প্রথম অংশ
জলঢাকা একটি উপজেলা শহর। উপজেলাকে শহর বলা ঠিক হলো কিনা, আমি জানি না। এই শহরে অনেক নামিদামি লোক বাস করে। তবে আমি তাদের মতো নই—আমি সাধারণ ঘরের এক রীতিমতো বেকার ছেলে। পকেটে সবসময় তেমন টাকা-পয়সা থাকে না। কয়েকজন কাছের বন্ধু আছে, যারা বিভিন্ন সময় ধার দেয়। সেই ধার দিয়েই কোনোভাবে চলি। বন্ধুরা জানে, কোনো একদিন ফিরিয়ে দেব—এই আশায় ধার দেয়।
আমার দিন কাটে ঘুমিয়ে আর রাত কাটে জলঢাকার বিভিন্ন মোড়ে ঘুরে। জলঢাকার রাত আমার কাছে অদ্ভুত মধুর লাগে। এরকমই একটি মোড় হলো উপজেলা পরিষদের সামনের গোল চত্বর। সেখানে বসে আড্ডা দিতে আমার খুব ভালো লাগে। এই ভালো লাগা বুঝিয়ে বলা সহজ নয়।
সেই রাতে গোল চত্বরে ঘুরতে গিয়ে কোনো দোকান খোলা পেলাম না। পকেটে সামান্য কিছু টাকা ছিল, যা এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম। একটি সিগারেট খাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হলো, কিন্তু আশপাশে কোনো দোকান খোলা নেই। কী আর করা! জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো পথ হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম—
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।”
আমার গন্তব্য জলঢাকার জিরো পয়েন্ট। উদ্দেশ্য—একটি সিগারেট খাওয়া।
মনে হলো, কবিরা কীভাবে এমন কথা লিখে যান! হাজার বছর ধরে কেউ কি হাঁটতে পারে? আজ যদি জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো লিখতেন—
“হাজার বছর ধরে রাজনীতি করি, কিন্তু নেতা হতে পারি না।”
এলোমেলো চিন্তায় ডুবে থাকতে থাকতে কখন যে জিরো পয়েন্টে পৌঁছে গেছি, বুঝতেই পারিনি। মনে মনে ভাবলাম—সিগারেটের নেশা আসলে কেমন! একটি সিগারেট খাওয়ার জন্য এতটা পথ পাড়ি দিলাম...
দ্বিতীয় অংশ.........
এলোমেলো চিন্তা করতে করতে কখন যে জিরো পয়েন্টে এসে গেছি বুঝতে পারিনি । মনে
মনে চিন্তা করলাম সিগারেটের কি নেশা একটা সিগারেট খাওয়ার জন্য এতটা পথ
আসলাম।আমি সিগারেট ছাড়তে চাই কিন্তু সিগারেট আমাকে ছাড়ে না । যথারীতি
সিগারেটের দোকান খুঁজতে লাগলাম ,তখন রাত প্রায় ২ টা এই সময় জিরো পয়েন্টে তেমন
কোন দোকান খোলা থাকে না । কিন্তু সিগারেট তো খেতে হবে তাই সিন্ধান্ত নিলাম আর
একটা জীবনান্দ দাশের হাটা দিয়ে তেলের পাম্প এর দিকে যাই ,সেখানে সারারাত দোকান
খোলা থাকে । হাটতে হাটতে তেলের পাম্প চলে আসলাম ,এখানে অনেক দোকানদার আমার
পরিচিত ।আমার এক অতি পরিচিত দোকানদার নাম মজনু মিয়া তাকে বললাম কেমন আছেন সে
হাসি মুখ করে বললো ভাইজান ভাল আছি ,বুঝছি আপনি সিগারেট খেতে আসছেন এই নেন
সিগারেট । মজনুর Intuition Power আছে বলা যায় । মজনুর Intuition Power টা
একবার পরীক্ষা করা প্রয়োজন ,আমি সিগারেট টানতে টানতে পকেট থেকে একটা কার্ড
বাহির কিরে মজনুকে বললাম মজনু মিয়া এই কার্ডে কি চিহ্ন আছে বলতে পারবেন ,মজনু
