। "আমি আমার বাবার পাশে থাকলেও নিরাপদ অনুভব করি না।"
১২ জুন ২০২৪
নাঈমা
"আমি আমার বাবার পাশে থাকলেও নিরাপদ অনুভব করি না।"
কিছুদিন আগেই থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। সেসময় একদিন অদ্ভুত এক মেয়ের সাথে দেখা হয় আমার, যার মতো করে ভাবতে আমি আর কোনো মেয়েকেই দেখিনি। আমি জানিনা মেয়েটা ঠিক না ভুল, কিন্তু কোনো এক কারণে নাম না জানা এই মেয়েটা আমার হৃদয়ের কোনো একজায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে, সে ক্ষত কোনোভাবেই শুকাচ্ছে না। মনে হলো লিখলে ভালো লাগবে, লিখছি তাই।
পরীক্ষা শেষে বাড়িতে ফিরছিলাম, পাশের সিটেই আমার বয়সী একটি মেয়ে। জানিনা কেন, কিন্তু মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হলো এক পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে সে বসে আছে। জগতের সবকিছুর প্রতিই যেন তার তিক্ততা। আমার ক্লান্ত লাগছিলো খুব, তাই গাড়ির পাশে মাথা কাত করে চোখ বুঁজে রইলাম। হঠাৎ মেয়েটা আমাকে বললো, "প্রায় তো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, এই গাড়িতে যখন উঠেছোই, নিশ্চয় দূরে কোথাও যাবে। কেউ নিতে আসবে না তোমাকে? "
আমি বললাম, "আসবে তো। অর্ধেক পথ গিয়ে অপেক্ষা করলে বাবা এসে আমাকে নিয়ে যাবে।"
মেয়েটা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার কৌতূহল হলো, জানার ইচ্ছে হলো এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ। কিন্তু হুট করে অপরিচিত একজনের কাছে তার দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানতে চাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বললো, "বিয়ের প্রস্তাব আসে তোমার জন্য?"
আমি ইতস্তত করে বললাম, "মাঝে মাঝে।"
মেয়েটি বললো, "একটা সময় ছিলো যখন আমার জন্য প্রচুর সম্বন্ধ আসতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা একেবারেই কমে গেছে। এখন হুটহাট কেউ একজন আসলে আমার বাবার ভাবটা এমন থাকে যেন পারলে লোকগুলোকে অনুরোধ করতেন, আমার বোঝাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ।"
আমি বললাম, "এটা হয়তো ভুল ধারণা তোমার। কোনো বাবা-মা এমন হন না।"
মেয়েটি শুনলো বলে মনে হলো না। সে বললো, "আমার বাবা পারলে পথ থেকে হাত জোড় করে মানুষ ধরে এনে আমাকে বিয়ে দেন। সেদিন কি হলো জানো? রাত নয়টায় দু'জন মানুষ এলো আমাদের বাড়ি। আমার বাবা তাদেরকে দেখানোর জন্য আমাকে ডাকতে লাগলেন। যেন আমি ভীষণ স্বস্তা, পারলে মাগনাই দিয়ে দিতেন। অনেক ডাকাডাকির পর আমি গেলাম। লোকগুলো প্রশ্ন করার এক পর্যায়ে কি বললো জানো? বললো, 'আপু, আপনার পায়ের নখগুলো একটু দেখি।' বুঝতে পারলাম না এটা