“আল্লাহ মহান আল্লাহ মহীয়ান
আল্লাহ রাহিম ও রহমান
আল্লাহ বিধান আল্লাহ বিধিয়ান
আল্লাহ দরদি ও দয়াবান”
আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসার নাম ‘তাকওয়া’ এটাও এবাদত। তাকওয়া হলো আরবি শব্দ। শব্দটির পরিভাষার ব্যাপকতা অনেক। তাকওয়া প্রত্যেক ইনসানের থাকা জরুরি। তাকওয়া থাকে একমাত্র মুমিনের কাছে, যে খাঁটি ইমানদার। খাঁটি কেন বলছি? মানুষ তো সকলে কিন্তু সকলেই কি প্রকৃত মানুষ? ধর্ম বা কর্মপ্রীতি থেকেও স্রষ্টাপ্রীতি সৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। পৃথিবীতে হাজার হাজার ধর্মমত আছে—বিলুপ্ত হয়েছে। ধর্ম মানুষকে সঠিকপথ দেখালেও সব ধর্মই যে সঠিক এবং সঠিকপথ দেখাতে পারে এমন ভাবা মুশকিলই-না, অসম্ভব বটে। তা হলে উপায়? হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, ইহুদি ও খ্রিস্টান এই পাঁচটা ধর্মেরই অনুসারী বা উপাসনাকারী পৃথিবীতে বেশি। তন্মধ্যেও খ্রিস্টান, ইসলাম ও হিন্দু এই তিন ধর্মেরই উপাসক বা অনুসারী তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে এই তিনটারই তিনটাই যে সঠিক তাও বলা যাবে না। যে-কোনো জিনিসের একটাই যেমন আসল রূপ হয় বা থাকে, তদ্রূপ ধর্মও ‘আসল’ একটাই হবে। এখন? যার যার ধর্ম তার তার জন্যে বড় ও প্রিয়। ভুলের মধ্যেও থাকলে কেউ, সকলে মনে করে আমার আমি সঠিক এবং আমার ধর্মই ঠিক। জোর করে অমন মানলেও কি বেঠিক কখনো সঠিক হয়ে যায় বা যাবে? কক্ষনো না। প্রত্যেক ধর্মেই কিছু-না-কিছু কুসংস্কার রয়েছে। তা হলে? মানদণ্ডে বিচার করে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে সঠিকপথ।
ধর্মের ভেদাভেদ, জাতীয় বিদ্বেষ ও হিংসাহিংসী মানুষের ধর্ম হামেশা ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এটা নিশ্চিত বলা যায়। কারণ হিংসাহিংসন কোনো হিংস্র জানোয়ারের মধ্যে নেই। এটা মানুষের স্বভাব। জানোয়ারেরা হিংসুটে হয় শিকার পর্যন্ত। তারপর তারা শান্তস্বভাবে ফিরে আসে। শিকার পুরোদমে হজম করার পরেও শান্তস্বভাবে ফিরে না একমাত্র মনুষ্যজাতি। সমস্ত নদনদীর পানি পিয়েও সমুদ্র যেমন শান্ত না, পুরো পৃথিবীর রাজত্ব পেলেও একজন মানুষ পুরা না। এটাই মানুষের ধর্ম। পশুপাখিদের এমন কোনো ধর্ম নেই। পশুপাখিরা যা পায় তাতে তুষ্ট। মানুষ খেলেও অসন্তুষ্ট না খেলেও অসন্তুষ্ট। মানুষের পেট হলো দরিয়া।
“পশুপাখিরা ধর্মপালন করে না তবু তারা অহিংস, মানুষ ধর্মপালন করে তবু তারা হিংস্র” কারও মনে প্রশ্ন আসতেই পারে—কেন? “সকল ধর্মই কিন্তু শেখায় অহিংস হতে এবং সকল ধর্মই বলে শুদ্ধের বাণী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উলটো, যাদের ধর্মপালন বা এবাদতের জন্যে সৃষ্টি করা হয়নি তারা হয়েছে অহিংস আর যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে খাস এবাদতের জন্যে তারা হয়েছে হিংসুক! এখানে কোনো হেকমত?” যিনি স্রষ্টা তিনিই ভালো জানেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকা দরকার মনুষ্যত্ব কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেখা যাচ্ছে পশুত্ব—তাই না? তাই বোঝা যাচ্ছে মানুষ পশুরও রূপান্তর নয় এবং স্রষ্টারও অন্তর্গত নয়। পশুর রূপানন্তর হলে হতো অহিংস আর স্রষ্টার অন্তর্গত হলে হতে পারত না সহিংস। কারণ স্রষ্টা উত্তমের চেয়েও উত্তম। উত্তম থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি হলে তা অধম হতে পারে না আর যা অধম হয় তা উৎকৃষ্ট থেকে সৃষ্টি নয়। তাই মানুষ নিকৃষ্ট কিছু থেকেও সৃষ্টি হয়নি আবার উৎকৃষ্ট কিছু থেকেও নয়। মানুষ মধ্যম। খামখা শ্রেষ্ঠত্বের তকমা লাগিয়ে মুখে ফেনা তুললে কোনো কিছু শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় না। শ্রেষ্ঠত্বের পরিচিতি জন্মে ও ধর্মে নয়—কর্মে। হাঁ, মানুষ রূপেগুণে অতুলনীয় এবং ভালো হোক বা খারাপে বুদ্ধিতেও শ্রেষ্ঠ। তবে ভালোটা দেখছি স্রষ্টার ভালোবাসায় আর মন্দটা দেখছি তার বিপরীতে। আরাধনা করলে আরাধকের সান্নিধ্যে যাওয়া যায় কিন্তু সৃষ্টির সেবা করলে স্রষ্টার মন ও ভালোবাসা দুটোই পাওয়া যায়। কারও সান্নিধ্য পাওয়া এবং মন পাওয়া আর ভালোবাসা পাওয়া এক