মিয়া হাসতে হাসতে বললো একটা যোগ চিহ্ন ,আমি কিছু বললাম না । আমার আবার মানুষের
Intuition Power পরীক্ষা করার অভ্যাস আছে আমি মাঝে মাঝে এই পরীক্ষাটি বিভিন্ন
মানুষের উপর চালাই । তবে মজনু মিয়ার Intuition Power অসম্ভব ভাল ,আমার পকেটে
চারটা কার্ড ছিল যার মধ্যে যোগ,বিয়োগ,গুন ও ত্রিভুজ চিহ্ন ছিল মজনু মিয়া সঠিক
কার্ডের সঠিক চিহ্নটি বলতে পেরেছিল কিন্তু আমি মজনু মিয়াকে বুঝতে দেইনি ।
পৃথিবীতে খুব কম সংখক মানুষের Intuition Power থাকে তার মধ্যে মজনু মিয়া একজন
। গত কয়েক দিন থেকে জলঢাকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে খুব আলোচনা চলছে ,আমি এই
সব বিষয় নিয়ে কর্ণপাত করি না তারপরও কৌতুহল হলো ,একবার মজনু মিয়াকে জিজ্ঞাসা
করি এদের ভবিষ্যৎ কি ।সিগারেট খাওয়া আমার শেষ হয়েছে তাই মজনু মিয়াকে বললাম আর
একটা সিগারেট দেন ,মজনু মিয়া সিগারেট দিল আমি আবার সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম
মজনু মিয়া সবাই যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আলোচনা করছে তাদের ভবিষ্যৎ কি? মজনু
মিয়া বললো ভাইজান এরা সবাই বাতিল হয়ে যাবে ।আমি তাকে কিছু না বলে আবার হাটা
শুরু করলাম এবার আমার গন্তব্য নীলসাগর এর ব্রীজ সেখানে বসে আকাশ দেখবো ।
তৃতীয় অংশ
এবার আমার গন্তব্য নীলসাগর ব্রীজ। সেখানে বসে নিরিবিলি আকাশ দেখার পরিকল্পনা করেছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম নীলসাগর ব্রীজে। নীলসাগর একটি কৃত্রিম নদী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে সৌদি উন্নয়ন তহবিল, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং আবুধাবি উন্নয়ন তহবিলের প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় সেচের সুবিধাসহ কৃষিজমি ও জলকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং একই বছরের ৫ আগস্ট এর কার্যক্রম চালু হয়। এতে মোট ব্যয় হয়েছিল ১৫০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার প্রায় ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে। প্রকল্পটির পরিকল্পনাকারী ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন মেধাবী ও মহৎ মানুষ। এর সুফল আজও জলঢাকার মানুষ ভোগ করছে।
রাত গভীর হয়ে গেছে। চারপাশে কোনো শব্দ নেই। নির্জন আকাশ দেখার মজা একেবারেই অন্যরকম। আজকের আকাশ যেন অন্য সব রাতের তুলনায় বেশি পরিষ্কার। অসংখ্য তারার ঝলকানি দেখতে পাচ্ছি। মনে হলো, আমাদের সবারই মাঝে মাঝে সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ভাবা উচিত। এতে হয়তো লোভ, হিংসা, অহংকারের মতো সহজাত প্রবৃত্তিগুলো কিছুটা হলেও কমে যেত। ভাবতে ভাবতে মহাজাগতিক ঘর্ষণ বা বিগ ব্যাং নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। মহাবিশ্বের সৃষ্টি ঠিক কত কোটি বছর আগে হয়েছিল?
