আজ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রি., জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। সারা দেশের মানুষকে বই পড়া, জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থাগার ব্যবহারে উৎসাহিত করার মাধ্যমে একটি জ্ঞানমনস্ক আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৮ সাল থেকে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “সমৃদ্ধ হোক গ্রন্থাগার, এই আমাদের অঙ্গীকার”। সংগত কারণেই সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপাদ্য। এখন প্রশ্ন হলো- প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে বই পড়ার অভ্যাস ও চর্চা যখন একরকম মৃতপ্রায় সেই সময়ে গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধি বা সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার তৈরি করা কতটুকু যৌক্তিক? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই মূলত আজকের লেখার উপলক্ষ্য।
বিশিষ্ট গ্রন্থাগার বিজ্ঞানী ও উপমহাদেশের গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক ড. এস. আর. রঙ্গনাথান গ্রন্থাগারকে একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন - Library is a growing organism. অর্থাৎ লাইব্রেরি এমন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেটি প্রতিনিয়ত তার অবকাঠামো, জনবল, কার্যপদ্ধতি, পাঠোপকরণের সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন নতুন পাঠক তৈরির মাধ্যমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলে। এখন কথা হলো সমৃদ্ধ লাইব্রেরি বা লাইব্রেরির সমৃদ্ধি কেন প্রয়োজন?
প্রথমত: সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রয়োজন সমৃদ্ধ জাতি, উন্নত দেশ ও সভ্যতা গড়ে তুলতে। এই কথার সত্যতা আমরা প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাস ঘাটলেই পেয়ে যাব। ইতিহাস থেকে জানা যায়- প্রতিটি বড় বড় সভ্যতায়ই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। যেমন- গ্রীক সভ্যতায় পারগামাম লাইব্রেরি (খ্রিষ্টপূর্ব ২৪১), মেসোপটেমিয় সভ্যতায় আসুরবানিপাল লাইব্রেরি, মিশরীয় সভ্যতায় আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৫) ইত্যাদি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের কথা জানা যায়। তাছাড়া বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালেও দেখবো বিশ্বের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরিটি (লাইব্রেরি অব কংগ্রেস) এই সময়ের সবচেয়ে উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। যার অর্থ দাঁড়ায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া দেশটি আধুনিক এই সময়ে দাঁড়িয়েও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে নি। এসকল উদাহরণ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, পৃথিবীর সভ্য জাতি ও উন্নত সভ্যতাগুলোর সাথে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই জাতি হিসেবে আমরা যদি সমৃদ্ধ ও উন্নত হতে চাই তাহলে আমাদেরকেও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত: আমরা জানি উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। আর তাদের এই সমৃদ্ধ অর্থনীতির পেছনের কারণ হলো তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা, উদ্ভাবন ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় যে জাতি যত এগিয়ে তাদের অর্থনীতিও তত সমৃদ্ধ। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন- “এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভান্ডার শূন্য সে জাতির ধনের ভাঁড়েও ভবানী। তারপর যে জাতি মনে বড় নয় সে জাতি জ্ঞানেও বড় নয়।’’ সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা তথা গ্রন্থাগারের যোগসূত্র রয়েছে। তাছাড়া আগামীর অর্থনীতিও হবে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি (Knowledge Economy)। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক পুঁজিই (বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, উদ্ধাবন, ফলিত গবেষণা ইত্যাদি) যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন ও ভোগের মূল কাঁচামাল হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং আমাদেরকে এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্যও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির দিকে মনযোগ দিতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী গবেষণা ও নিবিড় জ্ঞানচর্চা। আর এখানেই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের প্রসঙ্গ।
তৃতীয়ত: দুর্নীতি হ্রাস করার মাধ্যমে দেশের টেকসই উন্নয়নে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার অপরিহার্য। আমরা জানি একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নে বড় বাধা হলো দুর্নীতি বা অনিয়ম। দুর্নীতি বা অনিয়মই একটি জাতির জীবনে ক্যানসার স্বরূপ যা সেই জাতিকে ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়। অতীত ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পারবো- বিভিন্ন প্রাচীন ও বড় বড় সভ্যতাগুলো ধ্বংসের পেছনে একটি অন্যতম কারণ ছিল এই দুর্নীতি। তাছাড়া আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় দুর্নীতিই প্রধানতম কারণ যা টেকসই উন্নয়নে অন্তরায়। আর এ থেকে উত্তরণে কার্যকরী ও সর্বোত্তম উপায় হলো মানুষের বিবেকবোধ জাগ্রত ও শাণিত করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র তথা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্রই নীতি-নৈতিকতার চর্চা করা। এক্ষেত্রে ভালো ভালো বই যেমন- ধর্মীয়, অনুপ্রেরণামূলক বই, মনীষীদের জীবনী, বিভিন্ন সভ্যতা ও জাতির ইতিহাস ইত্যাদি পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর এভাবেই গ্রন্থাগার একটি দেশের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
চতুর্থত: একটি জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গঠনেও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার অপরিহার্য। কেননা গ্রন্থাগাার বিশেষ করে গণগ্রন্থাগারকে বলা হয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সকল শ্রেণি-পেশা, লিঙ্গ-বয়স, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জ্ঞানার্জনের অবারিত সুযোগ রয়েছে। সেই সাথে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে মানসম্মত ও জীবনব্যাপী (Quality and Life-long learning) শিক্ষা নিশ্চিত করতে গ্রন্থাগারের রয়েছে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। তাছাড়া তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ প্রদানেও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই।
পঞ্চমত: তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলতেও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের প্রয়োজন রয়েছে। বই পড়ার মাধ্যমে ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা বিকশিত ও শাণিত হয়, চিন্তা-চেতনার উৎকর্ষ সাধিত হয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস ইতিবাচক ও উন্নত হয়, আচার-আচরণ মার্জিত হয়, কথা-বার্তা ও কাজ-কর্ম পরিশীলিত ও পরিপাটি হয় যা তাকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলে। সেই সাথে একবিংশ শতাব্দীর দক্ষতা যেমন- Creativity, Critical Thinking, Problem Solving, Innovation, Communication skill, Information Literacy ইত্যাদি রপ্ত করতেও বই পড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। আর এভাবেই Demographic dividend এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে গ্রন্থাগার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ হলেই সমৃদ্ধ হবে দেশ-জাতি, সমাজ-অর্থনীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি সব। তাই আসুন সবাই একসাথে বলি – সমৃদ্ধ হোক গ্রন্থাগার, এই আমাদের অঙ্গীকার।