না। স্রষ্টার মন ও ভালোবাসা পাওয়া বিরাট সাধনার ব্যাপার। যেই সাধনায় থাকে না কোনো খুঁত। নিখুঁত হতে হলে নবিরসুল, অলিদরবেশ ও সাধুসাধকের মতো অতীব সৎ ও মহৎ হতে হয়। তবেই আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি হাসিল করা সম্ভব। এটা আছে একমাত্র তাকওয়ার মধ্যে। ধনসম্পদ ও সংসারের মোহ যার আছে তার মধ্যে তাকওয়া নেই। সে নিখুঁত নয়। কঠোর তপস্যাপর মানুষ তাপস হয়। নবিরসুল হতে অলিদরবেশ ও পিরমুর্শিদ এবং দেবদেবতা হতে অবতার পর্যন্ত কেউই কম সাধক ছিলেন না। তাঁদের সাধনাবলে তাঁরা অনেকেই স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছেন স্বপ্নে ও চৈতন্যে। মনসুরের ভালোবাসার কাছে ঝুঁকেছিল দুনিয়া। প্রেমিক হলে মনসুরের মতো হওয়া চাই। ধর্মকর্ম বুঝি না। স্রষ্টার ভালোবাসা ও ডর যার ভেতরে নেই তার ভেতরে কোনোপ্রকার অনুভূতি ও দরদ নেই। যার ভেতরে অনুভূতি ও দরদ নেই তার মধ্যে কোনো রকম হৃদয়ও নেই। সুতরাং অনুভূতিহীন ও বেদিল মানুষ মানুষ নয়—পাথর হয় আর পাথরের কাছে কিছু চাওয়া ও আশা করা ভুল।
পাগলের জন্যে যেমন খুন মাফ, বোকার জন্যেও অনেক কিছু মাফ। বোকারা করবে বোকামি কিন্তু বিদ্বেষ করে বুদ্ধিমানেরা! আল্লাহ জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর এবাদতের জন্যে? কিন্তু জিন ও মানুষ বেশিরভাগ করছে আল্লাহর নাফরমানি! তাতে আল্লাহর কী, নিজের ক্ষতি। এবাদত করলে মন প্রসন্ন হয়, ভালোবাসলে মন খুশি। ভালোবাসার অপর নাম—এবাদত। এবাদত করণ জরুরি, কীভাবে করতে হয় তা জরুরি নয়। নীরবে হোক সরবে, নিভৃতে হোক প্রকাশ্যে একাগ্রচিত্তে আল্লাহকে ডাকন জরুরি, কীভাবে ডাকতে হয় শিখন জরুরি নয়। এবাদত করতে হয় একমনে আর একধ্যানে তদ্রূপ ভালোবাসায়ও মন গেলে মন ও ধ্যান আর অন্যদিকে যায় না। সেই যাই হোক—মানুষ এখন আর আল্লাহর এবাদত করবে দূরে থাক, করে চলছে তাঁর সঙ্গেও শত্রুতামি! তাঁকে ভালোবাসবে এটাও থাক, করে যাচ্ছে বিদ্রূপ ও বিদ্বেষ! আসলেই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞকারী। আল্লাহ কোরানেও বারবার বলেছেন সেটা এবং আমরাও আমাদের মধ্যে দেখছি সেটা।
“কোরান গবেষণাপর খুঁজে পায়নি যে সত্যের সন্ধান
কোরানের মর্মার্থ বুঝেনি সে—এটাই কোরানের শান”
এক অদৃশ্য মহাশক্তিবলে চলছে বিশ্ব। এই মহাশক্তির নাম—আল্লাহ বা ঈশ্বর। ‘ঈশ্বর বা স্রষ্টা নেই’ এই ধারণা পোষণ করা সৃষ্টির বোকামি। এখন? তাঁকে আমি ডাকছি—এই যে, ডাকার একটা আশ্রয় আমার হলো—হয়েছে এটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। এটা আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি এবং হতে পারে না। আমি কোথাও হুঁচোট খেলে বা ব্যথা পেলে বলে ওঠি—ওঃ আল্লাহ, ঈশ্বর, খোদা, গড, রাম, ভগবান, মা, মাগো ইত্যাদি। তা হলে? এটাও তো আর এমনি এমনি মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে না। নিজের অজান্তেই কথাটা মন থেকে সরাসরি বের হয়ে আসে বাইরে। কারণ, প্রাণের সাথে স্রষ্টার সংযোগ। স্রষ্টার পরে মা এবং তারপরে বাবা। কেউ কিন্তু ব্যথা পেয়ে কোনো দিন ‘ওঃ বাবা রে’ ‘ওঃ দাদা রে’ বলে বা ডেকে ওঠে না। মাকে স্রষ্টাও তাঁর পরে স্থান দিয়েছেন। দেখো, ব্যথা পেয়েছি পায়ে অথবা শরীরের কোনেকটি অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে কিন্তু দরদ অনুভব করছি অন্তরে! তাই কথাটা নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে সহজে। এটাও একটা নিদর্শন নয় কী? জ্ঞানীদের জন্যে বিশ্বজুড়ে রয়েছে নিদর্শন। এখন জ্ঞানীরা যদি তা উপলব্ধি করতে না পারে কিবা খুঁজে না পায়, তা হলে তো সেটা তাদের ব্যর্থতা। তা হলে কারোমতে ‘স্রষ্টা নেই’ ঘোষণার যৌক্তিকতা কী? জাতীয়ভাবে দেখলে তো দেখি, হিন্দু হলে বেশিরভাগ বলে—ভগবান। মুসলিম হলে বলে—আল্লাহ। ইহুদি-খ্রিস্টানেরা বলে—ঈশ্বর বা গড। পার্সিয়ানেরা বলে বেশিরভাগ—খোদা। এভাবে প্রত্যেক জাতি বা গোষ্ঠী তাদের স্রষ্টাকে তারা একেক নামে সম্বোধন করে বা ডাকে। এই ডাকার পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হলো? কে তা প্রচলন করল? আমরা কোরানে দেখি আদমকে আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিসের নাম শিখিয়েছেন, যা ফেরেশতারাও জানত না; না হলে মানুষ এই ক্ষমতা পেল কোত্থেকে? জগৎ যদি এমনি এমনি উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি হয়ে যায়, তা হলে জীবন কীভবে সৃষ্টি হলো? মানুষ তো পোকামাকড়ের রূপান্তর হতেই পারে না। পারে কী? শিম্পাঞ্জি বা বাঁনরের রূপান্তর যদি মানুষ হয়, তা হলে এরা কাদের রূপান্তর? উদ্দেশ্যহীন স্রষ্টাদের অনুসারীদেরকে একটা ধারণা দেওয়ার দরকার ছিল না? প্রশ্ন (যৌক্তিক) থেকেই যায়।
