পোস্টস

চিন্তা

ইসলাম ও বহুবিবাহ প্রসঙ্গ

২৯ জুন ২০২৪

মোহাম্মদ বাহা উদ্দিন

বিবাহ মানব জিবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। মানব জাতির বংশবৃদ্ধি, সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা, সামাজ চারিত উপায়ে জৈবিক চাহিদা মেটানো এবং সমাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় বিবাহের গুরুত্ব অসীম। 
প্রাচীন এবং মধ্যযুগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এক সময় নারীকে একান্ত বিনোদনের বস্তু হিসেবে পরিগনিত হতো। ফলে পুরুষরা অসংখ্য বিয়ে এবং কৃতদাসী নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। মধ্যযুগ পর্যন্ত নানা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে (এমন কি মুসলিম সমাজেও) ধনী,  রাজা বা গোত্রপ্রধানের অসংখ্য স্ত্রী এবং দাসী থাকতো আর একাধিক স্ত্রী থাকা ছিলো ডালভাতসম। অপরদিকে বিবাহ পরবর্তী প্রয়োজনে বিধিসম্মত বিচ্ছেদ ব্যাবস্থা, সম্পদে স্ত্রী, কন্যা বা মা হিসেবে অধিকার, খোরপোষসহ নারীর সামাজিক বা অর্থনৈতিক অধিকারের কোন বলাই ছিলো না। জাহেলিয়াত নাম অন্ধকার যুগ এবং আধুনা নানা পৌত্তলিক সমাজেও কন্যা সন্তান মানেই অশুভ বলে চিহ্নিত হতো। ইসলাম এসে এসকল অনাচারের বিরুদ্ধচারন করে এবং সমাজে একটি শৃঙ্খলিত রীতি প্রচলন করে। ফলে, সম্পদে নারীর অধিকার, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিধিসম্মত বিচ্ছেদের সুযোগ, বিধাবা এবং পরিত্যাক্ত বিবাহ, মোহরানা নামক রক্ষাকবচ এবং স্ত্রী অধিকারের ধর্মীয় বিধির প্রচলন ঘটে। নিরুৎসাহিত হয় সতীদাহ, দেবদাসী, বলি- বিসর্জন, যৌতুক এবং কৌলিন্য প্রথার নানা অনাচার।

যুগে যুগে সমাজ কাঠামো নানাভাবে বদলায়, সভ্যতার উৎকর্ষে সকল সমাজেই এখন নারীর অধিকার কম-বেশ প্রতিষ্ঠিত। সতীদহ, বহুবিবাহ প্রথা এবং দাসী প্রথা সমাজ হতে বিলুপ্ত। অন্যদিকে, একান্নবর্তী পরিবার প্রথায় ভাঙ্গন, জনসংখ্যার বিষ্পোরণের ভয়াবহতাজনিত কারনে খাদ্য, বাসস্থান এবং চাকুরী বা উপার্জনের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় এবং স্ত্রী-সন্তানদের অধিকার, শিক্ষা ইত্যাদি সুযোগ বিবেচনায় একবিবাহ এবং সীমিত সন্তান গ্রহন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তদুপরি, আজকাল সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল কুরআনে বিবাহ সম্পর্কিত বর্ণনায় মাসনা-সুলাসা ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগের নানাবিধ ব্যাখ্যা করে বিলুপ্ত বহুবিবাহকে পুনর্জীবন দান করতে আগ্রহী। আর এতে সর্বাধিক অগ্রগামি কিছু অতিরক্ষণশীল নারীবিদ্বেষী দল যারা যুগ-বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এবং কিছু হুজুগে বাঙ্গালী যারা হয় পুরুষতান্ত্রিক মানসিক সংকীর্ণতায় ভোগেন কিংবা বেহুদা জগাখিচুরি আয়োজন নিজের ব্যাস্ত রাখতে পছন্দ করেন। অত্র আলোচনার উদ্দেশ্য হলো ইসলামে বহুবিবাহ সর্ম্পকিত বাস্তবতা বর্ণনা।

ইসলামে বিবাহ-বিধি:
ইসলামে বিবাহ বিধি একাধিক কোরআনের বাণী, হাসিদের বর্ণনা এবং ফিকাহের ব্যাখ্যা হতে বর্ণিত। বিবাহ পরিপূর্ণ সামর্থ্যবান পুরুষ (শারিরীক এবং আর্থিকভাবে) ব্যাক্তির জন্য সুন্নত, বিবাহ অন্যথা বিপথে যাওয়ার আশংকাজনক পরিস্থিতিতে ফরজ বা ওয়াজিব; অসামর্থ্যবান পুরুষের জন্য মাত্রাভেদে মাকরুহ (নিন্দনীয়) এবং শারিরীকভাবে অক্ষম ব্যাক্তির জন্য হারাম। তদুপরি বিয়েতে নারী-পুরুষের স্পষ্ট (বর্তমানে) সম্মতি, অভিভাবকের সম্মতি, সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান বিবেচনায় কুফু (সমতা) প্রয়োজনীয় শর্ত।