কেমনতর অনুরোধ। আমি অসহায়ের মতো আমার বাবার দিকে তাকালাম, বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম 'আমি এখানে তোমার ভরসায় এসেছি বাবা'। সেদিন আমার পরনে বোরখা ছিলো, বোরখার কারণে পায়ের পাতাও ঢেকে গেছে। আমার বাবা হঠাৎ এগিয়ে এলেন বোরখাটা পায়ের উপর থেকে সরিয়ে আমার নখ দেখাতে। আমি দুই পা পিছিয়ে গেলাম। তারপর নিজেই তাদের নখ দেখালাম। বাবার হাতে ছোট না হয়ে নিজে নিজেকে ছোট করা ঢের ভালো। জানো, আমি খুব প্রতিবাদী মেয়ে। সেদিন আমার কি উচিত ছিলো না কিছু বলে ওই শয়তানগুলোর মুখ বন্ধ করা? আমি করিনি, কারণ বড় কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই, আমার বাবাই আমাকে ততোটা অযোগ্য করে প্রকাশ করেছেন তাদের কাছে।
আমাকে দেখার পর লোকগুলো বললো, মেয়ে তো মাশাল্লাহ লম্বা-চওড়ায় ভালোই আছে। দেখি ওর জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারি কিনা। আমার ইচ্ছে হলো শয়তানগুলোর গালে কষে দুই চড় মেরে বলি, 'আমার ব্যাবস্থা করার তুই কে-রে হারামজাদা?' কিন্তু আমি কিছুই বলিনি, সুবোধ বালিকার মতো চলে এলাম সেখান থেকে।"
আমার মনে হলো মেয়েটা যেন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। তাই তাকে বললাম, "আমি মেনে নিচ্ছি পা দেখাতে বলাটা তোমার জন্য অপমানজনক হয়েছে। কিন্তু তুমি যতোটুকু রিএক্ট করছো, ততোটুক বোধহয় নয়।"
মেয়েটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে, তারপর বললো, "সেটা নিতে পারার ব্যপার। আমাদের পাড়ার অশিক্ষিত ছালেহাকে পা, চুল, হেঁটে দেখাতে বললে সে স্বাচ্ছন্দ্যে দেখাবে। কারণ তার মাইন্ডটা ছোটবেলা থেকেই সেভাবে সেট করা। কিন্তু আমি ছালেহা না, আমি আমার বাবাকে দেখে বড় হলে হয়তো ছালেহাই হতাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমি বড় হয়েছি আমার মাকে দেখে।
আচ্ছা, বিয়ের আগে মেয়েদের আস্থার জায়গা কোনটি জানো? বাবা। মেয়েরা তার জীবন সেই বাবার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। কিন্তু এও তো কথা, এ জীবনের ভার সওয়ার শক্তিটুকু সেই বাবার আছে কিনা! তোমার বাবা যদি দূর্বল চিত্তের হয়, তুমি পারবে তার উপর বিশ্বাস রেখে মুখ বুজে বসে থাকতে? আমি ভালো মেয়েই ছিলাম, বিশ্বাস করো। আমিও বাবা মায়ের সুবোধ বালিকা হতে চেয়েছিলাম৷ বাধ্য সন্তান হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার আস্থার জায়গাটা বড্ড নড়বড়ে, আমি ভরসা পাই না। নিজের উপর বরং আমি আরেকটু ভালো ভরসা করতে পারি। পৃথিবীতে পোড়াবার জিনিসের তো অভাব নেই, বাবার কেন সন্তান জন্ম দিয়ে তাকেই পোড়াতে হবে?"
আমি প্রশ্ন করার জন্যই করলাম, 'বাড়িতে একাই যাবে?'