স্রষ্টা আছে কি নেই? এই প্রশ্ন যদি কারও মনে আসে—আসতেই পারে। কেউ বিশ্বাস করুক বা না-করুক, স্রষ্টা আছে এবং চিরন্তন থাকবে এটাই সত্য। বিজ্ঞান স্রষ্টাকে কখনো আবিষ্কার করতে পারবে না এবং না আবিষ্কার করতে পারবে কখনো রুহকে। বিজ্ঞান চাক্ষুষে বিশ্বাসী আর স্রষ্টা ও রুহ চাক্ষুষ নয়, উপলব্ধির বিষয়। বিজ্ঞান দিয়ে সমস্ত কিছুকে যাচাই করা যায় না। নিঃশ্বাস কী? যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়। সে বলবে, প্রাণবায়ু। বিজ্ঞান নিঃশ্বাসকে ধরে দেখাতে পারবে? সবাই এক কথায় জবাব দেবে, যা দেখা যায় না তা কীভাবে ধরে দেখানো সম্ভব? তা হলে? পাঁচ-ছয় ফুট দেহের সামান্যতম প্রাণবায়ু যেখানে দেখা যায় না ও ধরা যায় না সেখানে এত বড় কায়েনাতের মালিক স্রষ্টাকে তাঁর নগণ্য সৃষ্টি কীভাবে সহজে দেখতে পারে বা ছোঁয়া নিতে পারে? মানুষ কতই-না বোকা! সহজেই সবকিছু পেতে চায় এবং হাসিল করে ফেলতে চায়। কিছু জিনিস ছোঁয়া বা দেখা না গেলেও কিন্তু এগুলোর যে অস্তিত্ব নেই কেউ বলতে পারবে না। এগুলোর অস্তিত্ব আছে আর আমরা কদম-কদমেই তা টের পাই এবং উপলব্ধি করি ও করতে পারি। স্রষ্টা এমন এক অস্তিত্ব—যাঁকে ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না কিন্তু সৃষ্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপস্থিত। একথা শুধু মানতেই নেই, মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করতে হয়—হবে। স্রষ্টা কোনো অনুমানের বস্তু নয় এবং অনুধাবনের বস্তু নয়। স্রষ্টা মহান এক সত্তা, তাঁকে একাগ্রচিত্তে বা স্থিরমনে অনুভব করতে হয়। স্রষ্টাকে কেউ দেখেনি বলে ‘স্রষ্টা নেই’ এমন মন্তব্য বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
“আমি বুঝি না কোনটে আবেদ
কোথা প্রভেদ—
ঈশ্বর প্রভু আল্লাহ খোদা গড ভগবান
আমি জানি না উঁচুনিচু কী ভেদ
জাতীয় বিভেদ—
হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ ইহুদ খ্রিস্টান”
স্রষ্টার কোনেকটি নাম বিশ্রী বা ছোট নয় এবং ছোট করে দেখতেও নেই। জাতি হিসাবেও কোনো মানুষ নিকৃষ্ট নয়। স্রষ্টার সৃষ্টি এক আদম। আদম থেকে হাওয়া। আদম-হাওয়া থেকেই মানুষের বিস্তার। মানুষ থেকেই জাতি। জাতি থেকেই ধর্ম। ধর্ম থেকেই বিশ্বাস। বিশ্বাস থেকেই উপাসনা। উপাসনা থেকেই উপলব্ধি। উপলব্ধি থেকেই অস্তিত্ব। অস্তিত্ব থেকেই উৎপত্তি। স্রষ্টার কোনেকটি নাম অমর্যাদাপূর্ণ নয়। ভাবতে অবাক লাগে, যারা স্রষ্টার যে-কোনো একটি নামকে ব্যঙ্গ করে অথবা অসম্মানের চোখে দেখে তারা কোন অস্তিত্বে বিশ্বাসী? যারা কোনো অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় তাদের আখ্যা বা পদবি কী? তারা কোন অস্তিত্ব থেকে আগত? জড় ও বস্তুতত্ত্বে কিছু থাকলেও নাস্তিক্যবাদে শূন্য ছাড়া কিছু নেই।
একবার আমার এক আত্মীয় একদল লোক সঙ্গী করে ঘরে এসে হাজির। তকলিফ? না না তবলিগ—দাওয়াতিকাজ করি। খুবই তকলিফি কাজ কিন্তু? হাঁ, এক দিন হতে এক মাস, চল্লিশ দিন এবং তিন-চার মাস হতে তদূর্ধ্ব যত চিল্লা দেওয়া যায় ভালো। চিল্লা? এরচেয়ে উত্তম কাজ আর নেই—কোটি কোটি নেকি! দেখলাম—অবিবাহিত যুবক থেকে শেষবয়সি বৃদ্ধও দলে। সকলে মুসলমান। আপ্যাপ্যায়নের পর বসল আলাপচারিতার বৈঠক। ইসলাম-সম্বন্ধে দেখি কেউ একজন বিশেষ একটা জ্ঞানের অধিকারী নয়! দুয়েকজন অর্ধশিক্ষিত বাকপটু ছাড়া অন্যরা মনে হলো ইসলাম-সম্পর্কে অনেক অজ্ঞ। কুপোকাতে ফাঁকে হঠাৎ মধ্যবয়সি পরিচিত একজন হেসে বলল, কখনো কখনো আমি আল্লাহ না বলে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি বলে থাকি—আমার লেখালিখির মধ্যেও এটা দেখা যায়। মুসলিমদের মুখে ঈশ্বর!