বহুবিবাহ প্রসঙ্গ:
ইসলামে বিবাহবিধি প্রসঙ্গিত অন্যতম বর্ণনা হলো পবিত্র কুআনের নিন্মোক্ত আয়াত:
ﻭَﺇِﻥْ ﺧِﻔْﺘُﻢْ ﺃَﻻَّ ﺗُﻘْﺴِﻄُﻮﺍْ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻴَﺘَﺎﻣَﻰ ﻓَﺎﻧﻜِﺤُﻮﺍْ ﻣَﺎ ﻃَﺎﺏَ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀ ﻣَﺜْﻨَﻰ ﻭَﺛُﻼَﺙَ ﻭَﺭُﺑَﺎﻉَ ﻓَﺈِﻥْ ﺧِﻔْﺘُﻢْ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌْﺪِﻟُﻮﺍْ ﻓَﻮَﺍﺣِﺪَﺓً ﺃَﻭْ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﺃَﻳْﻤَﺎﻧُﻜُﻢْ ﺫَﻟِﻚَ ﺃَﺩْﻧَﻰ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌُﻮﻟُﻮﺍْ ‏( 4:3 )“আর যদি তোমরা ইয়াতিমদের (মেয়েদের) সাথে বেইনসাফী করার ব্যাপারে ভয় করো, তাহলে যেসব মেয়েদের তোমরা পছন্দ করো তাদের মধ্যে থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করো৷ কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশংকা করো, তাহলে একজনকেই বিয়ে করো৷ অথবা তোমাদের অধিকারে যেসব মেয়েরা আছে তাদেরকে বিয়ে করো৷ বেইনসাফীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটিই অধিকতর সঠিক পদ্ধতি৷” [আন-নিসা, ৪: ৩]

বহুবিবাহের বৈধতা প্রসংগে উক্ত আয়াতের একটি বিশেষ অংশ
ﻓَﺎﻧﻜِﺤُﻮﺍْ ﻣَﺎ ﻃَﺎﺏَ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀ ﻣَﺜْﻨَﻰ ﻭَﺛُﻼَﺙَ ﻭَﺭُﺑَﺎﻉ
"তাহলে যেসব মেয়েদের তোমরা পছন্দ করো তাদের মধ্যে থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করো" কে-ই বহুবিবাহের বৈধতা রেফারেন্স হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় শর্তসাপেক্ষে ইসলামে একাধিক বিবাহ অবৈধ নয় তবুও উক্ত আয়াতটুকু পুরোপুরি লক্ষ্য করলে সহজেই বোধগম্য হয় যে, বহুবিবাহকে কখনোই ইসলামে উৎসাহিত করা হয় নি। 
প্রথমত, উক্ত আয়াতটি সমাজে সম্পদের লোভে নিকটতাত্মীয় কর্তৃক ইয়াতিম নারীকে বিবাহ এবং সম্পদ ও অধিকার রক্ষার তাগিদ প্রদানে অবতীর্ণ। এটি বহুবিবাহ খুব প্রয়োজনীয় অথবা উত্তম এমন বর্ণনা প্রদান করা হয় নি। সমাজে বিধবা-বিপত্নীক নারী, সন্তান ধারনে অক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নানা ভিন্নতায় একাধিক বিবাহের প্রয়োজন হলে তখন পরিপূর্ণ ইনসাফ তথা ন্যায্যতা প্রদানপূর্বক শর্তসাপেক্ষে একাধিক বিবাহের অনুমতি প্রদান করে।

২. মাসানা-সুলাসার আয়াতে নিম্নোক্ত উক্তিটিও রয়েছে:
ﻓَﻮَﺍﺣِﺪَﺓً ﺃَﻭْ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﺃَﻳْﻤَﺎﻧُﻜُﻢْ ﺫَﻟِﻚَ ﺃَﺩْﻧَﻰ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌُﻮﻟُﻮﺍْ
ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশংকা করো, তাহলে একজনকেই বিয়ে করো৷ অথবা তোমাদের অধিকারে যেসব মেয়েরা আছে তাদেরকে বিয়ে করো৷ বেইনসাফীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটিই অধিকতর সঠিক পদ্ধতি৷” [সূরা আন-নিসা, ৪: ৩)

৩. উল্লেখ্য আয়াতে দুটি শব্দ রয়েছে। একটি أَدْنَىٰ এটি دُنُوٌ ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ হয় নিকটতর। দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছেঃ لَا تَعُولُوا যা عال শব্দ হতে উৎপন্ন, অর্থ ঝুঁকে পড়া। এখানে শব্দটি অসংগতভাবে ঝুঁকে পড়া এবং দাম্পত্য জীবনে নির্যাতনের পথ অবলম্বন করা অর্থে ব্যবহৃত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এ আয়াতে তোমাদের যা বলা হল যে, সমতা বজায় রাখতে না পারার আশংকা থাকলে এক স্ত্রী নিয়েই সংসারযাত্রা নির্বাহ কর কিংবা শরীআতসম্মত ক্রীতদাসী নিয়ে সংসার কর; এটা এমন এক পথ যা অবলম্বন করলে তোমরা যুলুম থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘনের সম্ভাবনাও দূর হবে। تَعُولُوا শব্দের দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ হতে পারে মিসকীন হয়ে যাওয়া। এর সপক্ষে সূরা আত-তাওবার ২৮ নং আয়াতে عَيْلَةً শব্দটি এসেছে। সেখানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে দারিদ্রতা। ইমাম শাফেয়ী বলেন, এর অর্থ, যাতে তোমাদের পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। [ফাতহুল কাদীর]