চোখ গেল সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে। এটি দেখতে প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো। ইংরেজিতে এটি Ursa Major বা Great Bear নামে পরিচিত। দ্বিতীয় শতকের জ্যোতির্বিদ টলেমি এটি ৪৮টি তারামণ্ডলের একটি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই সাতটি তারার নাম উপমহাদেশের জ্যোতির্বিদগণ সাত ঋষির নামে রেখেছেন: ক্রতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, ও মরীচি।
ভাবতে অবাক লাগে, একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে কিছু উপগ্রহ ঘুরছে। সূর্যও একটি নক্ষত্র। এরকম অসংখ্য নক্ষত্রব্যবস্থা নিয়ে গঠিত হয় একটি ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি। আর মহাকাশে তো অসংখ্য গ্যালাক্সি রয়েছে। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি, তার নাম মিল্কি ওয়ে বা আকাশগঙ্গা। অথচ বিজ্ঞান এখনো সৌরজগত নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত।
এসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ একটা লাঠির শব্দ শুনলাম। তাকিয়ে দেখি, একটি পুলিশ ভ্যানসহ কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে আসছে। একজন পুলিশ আমার সামনে এসে বলল, "এই ব্যাটা, এত রাতে এখানে কী করিস?" পুলিশের সেই চিরাচরিত রুক্ষ স্বভাব—তুই-তোকারি করে কথা বলা। আমি শান্তভাবে বললাম, "রাতের আকাশ দেখি।"
"ফাজলামি করিস! রাতের আকাশ দেখা না, এখানে বসে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করছিস। জানিস দুই দিন আগে এখান থেকে দুইটা মোটরসাইকেল ছিনতাই হয়েছে?" আমি মাথা নিচু করে বললাম, "জি না, স্যার। জানি না।"
পুলিশ বলল, "থানায় চল, জানবি।" বলে আমার গালে এক থাপ্পড় মারল। কিছু না বলে ওদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম।
আমাকে ভ্যানে তোলার আগে এক পুলিশ আরেকজনকে বলল, "স্যার, একজন ছিনতাইকারী ধরেছি। ব্যাটাকে একটা থাপ্পড়ও দিয়েছি। ভালো করেছি, না স্যার?" যাকে সে স্যার বলল, তিনি সম্ভবত এসআই পদমর্যাদার। ভ্যানে উঠার পর আমি বললাম, "স্যার, একটা সিগারেট হবে? সিগারেটের নেশা উঠেছে। পরে ফেরত দিব।"
পুলিশ বলল, "ব্যাটা, আগে থানায় চল। তখন যত সিগারেট খাবি, খাস।"
বাঙালিদের ভাষাগত সমস্যার কথা মনে পড়ল। আমরা "চা খাই", "পানি খাই", "সিগারেট খাই" বলি। আসলে বলা উচিত "পান করি"। অন্য ভাষায় এই ধরনের ভুল হয় না।
মজনু মিয়ার কথা মনে পড়ল। যদি আগেই তাকে জিজ্ঞেস করতাম, আজকের রাতে আমার কোনো বিপদ হতে পারে কি না, হয়তো সে কিছু একটা বলে দিত।
থানায় পৌঁছে আমাকে একটা ঘরের এক কোণে বসিয়ে রাখা হলো। ঘরে আরেকজন ছিল, সে শুয়ে ছিল। চারপাশে মশার আধিপত্য। ছোট্ট এই প্রাণী কেমন করে যেন মানুষের রাতের ঘুম চুরি করে নেয়। হঠাৎ শুয়ে থাকা লোকটি উঠে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "ভাইজান, কী চুরি করেছেন? এখনো আপনাকে জামাই আদর করেছে নাকি?"
আমি কিছু না বলে জিজ্ঞেস করলাম, "একটা সিগারেট হবে?
চতুর্থ অংশ
শুয়ে থাকা লোকটি উঠে বসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "ভাইজান, কী চুরি করেছেন? এখনো আপনাকে জামাই আদর করেনি?"
আমি কিছু না বলে বললাম, "একটা সিগারেট হবে?"
লোকটি হেসে বলল, "ভাইজান, বিড়ি খাওয়ার টাকাই পাই না, আর সিগারেট চান! যদি খেতে চান আনছার বিড়ি আছে, নেন। একবার খেলে বারবার খেতে মন চাবে।"
আমি বললাম, "দেন একটা।"
বিড়ি খেতে খেতে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই, আপনার নাম কী?"