মেয়েটি বললো, "আমার কষ্ট কি জানো, এই যে তোমার বাবা আসছে তোমাকে নিতে। তুমি তো খুব নিশ্চিন্ত, তাই না? কিন্তু আমার নিশ্চিন্ত হওয়ার তেমন কেউ নেই। আমার বাবা আমাকে নিতে আসলে আমি বরং আতঙ্কে থাকি। পথে আবার কোন অস্বস্তির মধ্যে ফেলে আমাকে৷ আল্লাহ চান তো, আমি বরং নিজেকে আরেকটু ভালো রক্ষা করতে পারবো। জানো, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভিলেন আমার বাবা? কারণ তিনিই আমার ভেতরকার খারাপটাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনেছেন। তুমি হয়তো ভাবছো সামান্য এক পা দেখানো নিয়ে আমি এতো কঠিন কথা বলছি কেন? কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো, ভালো কিছু প্রত্যাশার জায়গা থেকে মানুষ যখন খারাপ কিছু পায় তখন খুব লাগে। ঘেন্না ধরে যায় সেই প্রত্যাশার মানুষটির উপর। আর এমন খারাপ কিছু যদি রোজই পায়, তবে তো কথাই নেই। আচ্ছা বলো তো, বাবা হয়েছে বলেই কি তাদের অন্যায় দেখেও ছ্যাঁচড়ামি করতে হবে? আমিতো ওদের পোষ্য কুকুর নয় যে লাথি খেয়েও ফের তার পা চাটবো। আমি আল্লাহর কাছে সবসময়ই একটা কথা বলি, কখনো কোনো অন্যায়কারীর কাছে আমাকে যেন মাথা নত করতে না হয়। হোক সে আমার বাবা। যে বাবা সন্তানের আদর্শ হতে পারে না, সে কোনো বাবাই নয়।"
এতোক্ষণের কথায় কখনো মেয়েটার স্বর কখনো ঝাঁঝালো, কখনো তীক্ত, কখনো বেদনার্ত ছিলো। আর আমি? আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, সাথে বেদনার্তও। আমি কিছুই প্রকাশ করলাম না, কেবল মেয়েটার কথা শুনে যাচ্ছিলাম।
মেয়েটার নেমে যাওয়ার সময় হয়েছিলো। সে নামার আগে আমাকে বললো, "কথাগুলো তোমাকে বললাম কেন জানো? কারণ আমার বলে হালকা হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু পরিচিত কারো কাছে নয়। এমন একজনকে বলতে চেয়েছিলাম যার সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। যা-ই হোক না কেন, পরিবারের মানুষকে পরিচিত কারো কাছে ছোট করলে নিজেকেই ছোট হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন। কিন্তু আমার নামটাও তুমি জানো না, তুমি এ ঘটনা কাউকে বললেও আমার কিছু আসবে যাবে না। কারণ তারা কেউ আমাকে বা আমার পরিবারকে চেনে না। এই হচ্ছে অপরিচিত ভ্রমণ সঙ্গীর সাথে দুঃখ শেয়ার করার ভালো দিক। আচ্ছা গেলাম, ভালো থেকো তুমি।"
মেয়েটা মাঝপথে নেমে গেলো। আমি ভাবলাম, সম্প্রতি থাপ্পড় নামে দেখা এক মুভির কথা। এই মুভিতে একজন দায়িত্বশীল স্ত্রীকে তার স্বামী একটি থাপ্পড় দেয়। এরপর প্রথমবারের মতো স্ত্রীর মনের গহীনে উঠে আসে মাথা উঁচু রেখে বাঁচা, সুখের সঙ্গে সম্মানেরও প্রয়োজনীয়তা বোধ। আর এই এক থাপ্পড়ই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সের কারণ হয়। সবাই ভাবলো, কেবল একটি থাপ্পড় ডিভোর্সের কারণ! কিন্তু যারা সত্যিকারার্থেই মেয়েটির ভাবনা বুঝেছে, তারা জানে সে ভুল কিছু করেনি।