আমিও হেসে বললাম, শোভা পায় না? দোষের কী? ‘আল্লাহ’ আমরা প্রায়ই মুসলমানেরা এই কারণেই বলি—এটি একটি আরবিশব্দ, কোরান নাজিল হয়েছে আরবিভাষায়। কারণ আমাদের নবির মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাই ‘আল্লাহ’ শব্দটা আরবিতে এসেছে। তাই আমরা বেশিরভাগ মানুষ কোরান আরবিতে অধ্যয়ন করি এবং আরবিভাষার চর্চা করি। নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্যদের ভাষারও চর্চা করা ভালো। এতে আলাদা একটা বৈশিষ্ট তৈরি হয়। অন্যের ভাষা না জানলেও ক্ষতি বা অসুবিধা নেই তবে ইংলিশভাষাটার গুরুত্ব বেশি। এই ভাষাটি জানা থাকলে দুনিয়ার যে-কোনো দেশে চলা সহজ। এটাই একমাত্র সুবিধা। আরবিভাষার গুরুত্ব একমাত্র নবির ও কোরানের ভাষা হওয়ার কারণে। এটা আরবির কীর্তি বা গুণাবলি নয়। নবি মুহাম্মদ (স) আরবে জন্ম নিয়েছিলেন এবং ওনার ভাষা ছিল আরবি। তাই আরবের এত সম্মান বা মর্যাদা বেড়েছে। নবিজি যদি বাংলার মাটিতে জন্ম নিতেন তা হলে কোরান নাজিল হতো বাংলাভাষাতে আর এটা নিশ্চিত হতো। কারণ, নবিদের যেই ভাষা সেই ভাষাতেই স্রষ্টা ওহি পাঠান আর তখন বিশ্বমুসলিম উম্মার কাছে বাংলাভাষা হতো সমাদৃত ও সম্মানের ভাষা। কোরান বাংলাতে পড়তে তখন গর্ববোধ করত অনেকে। আমরা বাঙালিরা তখন বিশ্বে ‘হামবড়া’ ভাব নিয়ে চলতাম। সারা বাংলা হতো হয়তো নবির রওজা বা মাজার। নবিজি এই পথ দিয়ে গিয়েছিলেন, এটা স্মরণীয় মাজার। নবিজি এই পথের গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়েছিলেন, এই সম্মানে এই মাজার। নবিজি এখানে তাঁবু গেড়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করেছিলেন, এটা এই স্মরণে মাজার। কত কত স্মরণীয়-বরণীয় বংশধর বের হতো আর মাজারে মাজারে ভরে যেত দেশ! কারণ নবিজি তো সঙ্গীসাথি ও সহচরদের নিয়ে সারা এশিয়া ভ্রমণ করতে না পারলেও আশপাশের দুয়েকটা দেশপ্রদেশ তো ভ্রমণ করতেনই। তখন ‘প্রভু’ শব্দ হতো মর্যাদার আকাশে এক সম্মানের বুলি। তখন আমরা বাঙালিদের সামনে দুনিয়ার কেউ যদি ভুলেও ‘প্রভু’ ছাড়া অন্য নাম নিত বা উচ্চারণ করত, তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে এরপর ক্ষান্ত হওয়া যেত কি না বলা মুশকিল। আল্লাহ সবচেয়ে বড় জ্ঞানী। আল্লাহ ভালো জানেন, কোথায় কাকে পাঠালে তাঁর মর্যাদা রক্ষা হবে। তাই একজন নবিও বাংলার মাটিতে বা তার আশেপাশেও পাঠাননি। এখন অনেকে বলবে, অসংখ্য ওলিওলামা, পিরমাশায়েক, সাধুসজ্জন ও সাধকপুরুষ তো পাঠিয়েছেন। এখন কীভাবে বলা যায়—কে প্রকৃত ওলি, প্রকৃত পির ও প্রকৃত সাধু। সময়ের পরিক্রমায় সব তো বিলীন হয়—বিলুপ্ত হয়। এটাও তো একটা কথা, আপনি যাকে সাধুসজ্জন ভাবছেন হয়তো সে ভেতরে ভেতরে বিরাট ভণ্ড আর যাকেই ভণ্ড ভাবছেন সে-ই হতে পারে মহাপুরুষ। এই কথার ভিত্তিতে কেউ যদি আমাকে ওলিদরবেশ ও সাধুসাধকের বিপক্ষে ভাবেন, তা হলে বলব—ভুল ভাবছেন। আমি কোনো পিরের মুরিদ না হলেও কিন্তু পিরমুর্শিদ ও ওলিওলামাদেরকে বেশ শ্রদ্ধা করি। বিপক্ষে হাঁ, যারা ওলিদরবেশ ও সাধুসাধক সেজে সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে; নাম, অর্থ ও যশখ্যাতি কামাচ্ছে তারাই আমার উল্লেখের উদ্দেশ্য। কারণ, তাদের জন্যে প্রকৃত ওলিদরবেশ ও সাধুসাধকের বদনাম হচ্ছে। সবকথার এককথা—বিদায় হজের ভাষণে নবি করিম (স) যেই আদেশ-উপদেশ দিয়ে গেছেন সেই সে মুসলমান কি আমরা আছি? নাকি হতে পেরেছি? নাকি হচ্ছি? নাকি হব?
অন্ধধার্মিক আর অধার্মিকের মধ্যে ধরতে গেলে কোনো পার্থক্য নেই। হাঁ, পার্থক্য একটা থাকতে পারে—অন্ধধার্মিক কোনো কিছু না জেনে ও না বুঝে রতব্রত হয় আর অধার্মিক জেনেবুঝে বিব্রত বা বিরত থাকে। এমন ধার্মিক আর অধার্মিকের হয়তো গতি এক। ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার—ঠিক আছে। কিন্তু চোখবুজে অন্ধের মতো সবকিছু ঠিক ভেবে মেনে নেওয়া ধর্মেরও বিরুদ্ধে যায়। তাই আমি অন্ধধার্মিকও হতে পারিনি এবং অধার্মিকও নই। ধর্মে আমিও ভীষণ বিশ্বাসী। আমি জানি, আমার সৃষ্টির মালিক স্রষ্টা একজন আছেন। আমার ভালোমন্দ ও জীবনমৃত্যু তাঁরই কাছে লিপিবদ্ধ। আমার বিচারক তিনি। আমার আশ্রয়দাতা ও মুক্তিদাতা তিনি। আমার আমাকে চালাচ্ছেন তিনি। তাঁরই পরিচালনায় আমি চলছি। আমার মন ও মস্তিষ্কে তাঁরই দখল। কারণ, মন মানুষের হলেও মনের মালিক মানুষ নয়। তা হলে? কার থেকে আমি উপদেশ নেব? কাকে আমি উপদেশ দেবো? কে আমাকে পথ দেখাবে? কে বলতে পারে, কোথায় আমার গন্তব্য? কে দেবে সঠিক সন্ধান? চার দিকে ভণ্ড আর ভণ্ডামি! পিরের জায়গায় পির নেই! মুরিদের মধ্যে মুরিদ নেই! দরবেশের মুখে মুখোশের দাড়ি! মানুষ চিনব কী করে আমি? আমাকে দিশার পথ দেখাবে তুমি? তা হলে শুনি, তুমি কোন ওহিপ্রাপ্ত দিশারি? বন্ধু, নিজের নিজেকে নিয়ে ভাবো। আমার মধ্যে যখন দাজ্জালের ছায়া নেই, তোমার মধ্যে কীসের ঈসা ও মেহেদি? আমি অন্যের পারের চিন্তা না করে, আমার নিজের পারের চেষ্টা করলে হয়তো হলেও হতে পারে আমার নিজের পথ সুগম। এই যে অসুন্দরের বোঝা সম্বল করে সুন্দরের ধর্মকে অন্তত আমি অসুন্দর করতে পারব না, আমার পরিণতির কথা পরে। আমি সুন্দরের পৃথিবীতে অসুন্দর কায়েম করতে আসিনি। ক্ষমাপ্রার্থী। আমি এইও জানি, যার যার ভার তার তার বোঝা। আমি আমার বোঝার ভারে নাহয় রইলাম পিছে। বন্ধু, তুমি তোমার শ্রীহীন কর্মকাণ্ডে থেকো না অপরাধীর কাতারে। কারণ, যারা সুন্দরকে ভেঙেচুরে অসুন্দর বানায় তারা সুন্দরের কাছে বড় দায়ী। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে বিবেকবুদ্ধি দিয়েছেন এবং প্রত্যেক মানুষকে দায়িত্বশীল করেছেন। প্রত্যেক মানুষেরই মনে করি—পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি এবং দশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ আছেই বা থাকা উচিত। তাই বলে মানুষের বানানো কোনো বিশ্রী জিনিসকে অবলম্বন করে ধর্মকর্মের পুণ্যে যোগ করে দেওয়া কি আদৌ পুণ্যের? মঙ্গল যার হয় জঙ্গলেও হয়। মঙ্গলের কাজ করতে হলে যে-কোনো উপায়ে করা যায়, তজ্জন্যে ধর্মকে আশ্রয় করতে হয় না। পুণ্য যে-কোনো ভালো কাজে আছে। সেটা ধর্ম হোক অথবা অধর্ম। সেটা যার যার সাধ্যমতো যার যার অবস্থান থেকে করতেই হবে, নইলে আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচা দায়। নাফরমানির শাস্তি কখনো-না-কখনো মানুষকে ভোগ করতেই হয়। অন্যের জন্যে কিছু করতে পারাটা মানে নিজের জন্যে কিছু করা। তাই বলে এই নয় যে, সংসার ছেড়ে গাঁট্টিগাঁঠুরি কাঁধে নিয়ে মসজিদে মসজিদে দ্বারে দ্বারে দেশবিদেশ ভ্রমণ করতে হবে! আল্লাহ দাম্ভিকতা, জালিমি ও কার্পণ্যকে যেমন পছন্দ করেন না, তদ্রূপ কোনোধরনের সন্ন্যাসব্রতও পছন্দ করেন না। আল্লাহ অতীব সুন্দর। তাই সুন্দরকে বিশেষভাবে ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন। তাই এমন অসুন্দরের থেকে অন্তত তিনি আমাকে পানা দিক। সোয়াবগুনা সম্পূর্ণটাই নিজের কাজের ওপর। সেটা কামাই করতে হলে কোনোধরনের ভ্রমণের দরকার আছে বলে মনে হয় না। কেউ নাইবা রইল গুমরাহ। তোমাদের ক্ষতি? যুক্তিটা বুঝে আসে না, তোমাদেরকে ধর্মপ্রচারের আদেশ দিয়েছেন কোন আল্লাহ? সংসার ছেড়ে দলবেঁধে তোমাদের হিজরত করতে হবে দেশবিদেশ! তা হলে? দীনের জন্যে তোমাদের এত দায়িত্ব বেড়ে গেল কেন? তোমাদের লাভ? হেদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। যাকে তিনি হেদায়াত দান করবেন, সে ঠিকই সঠিক পথ খুঁজে পাবে আর সেটা ওর জন্যেই হবে মঙ্গল। সেখানে অন্যের কোনো মঙ্গল নেই। ভাইয়েরা, তুমি ও তোমরা নিজের কী মূলধন জমা করতে পেরেছ সেটা ভালোভাবে হিসাব কষে দেখো। আল্লাহর সাক্ষাৎ দূরে, সন্তুষ্টিও এত সহজ না। থাক গে, আমার ভাগ্যে নাই-ই মিলল মালিকের সাক্ষাৎ; তোমরা সৌভাগ্যবান হও, জান্নাতের সমাবেশে শুনতে পাবে মালিকের কণ্ঠে সুমধুর কোরানপাঠ।
আমাকে ধর্মের বিরোধী ভাবছ? ভুল। আমি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নই—অসুন্দরের বিরুদ্ধে। সেটা হিন্দু হোক বা মুসলিম, বৌদ্ধ হোক বা খ্রিস্টান এবং যেই ধর্মই হোক-না কেন, প্রত্যেক ধর্মেই কিছু-না-কিছু বিশ্রী জিনিস জড়িয়ে আছে আর সেটা প্রত্যেক ধর্মানুসারীকে বাদ দিয়ে সঠিক ও সুন্দরের পথ অবলম্বন করা দরকার কিবা কর্তব্য। যে স্রষ্টার সৃষ্টি সবচেয়ে সুন্দর—অতুলনীয়, সে স্রষ্টা আর যাই করুক, অন্তত ধর্মে এমন অসুন্দর কিছু যোগ করতে পারেন না। দুনিয়ার এক জন মানুষেরই যদি মনে হয়, এটা একটা বিশ্রী জিনিস কিবা অমার্জিত পথ; তা হলে বুঝতে হবে, এটা স্রষ্টার সৃষ্টি বা আদেশ নয়। আমি যদ্দূর জানি—আমার ধারণা—আল্লাহকে পাওয়ার লক্ষ্যে দূরপাল্লার যাত্রার কোনো দরকার নেই। আল্লাহ যদি কারও মঙ্গল করতে চান এবং কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায়, তা হলে সেটার জন্যে কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। হাঁ, মুসলিমদের জন্যে আল্লাহ মক্কার তাওয়াফ ও মদিনার জিয়ারত প্রসিদ্ধ করে রেখেছেন আর সামর্থ্যবানদের জন্যে হজ করা বাধ্যতামূলক। এরচেয়ে মুসলিমদের জন্যে বড় কোনো পুণ্যের স্থান নেই এবং না আছে কোনো মহাসম্মেলনের জায়গা। কোটি কোটি নেকি দাবি করা পথ ভ্রান্ত। কতইনা সুন্দর সেই ডাক “লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক লাব্বায়িক লাশরিকালাকা লাব্বায়িক ইন্নালহামদা ওয়ান্নিয়ামতা লাকাওয়ালমুলক লাশরিকালাকা” এরপরে কীসের লক্ষ লক্ষ ও কোটি কোটি পুণ্য এবং কীসের মহাসম্মেলন আর কীসের দূরপাল্লার যাত্রা বা চিল্লা! এর প্রতিষ্ঠাতা কে? কোনো নবিরসুল? আমরা নবিরসুলের আদর্শ বাদ দিয়ে কোনো মোল্লামৌলবিকে (র) রহমতউল্লাহি আলাই ও (রা) রাদিআল্লাহু আনহুর তকমা লাগিয়ে অনুসরণ করছি কেন? বেশিরভাগ মানুষেরই স্বভাব হচ্ছে হুজুগে—কানে হাত না দিয়ে চিলের পিছে দৌড়ান! মানুষ আসলেই কি বুঝদার? জ্ঞানসম্পন্ন? ভালো-খারাপের আমার আমিকে বুঝে? কেউ ভালোমন্দ দেখালে সেটা ভালো কি মন্দ বোঝার চেষ্টা করে? অন্যের জান্নাতের ব্যবস্থা করার আগে নিজের জান্নাতের ঠিকানা গড়া জরুরি।