সে বলল, "হাসমত।"
নামের সঙ্গে লোকটির চেহারার কোনো মিল নেই—একটু ভয়ংকর টাইপের। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি এখানে কতক্ষণ ধরে আছেন?"
হাসমত কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাছে এসে বলল, "ভাইজান, শোনেন। এখন আপনার নামে মামলা লেখা হবে। ধরেন, ছিনতাই, মাদক বিক্রি, অস্ত্র বা অন্য কিছু। পুলিশ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে, কোন মামলাটা খেতে চান। আপনি বলবেন, 'ছিনতাই মামলা দেন'। এতে সাজা কম হবে। তবে ভাইজান, ছিনতাই মামলার রেট একটু বেশি।"
হাসমতের কথা শুনে ঠিক কী বোঝা উচিত, তা বুঝতে পারছিলাম না। সামনে একজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, আর আমার দিকে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। হঠাৎ সে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, "আপনার নাম-ঠিকানা দেন, স্যার চেয়েছেন।"
আমি একটা সাদা কাগজে নাম-ঠিকানা লিখে দিলাম। এরপর বললাম, "স্যার, আমার নামে কী মামলা হবে? যদি মামলা দেন, তাহলে ছিনতাই মামলা দিয়েন।"
পুলিশরা স্যার শব্দটা খুব পছন্দ করে, তাই আমি স্যার বলে কথা বললাম। কিন্তু কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাব, বুঝতে পারছিলাম না।
ভাবছিলাম, অনেক দিন খালার বাড়ি যাওয়া হয়নি। আজকেই যাওয়ার কথা ছিল। খালা যেতে বলেছিলেন। খালা আমাকে খুব পছন্দ করেন। তার কারণ, খালার মেয়ে সুমনা—আমার চেয়ে নয় বছর ছোট। সুমনা উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ে। অসম্ভব চঞ্চল আর মেধাবী মেয়ে। তাছাড়া দেখতে অসাধারণ সুন্দর। খালার ইচ্ছা আমাকে আর সুমনাকে বিয়ে দিয়ে একসঙ্গে সংসারী করবেন। তবে খালু একেবারেই রাজি নন। তিনি আমাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না।
এসব ভাবনার মাঝেই দেখলাম, একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বলল, "স্যার, আপনাকে এতক্ষণ কষ্ট দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। স্যার, অফিস রুমে আসেন। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।"
হঠাৎ এমন পরিবর্তনে আমি হতভম্ব। পাশে থাকা হাসমত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মনে হলো, সেও কিছুই বুঝতে পারছে না।
আমি অফিস রুমে গেলাম। সেখানে ওসি সাহেব বসে আছেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, "স্যার, বসুন।"
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, "আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করা হলো?"
ওসি বললেন, "কিছুক্ষণ আগে আপনার যে নাম-ঠিকানা নেওয়া হয়েছিল, তা দেখে বুঝলাম আপনি আমাদের ভবিষ্যৎ স্যার।"
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, "কী বলছেন! খুলে বলুন তো।"
তিনি বললেন, "এই থানায় একজনের নামে তদন্ত এসেছে। ওনার নাম-ঠিকানা আপনার নাম-ঠিকানার সঙ্গে মিলে গেছে। আপনি কি ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ, ভাইভা পর্যন্ত দিয়েছি। তা হলে কী?"
ওসি বললেন, "এএসপি পদে আপনাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। তাই আপনার ভেরিফিকেশন রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "নিয়োগপত্র পেলাম না, তার আগেই ভেরিফিকেশন?"
ওসি বললেন, "এই চাকরিগুলিতে আগে তদন্ত হয়। দেখা হয়, আপনি বা আপনার পরিবার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কিনা। রিপোর্ট পাঠানোর পর নিয়োগপত্র দেওয়া হয়।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আপনারা তদন্ত করে কী পেলেন?"