এই মেয়েটার ক্ষেত্রেও তাই, প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম মেয়েটা বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো সে কিভাবে নিচ্ছে, কিভাবে ভাবছে। তার ভাবনার সাথে তার বলা কথাগুলো অন্যায় কিছু নয় বলেই মনে করি আমি।
এর মধ্যেই এশার নামাজের আজান দিয়েছে। পথ এখনো অনেক বাকি। রাস্তাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি নামাজ পড়লাম। আমার ভেতর কেমন এক ব্যথা অনুভব করলাম। হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, "পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই"। আমার মনে হলো, পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ যেমন আছে, তেমনি অসংখ্য খারাপ বাবাও আছে। আমি মনে মনে আল্লাহর কাছে চাইলাম, একজন খারাপ মানুষ যেন কখনো কোনো সন্তানের বাবা না হয়।
কিছুদিন আগেই থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। সেসময় একদিন অদ্ভুত এক মেয়ের সাথে দেখা হয় আমার, যার মতো করে ভাবতে আমি আর কোনো মেয়েকেই দেখিনি। আমি জানিনা মেয়েটা ঠিক না ভুল, কিন্তু কোনো এক কারণে নাম না জানা এই মেয়েটা আমার হৃদয়ের কোনো একজায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করে গেছে, সে ক্ষত কোনোভাবেই শুকাচ্ছে না। মনে হলো লিখলে ভালো লাগবে, লিখছি তাই।
পরীক্ষা শেষে বাড়িতে ফিরছিলাম, পাশের সিটেই আমার বয়সী একটি মেয়ে। জানিনা কেন, কিন্তু মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হলো এক পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে সে বসে আছে। জগতের সবকিছুর প্রতিই যেন তার তিক্ততা। আমার ক্লান্ত লাগছিলো খুব, তাই গাড়ির পাশে মাথা কাত করে চোখ বুঁজে রইলাম। হঠাৎ মেয়েটা আমাকে বললো, "প্রায় তো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, এই গাড়িতে যখন উঠেছোই, নিশ্চয় দূরে কোথাও যাবে। কেউ নিতে আসবে না তোমাকে? "
আমি বললাম, "আসবে তো। অর্ধেক পথ গিয়ে অপেক্ষা করলে বাবা এসে আমাকে নিয়ে যাবে।"
মেয়েটা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার কৌতূহল হলো, জানার ইচ্ছে হলো এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ। কিন্তু হুট করে অপরিচিত একজনের কাছে তার দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানতে চাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বললো, "বিয়ের প্রস্তাব আসে তোমার জন্য?"
আমি ইতস্তত করে বললাম, "মাঝে মাঝে।"
মেয়েটি বললো, "একটা সময় ছিলো যখন আমার জন্য প্রচুর সম্বন্ধ আসতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা একেবারেই কমে গেছে। এখন হুটহাট কেউ একজন আসলে আমার বাবার ভাবটা এমন থাকে যেন পারলে লোকগুলোকে অনুরোধ করতেন, আমার বোঝাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ।"
আমি বললাম, "এটা হয়তো ভুল ধারণা তোমার। কোনো বাবা-মা এমন হন না।"