আমরা যাই করি-না কেন, আল্লাহ যখন স্রষ্টা তখন তাঁর সৃষ্টিকে অবশ্যই ভালোবাসবে এবং মাফ করবেই। যে সৃষ্টিকারক তার সৃষ্টিকর্মকে ভালোবাসবে না সে সৃষ্টিকর্তা হতেই পারে না। আল্লাহ যখন নিশ্চয় আছে—আমাদের বিশ্বাস, তখন আল্লাহ অবশ্যই আমাদের মঙ্গল করবেই। তাতে অনেকে যুক্তি খাটাতে পারে কিন্তু যুক্তি দিয়ে কখনো মুক্তি মিলবে না। যুক্তিটা যেমন? কেউ কোনেকটা পণ্য বা সচল কিছু তৈরি করল, যদি সেটা প্রস্তুতকারকের মতে না হয় অথবা না চলে; তা হলে সেটার স্থান হয় আবর্জনায় অর্থাৎ ডাস্টবিনে। এতে সামান্য প্রস্তুতকারক যেরূপ অসন্তুষ্ট হয়, সকল সৃষ্টির মালিক তাঁর সৃষ্টির নাফরমানিতে কী পরিমাণ অসন্তুষ্ট হতে পারেন যুক্তি নেই? আছে। তবে এটাও ঠিক—ইমানের পরে কোনো যুক্তি নেই। ইমান আর আমল এক নয়। ইচ্ছেমতো করা বা চলা কোনো সৃষ্টিরও ক্ষমতা নেই। কারও কিছু ভালো লাগছে বলে কারও লাগতে হবে—বাধ্যবাধকতা কী? যার যেটা ভালো লাগে সে সেটা সঠিক ভেবে করুক—আমার কী। কারও নাহয় জীবন ভুলেই কাটল। তার দোষে তো অন্যে দোষী হবে না। হবে? এখন কথা হতে পারে, আমার চোখ দিয়ে আমি দুনিয়াকে যেভাবে দেখছি সেভাবে হয়তো অন্যের চোখে বেঠিক! অন্যে যেভাবে দুনিয়াকে দেখছে হয়তো সেভাবে আমার চোখে ঠিক না। এটা যার যার দৃষ্টিভঙ্গি। তাই বলে এত অধঃপতনের বা অঘটনের কী আছে? সঠিক বিচারের মালিক তো তিনিই। আমি নিজেই যখন আমার নিজের সাহায্যকারী নই, তা হলে অন্যের সাহায্যের কল্পনা করাও কি সম্ভব? আসলে নিজের আমলনামা দেখার যদি কোনো মাধ্যম থাকত, তবেই দেখা যেত কী মূলধন জমা হয়েছে বা হচ্ছে নিজের আমলনামার খাতায় অথবা দপ্তরে। মনখারাপি সত্ত্বেও সালাম দিয়ে একে একে নীরবে সকলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আড়াল হতেই বলাবলি করতে লাগল—ভুল জায়গায় এসেছি। এমন লোককে বোঝানো সম্ভব না—শয়তান যাকে ভর করে।
শয়তান ভর করেছে আমাকে? “রব, আমি কোনো ধন চাই না, ধন্যি হতে চাই না, যশখ্যাতি ও নাম-সুনাম কিছুই চাই না। চাই তোমার ক্ষমা ও দয়া। তুমিই মহা ক্ষমাকারী এবং পরম দয়ালু। এই প্রার্থনায় তোমার দরবারে আমি প্রার্থক। আমাকে তোমার ভক্তি ও বিশ্বাসের ওপর অটল রেখো” আল্লাহর বিশ্বাসের ডাল থেকে যে বিচ্যুত—সে শুধু ধর্মচ্যুত না, সকল শান্তির নিঃশ্বাস থেকেও বিচ্যুত। যে যাই বলুক-না কেন এবং যেটাই ধারণা করুক-না কেন, স্রষ্টা আছে এবং চিরন্তন থাকবে। কেননা, স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। জগৎ আমাদের ধারণার বাইরে। আমরা ক্ষুদ্র কিছু সৃষ্টি করতে গেলে কত কত গবেষণার দরকার পড়ে এবং তারপর কিছু একটা পূর্ণতা লাভ করে আবার নাও করে। তা হলে? এমনি এমনি কোনো কিছুই সৃষ্টি হয় না এবং হতে পারে না। বুঝতে হবে, স্রষ্টার চালনে সৃষ্টির নিঃশ্বাস। স্রষ্টা আছে বলে সৃষ্টি এত সুন্দর। স্রষ্টার আকৃতি কল্পনা করা অসম্ভব। স্রষ্টাকে চিনতে হলে সৃষ্টিকে চেনা খুব জরুরি আর সৃষ্টিকে চিনতে হলে স্রষ্টার অস্তিত্বে অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা থাকতে হয় এবং হবে। যেকাজে স্রষ্টার ওপর অগাধ বিশ্বাস নেই সেকাজে কোনো সফলতা নেই। আজীবন মরীচিকার পিছে দৌড়ে অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলে জীবনে শান্তি দূরে থাক, মরণে এতটু স্বস্তিও পাওয়া যায় না—যাবে না। সুতরাং স্রষ্টাকে যে বিশ্বাস করে না এবং ভক্তি করে না তার চেয়ে বড় অধম আর কেউ হতে পারে না। যদিওবা স্রষ্টার অস্তিত্বের খোঁজ সৃষ্টির কেউ দেওয়া বা পাওয়া সম্ভব না কিন্তু স্রষ্টা যে নেই এই সত্যতাও তো কেউ কোনো দিন প্রমাণ করতে পারবে না বা পারবে বলে মনে হয় না। কাজেই বস্তুবাদ আর নাস্তিক্যবাদের কী ভিত্তি? আমরা বেশি বুঝি. বেশি করি কিন্তু কাজের কাজ কিছু করি না।
“আনাল হক’ ঘোষণা করে মনসুর প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হলো ফতোয়ার বিশেষ আইনে
কে জানে, হয়তো তারই রূপ ধরে বিধাতা স্বয়ং ‘আনাল হক’ বলতে এলো ভুবনে”
কারও দর্শনের জ্ঞান দেখে আমরা আশ্চর্য হই, কারওবা পাগলের পাগলামি দেখে বিরক্ত। কিন্তু, কারও অন্তরের ভেদ আমরা কেউই জানি না বা জানতে পারি না—হয়তো দর্শনে রয়েছে অযুক্তি এবং পাগলামিতে রয়েছে হকিকত। আমরা জানি বিধি এক, বিধান এক, কোরান-হাদিস ও নবিরসুল এক। তবে এই-ই এক থেকে অনেক ভাগে বিভক্ত করে চলছি এক ধর্মের অনুসারী আমরা! আমাদের দিনদুনিয়া হতে পারে উজালা? আমরা যে যেটাই করি এবং যেটাই মানি ও বুঝি, আমার আমি মনে করি ঠিক—বাদবাকিরা ভুল। তিয়াত্তর ফেরকার পথ বাকি আর কত দূর?