ওসি হাসি দিয়ে বললেন, "আপনার সম্পর্কে যা জানার ছিল, সব জেনেছি। আপনি যে এএসপি হচ্ছেন, তা নিশ্চিত।"
সবকিছু বুঝতে আর বাকি রইল না। আমার পরিবারের একজন বর্তমান সরকার দলের সঙ্গে যুক্ত, সেটাই হয়তো এ ব্যাপারটা সহজ করেছে।
ওসি সাহেব বললেন, "আপনারা চা খাচ্ছেন না।"
আমি বললাম, "চা খাব না। আপনার কাছে বিড়ি হবে? বিড়ি খেতে ইচ্ছা করছে।"
ওসি ভুরু কুঁচকে বললেন, "স্যার, আমার কাছে সিগারেট আছে।"
আমি বললাম, "হাসমতের কাছ থেকে একটা বিড়ি এনে দিন।"
ওসি হাসতে হাসতে হাসমতের কাছ থেকে বিড়ি এনে দিলেন। আমি বিড়ি টানতে টানতে জিজ্ঞেস করলাম, "আমাকে এখানে আর কতক্ষণ থাকতে হবে?"
ওসি বললেন, "এত রাতে আপনি কোথায় যাবেন?"
আমি বললাম, "মুদিপাড়ায় আমার খালার বাড়ি। উনি যেতে বলেছেন।"
ওসি বললেন, "গাড়ি দিচ্ছি, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।"
আমি বললাম, "লাগবে না। আমি হাঁটতে ভালোবাসি।"
ওসি বললেন, "মনে কোনো দুঃখ নিয়েন না, স্যার। আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। আর আমাদের জন্য একটু নজর রাখবেন।"
আমি কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলাম। এবার আমার গন্তব্য—খালার বাড়ি।
পঞ্চম অংশ
এবার আমার গন্তব্য মুদিপাড়ায় খালার বাড়ি।
এত রাতে খালার বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম। তবে যেহেতু থানার কাছেই, একবার চেষ্টা করে দেখাই। আর সুমনা তো সাধারণত রাত জেগে পড়াশোনা করে। আজ আমি আসব, সেটা ও জানে। কাজেই জেগে থাকার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। এসব ভাবতে ভাবতেই খালার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম।
খালাদের বাড়িটি দোতলা ও বেশ গোছানো। দেখতে ভালোই লাগে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, পুরো বাড়িটা যেন এক ধরনের কৃত্রিম বনে পরিণত। খালু বন বিভাগে চাকরি করেন, তাই গাছ নিয়ে তার একটা অন্যরকম শখ। প্রতিটি রুমে টবের ওপর সাজানো বনজ গাছ। নতুন কোনো গাছ পেলেই সেটা বাড়িতে এনে যত্ন করেন। খালু অবশ্য খালাকে একটু ভয় পান। আমার মনে হয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ পুরুষই তাদের স্ত্রীকে একটু-আধটু ভয় পায়। তবে এর মধ্যে একটা গোপন ভালোবাসা থাকে, যা আমরা সহজে বুঝতে পারি না।
দরজায় টোকা দিতেই সুমনা দরজা খুলল।
আমি হাসিমুখে বললাম, "সুমনা, কেমন আছো?"
সে কোনো উত্তর দিল না। আমি মজা করে বললাম, "আমি কি চলে যাব?"
সুমনা রাগি ভঙ্গিতে বলল, "আমার মনে হয় না, বদি ভাই, আপনি চলে যাবেন।"
সে ঠিকই ধরেছে, আমার চলে যেতে একদমই ইচ্ছা করছে না। আমি বললাম, "আমি কি ভেতরে আসতে পারি?"
রাগলে অসম্ভব সুন্দর মেয়েদের আরও সুন্দর লাগে। সুমনার রাগি চেহারাতেও সেই সৌন্দর্য ঝলমল করছে। হঠাৎ সে বলল, "আপনার খালা যখন আপনাকে আসতে বলেছে, অবশ্যই ভেতরে আসবেন।"
সাধারণত সুমনা আমাকে "আপনি" করে বলে না। আজ কেন বলছে, সেটা কিছুটা বুঝতে পারছি। সম্ভবত সে আমাকে পছন্দ করে। মেয়েরা সহজে মনের কথা প্রকাশ করতে পারে না। এটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "খালু কি ঘুমাচ্ছেন নাকি জেগে আছেন?"