মেয়েটি শুনলো বলে মনে হলো না। সে বললো, "আমার বাবা পারলে পথ থেকে হাত জোড় করে মানুষ ধরে এনে আমাকে বিয়ে দেন। সেদিন কি হলো জানো? রাত নয়টায় দু'জন মানুষ এলো আমাদের বাড়ি। আমার বাবা তাদেরকে দেখানোর জন্য আমাকে ডাকতে লাগলেন। যেন আমি ভীষণ স্বস্তা, পারলে মাগনাই দিয়ে দিতেন। অনেক ডাকাডাকির পর আমি গেলাম। লোকগুলো প্রশ্ন করার এক পর্যায়ে কি বললো জানো? বললো, 'আপু, আপনার পায়ের নখগুলো একটু দেখি।' বুঝতে পারলাম না এটা কেমনতর অনুরোধ। আমি অসহায়ের মতো আমার বাবার দিকে তাকালাম, বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম 'আমি এখানে তোমার ভরসায় এসেছি বাবা'। সেদিন আমার পরনে বোরখা ছিলো, বোরখার কারণে পায়ের পাতাও ঢেকে গেছে। আমার বাবা হঠাৎ এগিয়ে এলেন বোরখাটা পায়ের উপর থেকে সরিয়ে আমার নখ দেখাতে। আমি দুই পা পিছিয়ে গেলাম। তারপর নিজেই তাদের নখ দেখালাম। বাবার হাতে ছোট না হয়ে নিজে নিজেকে ছোট করা ঢের ভালো। জানো, আমি খুব প্রতিবাদী মেয়ে। সেদিন আমার কি উচিত ছিলো না কিছু বলে ওই শয়তানগুলোর মুখ বন্ধ করা? আমি করিনি, কারণ বড় কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই, আমার বাবাই আমাকে ততোটা অযোগ্য করে প্রকাশ করেছেন তাদের কাছে।
আমাকে দেখার পর লোকগুলো বললো, মেয়ে তো মাশাল্লাহ লম্বা-চওড়ায় ভালোই আছে। দেখি ওর জন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারি কিনা। আমার ইচ্ছে হলো শয়তানগুলোর গালে কষে দুই চড় মেরে বলি, 'আমার ব্যাবস্থা করার তুই কে-রে হারামজাদা?' কিন্তু আমি কিছুই বলিনি, সুবোধ বালিকার মতো চলে এলাম সেখান থেকে।"
আমার মনে হলো মেয়েটা যেন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। তাই তাকে বললাম, "আমি মেনে নিচ্ছি পা দেখাতে বলাটা তোমার জন্য অপমানজনক হয়েছে। কিন্তু তুমি যতোটুকু রিএক্ট করছো, ততোটুক বোধহয় নয়।"
মেয়েটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে, তারপর বললো, "সেটা নিতে পারার ব্যপার। আমাদের পাড়ার অশিক্ষিত ছালেহাকে পা, চুল, হেঁটে দেখাতে বললে সে স্বাচ্ছন্দ্যে দেখাবে। কারণ তার মাইন্ডটা ছোটবেলা থেকেই সেভাবে সেট করা। কিন্তু আমি ছালেহা না, আমি আমার বাবাকে দেখে বড় হলে হয়তো ছালেহাই হতাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমি বড় হয়েছি আমার মাকে দেখে।
আচ্ছা, বিয়ের আগে মেয়েদের আস্থার জায়গা কোনটি জানো? বাবা। মেয়েরা তার জীবন সেই বাবার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। কিন্তু এও তো কথা, এ জীবনের ভার সওয়ার শক্তিটুকু সেই বাবার আছে কিনা! তোমার বাবা যদি দূর্বল চিত্তের হয়, তুমি পারবে তার উপর বিশ্বাস রেখে মুখ বুজে বসে থাকতে? আমি ভালো মেয়েই ছিলাম, বিশ্বাস করো। আমিও বাবা মায়ের সুবোধ বালিকা হতে চেয়েছিলাম৷ বাধ্য সন্তান হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার আস্থার জায়গাটা বড্ড নড়বড়ে, আমি ভরসা পাই না। নিজের উপর বরং আমি আরেকটু ভালো ভরসা করতে পারি। পৃথিবীতে পোড়াবার জিনিসের তো অভাব নেই, বাবার কেন সন্তান জন্ম দিয়ে তাকেই পোড়াতে হবে?"
আমি প্রশ্ন করার জন্যই করলাম, 'বাড়িতে একাই যাবে?'
