নি। বলত, “গান শিখে পেট ভরবে? পড়াশোনা করো।” অনিক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জীবনের ঝড় তাকে বারবার ধাক্কা দিয়েছে। মাকে হারানোর পর সে বুঝে গেল—যে স্বপ্ন তাকে খুশি রাখে, সেটাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয়।
গত তিন বছর ধরে সে শহরে থাকত। ছোট একটি হোটেলে গান গাইত, কিছু টাকা পেত। কিন্তু সে চেয়েছিল বড় হতে, নিজের গানের অ্যালবাম বের করতে। এজন্য দরকার ছিল টাকা, দরকার ছিল সুযোগ, দরকার ছিল কোনো এক মানুষের বিশ্বাস। কিন্তু এই তিনটিই তার কাছে বড় বিলাসিতা।
আজ অনিক গ্রামে ফিরছে একটাই কারণে—মায়ের রেখে যাওয়া হারমোনিয়ামটা ঠিক করার জন্য। মা বলেছিল, “একদিন তুমি এই হারমোনিয়াম দিয়ে এমন সুর তুলবে, মানুষ চোখ বন্ধ করে শুনবে।” সেই কথাটাই যেন তাকে আবার আকর্ষণ করে টেনে নিয়ে এল।
গ্রামের মোড় ঘুরতেই সে দেখল পাকা রাস্তার পাশে আলো জ্বলছে। গ্রামের পুরোনো কমিউনিটি সেন্টার। সেখানে রাতেও হালকা আলো? কৌতূহল হলো। কাছে যেতেই শুনল—একজন অচেনা মানুষ গান গাইছে। কণ্ঠটা খারাপ না, কিন্তু ভেতরে যেন কিছু নেই… ঠিক যেমন যন্ত্র চলে, কিন্তু প্রাণ নেই।
অনিক দাঁড়িয়ে শুনল। আচমকা ভিতর থেকে একজন চিৎকার করল, “আচ্ছা, আচ্ছা… আর দরকার নাই। তোমার গলায় জোর আছে, কিন্তু সুর নাই। আমরা যে ধরনের গায়ক খুঁজছি, তুমি তা নও।”
তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধ লোক, সঙ্গে কিছু তরুণ। বৃদ্ধ লোকটি গ্রামের বিখ্যাত ব্যবসায়ী—মঈন চৌধুরী। সে নাকি এ বছর একটি বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে, নতুন গায়ক খুঁজছে।
অনিকের বুক একলাফে ধক করে উঠল।
“আপনারা গায়ক খুঁজছেন?”—অনিক জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধ লোকটি তাকে সন্দেহের চোখে দেখল। “তোমার অভিজ্ঞতা?”
অনিক ধীরে ধীরে হারমোনিয়ামের দিকে তাকাল। “অভিজ্ঞতা কম, কিন্তু গান আমার নিঃশ্বাস।”
বৃদ্ধ লোকটি হেসে বলল, “সবাই একই কথা বলে। গান গাও।”
অনিক হারমোনিয়াম খুলে বসল। গভীর শ্বাস নিল। মায়ের মনে করিয়ে দেওয়া কথা মনে পড়ল—গান গাইতে গেলে মনে রাখতে হবে, দুঃখও সুরের অংশ, আনন্দও সুরের অংশ।
তারপর সে শুরু করল…
একটি পুরোনো আধুনিক গান—ধীর, শান্ত, গভীর। তার কণ্ঠে ছিল কষ্টের ছায়া, কিন্তু শেষ লাইনে ছিল আলো। পুরো হল ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এমনকি বাতাসও যেন থেমে গেল।
গান শেষ হতেই বৃদ্ধ লোকটির চোখে জল।
“তুমি… তুমি কোথায় লুকিয়ে ছিলে এতদিন?”—সে অবাক হয়ে বলল।
অনিক শুধু হাসল। “সাহেব, লুকিয়ে ছিলাম না, সুযোগ পাইনি।”
মঈন চৌধুরী তার কাঁধে হাত রাখল। “তোমাকে নিয়েই অনুষ্ঠান হবে। তুমি আমার শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান গায়ক হবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে—এখান থেকেই তোমার আসল যাত্রা শুরু হবে। গ্রামের ছেলেদের শেখাবে, গান কীভাবে আত্মা ছুঁতে পারে সেটা শিখাবে।”
অনিক যেন স্বপ্ন দেখছে। এত বড় সুযোগ? তার বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ। চোখে জল এসে গেল।
পরের দুই মাস অনিক থেমে থাকেনি। দিন-রাত প্র্যাকটিস করেছে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের গান শিখিয়েছে, নিজের হৃদয়ের সব আবেগ দিয়ে নতুন সুর তৈরি করেছে। মায়ের হারমোনিয়াম আবার যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
অনুষ্ঠানের দিন লোকজন আসতে লাগল শত শত। মঞ্চে আলো, তার সামনে মাইক্রোফোন—কিন্তু সে ভয় পেল না। কারণ সে জানত আজ মা দেখছে।
প্রথম গান শুরু হতেই দর্শক নিস্তব্ধ। মাঝপথে হাততালি, শেষে দাঁড়িয়ে অভিবাদন।
ওই রাতেই অনিককে ডেকে নিল একটি মিউজিক কোম্পানি—তারা তার নিজের অ্যালবাম বের করতে চায়। প্রথমবারের মতো অনিক বুঝল, তার স্বপ্ন আর শুধু স্বপ্ন নয়—এটা এখন তার বাস্তব।
রাত শেষে মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ফিসফিস করে বলল, “মা, তোমার সুর আমি খুঁজে পেয়েছি।”
আকাশের হালকা বাতাস যেন মায়ের উত্তর নিয়ে এল—
“তুমি কখনো হারাওনি, অনিক। শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিলে।”
---
আরও গল্প লাগলে, অন্য ধরণে চাইলে, অথবা এই গল্প সম্পাদনা/বাড়াতে চাইলে বলবেন।