সুমনা বলল, "জেগে আছেন। তবে ঘরের বাইরে আসবেন না। আব্বু নতুন একটা গাছ সংগ্রহ করেছেন। গাছ নাকি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। আব্বু তার মনের কথা বুঝানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন।"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "তোমার কি মনে হয়, খালু তার মনের কথা গাছকে বুঝাতে পারবেন?"
সুমনা হেসে উত্তর দিল, "বদি ভাই, মানুষ তো একে-অপরের মনের কথা বুঝতে পারে না। সামান্য একটা গাছ বুঝবে কী করে!"
সুমনার কথাগুলো কেমন যেন গভীর মনে হলো। আমি বুঝতে চাইছিলাম, তবে হয়তো বুঝতে চাইও না। ঠিক সেই মুহূর্তে খালা এসে বললেন, "কিরে, বদি! তুই কখন আসলি?"
ষষ্ঠ অংশ
রাতের গল্প: মুদিপাড়ায় খালার বাড়ি
ঠিক সেই মুহূর্তে খালা এসে বলল, "কিরে বদি! তুই কখন আসলি?"
আমি মাথা নিচু করে বললাম, "জি খালা, এখনই আসলাম।"
খালা চমকে উঠে বলল, "শুনলাম তোর নাকি পুলিশে বিসিএস হয়ে গেছে?"
আমি মাথা নাড়লাম, "না খালা, এখনও হয়নি। থানার ওসি সাহেব আমার তদন্ত রিপোর্ট পাঠাবেন। তারপর পিএসসি বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হবে কি না। তবে খালা, চাকরিটা হলে আমি করব না।"
অবাক হয়ে খালা বলল, "কেন বদি? তুই চাকরিটা করবি না কেন?"
"খালা, আমার পুলিশের চাকরি পছন্দ না। পুলিশের চাকরি হলো অভিশপ্ত চাকরি। আমাদের দেশের মানুষ পুলিশের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে। অনেক ভালো ফ্যামিলির মেয়েকে পুলিশের সঙ্গে বিয়ে দেয় না। আর এর বাইরেও অনেক ব্যাপার আছে যা এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।"
খালার চোখে বিস্ময়, তবে মমতার ছোঁয়া। বললেন, "ঠিক আছে, আগে খাওয়া দে। খুব ক্ষুধা পেয়েছে মনে হচ্ছে।"
আমি হেসে বললাম, "খালা, সুমনা তো কিছু খেতে দেয়নি এখনো।"
খালা হেসে বললেন, "ওর একটু অন্যরকম আচরণ দেখলি না? আজ তোকে 'আপনি' বলে ডাকছে কেন? দুপুর থেকে তোকে আসার জন্য কত কিছু রান্না করেছে। আর তুই এলি মধ্যরাতে! মেয়েটা তোর জন্য এখনো জেগে আছে।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "পিচ্চি মেয়েটা আমার জন্য জেগে থাকবে কেন খালা?"
খালা হেসে বলল, "তোর গলায় ওকে ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য ভাবছি। তোর মা মানে আপা আর দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।"
আমি একটু হেসে বললাম, "খালা, সুমনা তো আমার বোনের মতো। ওকে বিয়ে করার কথা কখনো ভাবিনি।"
খালা বললেন, "এখন থেকে ভাব। সমস্যা কোথায়?"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "খালা, আমার মতো ছেলেরা বিয়ে করে না। শুধু ঘুরে বেড়ায়।"
খালা মজা করে বললেন, "তাতে কী হয়েছে! সুমনাকে নিয়ে তুই যত ইচ্ছা ঘুরে বেড়াস।"
আমি বললাম, "খালা, সুমনাকে একটু ডাকো। শুনি, সে আমার সঙ্গে ঘুরতে রাজি কি না।"
খালা ভেতরে গিয়ে সুমনাকে ডেকে পাঠালেন।
সুমনা এল এবং আমার সামনে খেতে বসাল। খাওয়ানোর ফাঁকে বলল, "বদি ভাই, তোমার এত রাতে আসার সময় হলো?"