৪. অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে:
تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ] অর্থাৎ ‘‘তোমরা যতই সাগ্রহে চেষ্টা কর না কেন, স্ত্রীদের মাঝে ন্যায়পরায়ণতা কখনই বজায় রাখতে পারবে না। তবে তোমরা কোন এক জনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না এবং অপরকে ঝোলানো অবস্থায় ছেড়ে দিও না।’’ (সূরা নিসাঃ ১২৯)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একাধিক বিবাহ করে স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা বজায় না রাখা বড়ই অনুচিত ও বিপজ্জনক ব্যাপার। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তির দু’টি স্ত্রী আছে, কিন্তু সে তন্মধ্যে একটির দিকে ঝুঁকে যায়, এরূপ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তার অর্ধদেহ ধসা অবস্থায় উপস্থিত হবে।’’ (আহমাদ ২/৩৪৭, আসহাবে সুনান, হাকেম ২/১৮৬, ইবনে হিব্বান ৪১৯৪নং) সুতরাং, ইসলাম কখনোই মাসনা সুলাসার নামে বহুবিবাহকে উৎসাহ দেয় না। বরং প্রাচীন/মধ্য যুগে যখন পুরুষরা শত শত বিয়ে করতো/ তখন তাকে নূন্যতম সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করার প্রয়াসে এই আয়াত বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করে এবং উপরন্তু দুটি আয়াতের শেষের বক্তক্য মতে, এক নারীকেই বিবাহ করাকেই ইসলাম উৎসাহিত করে।
অনেক ধর্মীয় বিধানে যুগোপযোগীতা এবং সমাজ বেধে ভিন্নতর হয়। যেমন, আগে প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে নারীরদের আলাদা কাতার হলেও তা বর্তমানে সমাজ বাস্তবতা বিবেচনায় নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গো-মাংস হালাল হলেও ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখতে এবং দাঙ্গা রুখতে গরু ব্যতীত অন্য প্রাণী কুরবানী এবং গো-মাংস ব্যাতীত অন্য কিছু ভক্ষনে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। বর্তমান সমাজে জনসংখ্যার আধিক্য একটি প্রদানতম সমস্যা। পৃথিবীতে দেশ ও জাতির গন্ডিরেখা সীমাবদ্ধ হওয়া, জনসংখ্যার বৃদ্ধির তুলনায় সম্পদ এবং কর্মসংস্থান সীমিত হয়ে গিয়েছে।  সম্পদ ও ভূমির তুলনায় অধিক জনসংখ্যার বোঝা বইতে বইতে বাংলাদেশ ন্যূজ। অধিকন্তু  কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থার ভাঙ্গনে এবং শিল্পভিত্তিক আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোতে অত্যধিক জনসংখ্যা একান্ত বোঁঝায় পরিনত হয়েছে। আধুনা ৪র্থ শিল্প বিল্পবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি, আইওটি, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ইত্যাদী মানুষের প্রতাগত কর্ম-সংস্থান হুমকিতে ফেলেছে। যুগ বিবর্তনে দাস-দাসী প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে এবং আধুনিকতা উত্তর সমাজে বহুবিবাহ একটি ঘৃণিত ব্যবস্থায় পরিনত হয়েছে। সমাজে স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদ এবং শিক্ষা-অধিকারে ন্যাযত্যা নিশ্চিতকরন এবং বাংলাদেশসহ আফ্রিকা ভিন্ন বিশ্বজুড়েই একবিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় ইসলামে বহুবিবাহ সুন্নত, উত্তম ইত্যাদীর তমকা দেয়া এবং তা প্রচার করা  ইত্যাদি অত্যন্ত গর্হিত এবং দমন করা উচিত। সমাজে বর্তমানে এক শ্রেনী ১ম স্ত্রী বিদ্যমান তাকা সত্ত্বেও নানা ঠুকনো অজুহাতে ২য়/৩য় বিবাহের পয়গাম শোনাচ্ছে, অথচ এসবের মর্মে তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বা বিশেষ পরিস্থিতির শিকার নারীদের ২য়/৩য় বিবাহ করে করে উপপত্নী বানানো, কৌশলে গৃহপরিচারিকার শূণ্যতা পূরণ এবং অযাচিত রিরংসা পূরণে ব্রতী হওয়া। ফলে, মাসনা-সুলাসার আড়ালে তথাকথিত বহুবিবাহের বিস্তার মুলত ধর্মের অপব্যাখ্যা করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রসারের প্রয়াস।