“বেহেশত-দোজখ বুঝি না আমি
চিনি না হাশরের ময়দান
আমার মধ্যে রয়েছে সবি
আমার মধ্যেই বেহেশত-দোজখের স্থান
আমায় করিয়ো না প্রভু
একূলে এমন কিছু
যার জন্যে ওকূলে রয় না মান”
অভিজ্ঞতার অপর নাম—দক্ষতা। দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার একমাত্র বই। বই ছাড়া জানা অসম্ভব আর জানা ছাড়া দক্ষতা অসম্ভব। জানার শেষ নেই। যার যদ্দূর সম্ভব জানা ও শেখা প্রয়োজন। তবেই দক্ষতা অর্জন। আমি যতই জানার আগ্রহে অগ্রসর হচ্ছি এবং যতই অজানাকে জানার চেষ্টা করছি ততই কিছু-না-কিছু জানছি—শিখছি—ততই মনে হচ্ছে এখনো কিচ্ছু জানি না। অকূল সমুদ্রে সাঁতারে যেমন কূল পাওয়া যায় না—যাবে না, জানার সমুদ্রে কূল নেই। তবু অজানাকে জানার চেষ্টা করতে হবে। তবু শেখার আগ্রহ জারি রাখতে হবে। তবু শিখতে হবে। জানার ও শেখার কোনো বয়স নেই। জ্ঞানী না হই জ্ঞান অর্জন করা কর্তব্য। অন্ধকারে জন্ম হওয়া যায় তবে অন্ধকারে জীবন কাটানো যায় না। বোকার সঙ্গে বাস করলে জ্ঞানের পরিধি লোপ পায়। আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও মহৎ দিলের অধিকারী। হিংস্রতা আর বক্রতার অন্তরে কোনো প্রসন্নতা নেই। কৃপণতাও মলিনতা। হিংস্রতা আর কৃপণতা আল্লাহর পছন্দ না। আল্লাহ পছন্দ করেন তাকে, যার মন ভালো। জ্ঞান অর্জনকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। অজ্ঞতা খোদার সৃষ্টি নয়—মানুষের। স্রষ্টা সকল মানুষকে জ্ঞান অর্জন করার ক্ষমতা দিয়েছেন। তাই জ্ঞান অর্জন করা সকল মানুষের প্রয়োজনই নয়—কর্তব্য। শুধু আরাধনা করলেই যে আরাধকের সান্নিধ্য পাওয়া যায় কে বলে? যথার্থ বন্দেগিতে একটা জিন্দেগি আছে ঠিক তবে যথার্থ বন্দেগি কল্পনা করা আজকাল কঠিন। সুন্দর কাপড় পরে ভালো মানুষ সেজে ধোঁকা দিচ্ছে অনেক। শয়তান আর ফেরেশতাকে চেনার উপায় নেই আজ। কিন্তু স্রষ্টাকে চেনার উপায় আছে। অসীম সৃষ্টির দিকে তাকালে স্রষ্টার অস্তিত্ব দেখা না গেলেও জানা যায়। কোরানের কথা ‘তারা কি দেখে না’ কাদেরকে আল্লাহ দেখার কথা বলছেন? আল্লাহ জ্ঞানীদের জন্যে আসমান-জমিনে অসংখ্য নিদর্শন রেখেছেন। ‘চোখওয়ালা আর অন্ধ এক নয়’ সকল প্রাণশক্তির মধ্যেই কি নেই স্রষ্টার অস্তিত্ব? অনেকে বলতে পারে—না? নইলে জন্ম ও মৃত্যু কেন? সব প্রাণের একটা সময় পর্যন্ত জীবন অতিবাহিত কেন?
‘মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞকারী’ আল্লাহ কোরানে বারবার বলেছেন এটা। উপকারীর উপকার স্বীকার করা ইনসানিয়ত। ‘মানুষ’ পরিচিতির প্রথম ধাপ এটি। পশুদের এই ক্ষমতা নেই। এটাও নিদর্শন। যে উপকারীর উপকার স্বীকার করে না সে পশুদের বংশধর। পশুরা আসলে স্বার্থপর নয়। স্বার্থপরেরা কারও উপকার স্বীকার করে না। উপকার স্বীকার করে আলোকিত জনে। তারা আঁধার ও আলোর পার্থক্য বুঝে। অন্ধকারে কিছুক্ষণ থাকা যায় কিন্তু অন্ধকারে জীবন কাটানো যায় না। জ্ঞানীরা সব সময় আলোতে বাস করে—আলোর নগরী খুঁজে বেড়ায়। মনের আঁধার যাকে ঘিরে থাকে জীবনের আঁধার সে পার হতে পারে না। আলোহীন জীবনের চার পাশে বেদনার পাহাড়। ক্ষীণাত্মার জীবন অন্ধগহ্বরে নিমজ্জিত। ক্ষুদ্র আত্মা ও মৃত জীবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অহংকারী রাজা আর কৃপণ ধনীর সম্পর্ক বড়ই ঠুনকো। ধনের চেয়ে মনের মালিক বড়। আভিজাত্য ও ধনসম্পদ আর অঢেল অট্টালিকার মালিক তো আমরা অনেকেই হই তবে মনের মালিক খুব কম জনই হই। ধনের মালিকের চেয়ে মনের মালিক হতে পারলে জিন্দেগি দামি। ধন দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় না—যা মন দিয়ে করা যায়। ধনদৌলতে সুখ আছে ঠিক তবে শান্তি দিতে পারে না। সুখ আর শান্তি এক নয়। অতএব মনের মালিক হতে পারলেই প্রকৃত ধনী। বিধানের কাছে ধনদৌলতের মূল্য থাকতে পারে তবে বিধির কাছে কোনো মূল্য নেই—মূল্য মাত্র মনের। কাজেই ধনবানের চেয়ে হৃদয়বান হওয়া জরুরি। তবেই খোদার মকবুল বান্দা কিবা উৎকৃষ্ট সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।