সুমনার রাগ মনে হয় কমে গেছে। সে আবার "তুমি"তে ফিরে এসেছে। একটু মজা করে বললাম, "মঙ্গল গ্রহ থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসলাম। সময় তো একটু লাগবে!"
সুমনা হাসি চেপে বলল, "পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব কত জানো?"
আমি হেসে বললাম, "৭.৮ কোটি কিলোমিটার। সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আর সূর্য থেকে মঙ্গলের দূরত্ব বিয়োগ করলেই হিসাব মেলে।"
সুমনা বলল, "বদি ভাই, আমি তোমার সঙ্গে সমস্ত সৌরজগৎ হেঁটে বেড়াতে রাজি আছি।"
এবার মনে হলো, ওকে আর রাগানো যাবে না।
আমি বললাম, "তোমার ভাই সুমন কোথায়?"
সুমনা বলল, "সে একটা রুবিক্স কিউব কিনে এনেছে। সারাদিন ধরে মেলানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।"
আমি বললাম, "সে এখন কোথায়?"
সুমনা উত্তর দিল, "ঘরে আছে, এখনো ঘুমায়নি।"
খাওয়া শেষে সুমনের ঘরের দিকে গেলাম। সুমন আর সুমনা খালার আদরের দুই সন্তান। সুমন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বুদ্ধিমান, তবে কথাবার্তা খুব কম বলে। আমাকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু আমার নামটা ওর পছন্দ নয়।
ঘরে ঢুকতেই সুমন আনন্দে বলে উঠল, "কখন এলেন, বদি ভাই?"
আমি বললাম, "এই তো কিছুক্ষণ আগে।"
সুমন বলল, "বদি ভাই, সারাদিন ধরে রুবিক্স কিউব মেলানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?"
আমি বললাম, "তোমাকে একটা সূত্র দিতে পারি। সমাধানটা তোমাকেই করতে হবে।"
সূত্রটা বলে দিলাম:
F2 U' R' L F2 R L' U' F2।
পাশাপাশি বললাম, "এগুলো হলো পশ্চাৎ তল, উপরি তল, নিম্ন তল, বাম দিক আর ডান দিকের তল। এখন চেষ্টা করো।"
সুমন উৎসাহ নিয়ে সমাধান করতে লেগে গেল। আমি বললাম, "তুমি সমাধান করতে থাকো। আমি একটু খালুর সঙ্গে দেখা করে আসি।"
খালুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মনে হলো, খানিকটা ভয় লাগছে। তবে দেখা করাটা উচিত।
৭ম অংশ
রাতের গল্প: মুদিপাড়ায় খালার বাড়ি (অধ্যায় ৭)
খালুর সঙ্গে দেখা করতে আমার কিছুটা ভয় লাগছিল। তবু সাহস নিয়ে খালুর ঘরের দিকে এগোলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি, খালু টপে রাখা গাছের সঙ্গে বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। আমি ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি এনে বললাম, "খালু, আপনার মন-শরীর ভালো তো?"
খালু আমার দিকে তাকালেন। আমি আবার বললাম, "অনেক সময় দেখা যায়, কারো শরীর ভালো থাকলে মন ভালো থাকে না, আবার মন ভালো থাকলে শরীর ভালো থাকে না। যাদের দুটোই ভালো থাকে, তাদেরকে পৃথিবীর সুখী মানুষ বলা যায়।"
খালু মুচকি হেসে বললেন, "শরীরটা ভালো আছে, কিন্তু মনটা ভালো নেই।"
"কেন, খালু? কোনো সমস্যা?"
খালু একটু ভেবে বললেন, "বদি, তুমি জানো যে গাছেরও প্রাণ আছে, তাই না?"