মেয়েটি বললো, "আমার কষ্ট কি জানো, এই যে তোমার বাবা আসছে তোমাকে নিতে। তুমি তো খুব নিশ্চিন্ত, তাই না? কিন্তু আমার নিশ্চিন্ত হওয়ার তেমন কেউ নেই। আমার বাবা আমাকে নিতে আসলে আমি বরং আতঙ্কে থাকি। পথে আবার কোন অস্বস্তির মধ্যে ফেলে আমাকে৷ আল্লাহ চান তো, আমি বরং নিজেকে আরেকটু ভালো রক্ষা করতে পারবো। জানো, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভিলেন আমার বাবা? কারণ তিনিই আমার ভেতরকার খারাপটাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনেছেন। তুমি হয়তো ভাবছো সামান্য এক পা দেখানো নিয়ে আমি এতো কঠিন কথা বলছি কেন? কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো, ভালো কিছু প্রত্যাশার জায়গা থেকে মানুষ যখন খারাপ কিছু পায় তখন খুব লাগে। ঘেন্না ধরে যায় সেই প্রত্যাশার মানুষটির উপর। আর এমন খারাপ কিছু যদি রোজই পায়, তবে তো কথাই নেই। আচ্ছা বলো তো, বাবা হয়েছে বলেই কি তাদের অন্যায় দেখেও ছ্যাঁচড়ামি করতে হবে? আমিতো ওদের পোষ্য কুকুর নয় যে লাথি খেয়েও ফের তার পা চাটবো। আমি আল্লাহর কাছে সবসময়ই একটা কথা বলি, কখনো কোনো অন্যায়কারীর কাছে আমাকে যেন মাথা নত করতে না হয়। হোক সে আমার বাবা। যে বাবা সন্তানের আদর্শ হতে পারে না, সে কোনো বাবাই নয়।"
এতোক্ষণের কথায় কখনো মেয়েটার স্বর কখনো ঝাঁঝালো, কখনো তীক্ত, কখনো বেদনার্ত ছিলো। আর আমি? আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, সাথে বেদনার্তও। আমি কিছুই প্রকাশ করলাম না, কেবল মেয়েটার কথা শুনে যাচ্ছিলাম।
মেয়েটার নেমে যাওয়ার সময় হয়েছিলো। সে নামার আগে আমাকে বললো, "কথাগুলো তোমাকে বললাম কেন জানো? কারণ আমার বলে হালকা হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু পরিচিত কারো কাছে নয়। এমন একজনকে বলতে চেয়েছিলাম যার সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। যা-ই হোক না কেন, পরিবারের মানুষকে পরিচিত কারো কাছে ছোট করলে নিজেকেই ছোট হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন। কিন্তু আমার নামটাও তুমি জানো না, তুমি এ ঘটনা কাউকে বললেও আমার কিছু আসবে যাবে না। কারণ তারা কেউ আমাকে বা আমার পরিবারকে চেনে না। এই হচ্ছে অপরিচিত ভ্রমণ সঙ্গীর সাথে দুঃখ শেয়ার করার ভালো দিক। আচ্ছা গেলাম, ভালো থেকো তুমি।"
মেয়েটা মাঝপথে নেমে গেলো। আমি ভাবলাম, সম্প্রতি থাপ্পড় নামে দেখা এক মুভির কথা। এই মুভিতে একজন দায়িত্বশীল স্ত্রীকে তার স্বামী একটি থাপ্পড় দেয়। এরপর প্রথমবারের মতো স্ত্রীর মনের গহীনে উঠে আসে মাথা উঁচু রেখে বাঁচা, সুখের সঙ্গে সম্মানেরও প্রয়োজনীয়তা বোধ। আর এই এক থাপ্পড়ই শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সের কারণ হয়। সবাই ভাবলো, কেবল একটি থাপ্পড় ডিভোর্সের কারণ! কিন্তু যারা সত্যিকারার্থেই মেয়েটির ভাবনা বুঝেছে, তারা জানে সে ভুল কিছু করেনি।
এই মেয়েটার ক্ষেত্রেও তাই, প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম মেয়েটা বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো সে কিভাবে নিচ্ছে, কিভাবে ভাবছে। তার ভাবনার সাথে তার বলা কথাগুলো অন্যায় কিছু নয় বলেই মনে করি আমি।
এর মধ্যেই এশার নামাজের আজান দিয়েছে। পথ এখনো অনেক বাকি। রাস্তাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি নামাজ পড়লাম। আমার ভেতর কেমন এক ব্যথা অনুভব করলাম। হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, "পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই"। আমার মনে হলো, পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ যেমন আছে, তেমনি অসংখ্য খারাপ বাবাও আছে। আমি মনে মনে আল্লাহর কাছে চাইলাম, একজন খারাপ মানুষ যেন কখনো কোনো সন্তানের বাবা না হয়।