সৃষ্টিকে ভালোভাবে জানতে পারলে স্রষ্টাকে জানা সহজ। কর্ম ভালো যার জীবন ভালো তার। অনুমানে পথচলা যায় তবে গন্তব্য মিলা বড় কঠিন। পরিষ্কার কাপড় পরলে কেউ ভালো মানুষ নয়। সারা দিন সারা রাত অন্যকে ঠকানোর মালা জপে আর্থিক সমৃদ্ধির সাধনা ভুল। অন্যের সমালোচনায় ও অনিষ্টের সাধনায় কপাল কালো করলে এবাদতি হওয়া যায় না। পরহেজগারদের আগের কাতারে সামিল হতে হলে ভালো দেখানোর চেয়ে ভালো কাজ করা দরকার। আমি পেটপুরে খেলাম এবং আরামে তেতলায় ঘুমালাম আর সময়ে সময়ে এবাদতখানায় দৌড়লাম! মনে করছি, আমার চেয়ে আল্লাহর খাঁটি বান্দা আর কেউ নেই! আমার ঘরের পাশে কেউ দিন কাটছে উপোসে আর কষ্ট পাচ্ছে রোগেশোকে ভুলেও দেখছি না একবার—আমি খাঁটি বান্দা আল্লাহর? বলা যায়, এবাদতের চেয়ে উত্তম কোনো কাজ নেই। ধর্মকর্মই একমাত্র কাজ। তবে, শুধু ধর্মকর্মেই যে আল্লাহর সন্তুষ্টি মিলে যুক্তি কী? ঐকান্তিক ইচ্ছা ছাড়া যেমন সাধনা পুরা হয় না, প্রেম ও সৃষ্টির সেবা ছাড়া স্রষ্টার নৈকট্যলাভ আশা করা যায় না। মুহাম্মদ (স) বলেছেন ‘সমস্ত এবাদতের মূলে রয়েছে প্রেম’ ঔদার্য সকল কাজ এবাদত।
‘সাধনায় মিলে ঈশ্বর আরাধনায় ফল’ সাধনায় ঈশ্বর মিলে কিন্তু সকল আরাধনায় যে ফল মিলে এমন কথা বলা মুশকিল। কিছু কিছু এবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না—হবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে হলে—সততা, সভ্যতা, নম্রতা ও সরলতা ইত্যাদি কতক গুণবাচক শব্দের সমন্বয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হয়—হবে। তবেই শ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া নয়, বলা যেতে পারে। তবেই হয়তো আল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে না পারলেও সন্তুষ্টির বান্দা হওয়া যেতে পারে। খাঁটি আর সন্তুষ্টি এক নয়। সকল জিনিস যেমন জিনিস নয়, সকল এবাদত এবাদত নয়। খাঁটি আর সন্তুষ্টিও তদ্রূপ। মানুষ আর মানুষের ব্যবধানও তদ্রূপ। ‘খাঁটি’ মানুষ হতে হলে মানুষকে আগে আল্লাহর সন্তুষ্টির বান্দা বনতে হবে। অধ্যাত্মজ্ঞান ছাড়া খাঁটি বনা কঠিন। ‘শহিদের রক্তের চেয়ে বিদ্বানের কলমের কালি পবিত্র’ ‘মূর্খের এবাদতের চেয়ে জ্ঞানীর নিদ্রা উত্তম’ এমন জ্ঞানের অধিকারী হতে হলে কঠোর সাধনা বা তপস্যা দরকার। সে তপস্বী হয়তো আজকের দুনিয়ায় কল্পনা করা অসম্ভব। কারণ দুনিয়া এখন আধ্যাত্মিকে নেই—বিজ্ঞানে এসে ঠেকেছে। মানুষ বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করতে নেমেছে! কিন্তু মানুষ হয়তো বুঝছে না আজকের বিজ্ঞানের সঠিক মতবাদ কালকে কিবা ভুলও হতে পারে? মানুষ ভুল কেন করে? বিজ্ঞান কি বলতে পারে? আর পারলেও সেটা যে একশ ভাগ সঠিক এই কথা কে বলবে? বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করা যায় না। বিজ্ঞানের ভিত্তি অনুমানের ওপর। স্রষ্টার ভিত্তি মানের ওপর। মানুষ মানী কিন্তু নির্ভুল নয়। কারণ মানুষ সৃষ্টি আর সৃষ্টি কখনো নির্ভুল হতে পারে না। ভুলের কারণে মানুষের পৃথিবীতে আসা। সুতরাং ভুলত্রুটি মানুষের হবেই। তবে ভুল বুঝতে পারা এবং স্বীকার করা জ্ঞানীর কাজ। অতএব জ্ঞানীরাই ভুল বুঝতে পারে এবং স্বীকার করে। ভুলে সকলে দুঃখিত হয় না! দুঃখ প্রকাশ করা কিন্তু মানুষের পরিচয়।
রূপেগুণে কেউ বিশ্রী হলে তার মনমানসিকতা যে কদর্য এমন ভাবা অযৌক্তিক। মানুষ সুন্দর কেবল রূপের গুণে নয়, আদত ও কর্মের গুণে বিবেচ্য হয়। মন যার সুন্দর সে বুঝে প্রকৃত সুন্দর কী। বাহ্যিক সৌন্দর্যে কেউ সুশ্রী নয়, সুশ্রী ভেতরের রূপে। স্রষ্টা এই বলে মানুষ সৃষ্টি করেননি যে, তারা সব সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে আর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকবে এবং পৃথিবীর শান্তি ও সৌন্দর্য নষ্ট করবে। এই বলে সৃষ্টি করেছেন, স্রষ্টার এবাদত আর হুকুম-আহকাম মেনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখবে। আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি শৃঙ্খলায় আবদ্ধ—শুধু মানুষ ছাড়া! দুনিয়াকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র বানাননি, বানিয়েছেন পরীক্ষাক্ষেত্র। পরীক্ষায় ভালো করলে ফলাফল ভালো আর মন্দ করলে ফলাফল মন্দ। ধর্মে নয় কর্মে মানুষের উত্তরণ। মানুষ চাইলে ফেরেশতা বনতে পারে, চাইলে শয়তান। মানুষ মনের চালক—স্বভাবে স্বভাবী। অতএব কয়দিনের জিন্দেগি, যেভাবে আসা সেভাবেই তো যাওয়া। দুই হাত তো সব সময়ই আছে ও থাকে খালি—যাবেও খালি। না সঙ্গে যাবে অর্থকড়ি কোনো উপার্জন, না যশখ্যাতি কোনো নামধাম। তা হলে? কাজেই সৃষ্টির সেবায় নিবেদিত প্রাণ হতে পারলে সার্থক জন্ম ও জীবন।
“অধ্যাত্মতত্ত্বে আর আধ্যাত্মিকতার মধ্যেই রয়েছে স্রষ্টার উপস্থিতি
কলমের জ্ঞানে আর কালির বয়ানে সৃষ্টি করতে পারে তা উপলব্ধি”