আমি বললাম, "জি, খালু। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কারের আগে সারা বিশ্বের ধারণা ছিল গাছ জড় পদার্থ। কিন্তু তিনি প্রমাণ করেছেন, গাছেরও প্রাণ আছে। মানুষের মতো তাদেরও সুখ-দুঃখ, আবেগ, অনুভূতি রয়েছে।"
খালু তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, "তুমি জানো। কিন্তু তোমার খালা জানে না। সে বলে আমি পাগল হয়ে গেছি! আমি গাছগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমার খালার এসবের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তাই মনটা খারাপ।"
আমি শান্ত স্বরে বললাম, "খালু, আপনি যা করছেন তা অবশ্যই ভালো এবং গবেষণার মতো কাজ। তবে অনেক রাত হয়ে গেছে। যেমন আপনার ঘুমের প্রয়োজন, তেমনি গাছগুলোরও হয়তো ঘুমের প্রয়োজন আছে।"
খালু কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, "ঠিকই বলেছিস বদি। গাছগুলোকেও তো একটু ঘুমাতে দেওয়া উচিত।"
আমি মজা করে বললাম, "খালু, আপনার গবেষণা সফল হলে গাছগুলোর কাছে একটা প্রশ্ন করবেন। তাদের মধ্যে লোভ, হিংসা, অহংকার আছে কি না? মানুষের মধ্যে এসব অনেক বেশি, তাই জানতে ইচ্ছা করে।"
খালু মুচকি হেসে বললেন, "ঠিক আছে, ওটাই জিজ্ঞেস করব।"
খালুকে ঘুমাতে বলে আমি ঘর থেকে বের হলাম। ঠিক তখন খালার সঙ্গে দেখা।
খালা বললেন, "কিরে, তোর খালুর সঙ্গে দেখা হলো?"
আমি বললাম, "জি, খালা। উনি এখন ঘুমাতে গেছেন।"
খালা হেসে বললেন, "তোর খালুর কথা আর বলিস না। সারাদিন গাছ নিয়ে পড়ে থাকে। তুই কি এখনই চলে যাবি, নাকি আজ রাতে থেকে যাবি?"
আমি বললাম, "না খালা, চলে যাব।"
সুমনের ঘরের দিকে এগোলাম। ঘরে ঢুকে বললাম, "কিরে, সুমন! রুবিক্স কিউব মেলাতে পেরেছিস?"
সুমন উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, "জি বদি ভাই! ১০ মিনিট সময় লেগেছে।"
আমি হেসে বললাম, "ও আচ্ছা! তবে সময়টা আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে হবে।"
সুমন গম্ভীর হয়ে বলল, "জি বদি ভাই, চেষ্টা করব।"
এরপর সুমন জিজ্ঞেস করল, "বদি ভাই, তুমি কি এখন চলে যাবে?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ, কলেজপাড়ায় এক বন্ধু মেসে থাকে। অনেকদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। একটু দেখা করে আসব।"
সুমন তখন বলল, "বদি ভাই, সুমনা আপু তোমাকে একটা চিঠি দিতে বলেছে। আমি কি তোমাকে দেব?"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "সুমনা চিঠি দিয়েছে? কেন?"
সুমন বলল, "আপা যখন চিঠিটা তোমাকে দিতে বলছিল, তখন খুব কাঁদছিল। তবে ওর কান্নার কারণটা আমি বুঝতে পারিনি।"
আমি কিছু বললাম না। কেবল বললাম, "চিঠিটা নিয়ে আসো।"
সুমন টেবিল থেকে চিঠি এনে দিল। চিঠিটা নিতে ইচ্ছা করছিল না, তবু নিলাম। কিন্তু পড়লাম না। চিঠিটা পকেটে ভরে খালার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
এবার আমার গন্তব্য কলেজপাড়া, বন্ধুর মেসে। বন্ধু আব্দুল মোতালেবের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। নতুন গন্তব্যের পথে হাঁটা দিলাম...
অষ্টম পর্ব: রাতের নির্জনতায় বন্ধুর মেসে
আমার বন্ধু আব্দুল মোতালেব এক অসম্ভব মেধাবী ছাত্র। কঠিন থেকে কঠিন বিষয়ও খুব সহজে আয়ত্ত করতে পারে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ইসলামিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তবে জীবনের বড় হিসাবগুলো মেলাতে গিয়ে যেন সে একটু ব্যর্থ। এখন অনেক রাত হয়েছে। এত রাতে তার মেসে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারছি না। কিন্তু আজ রাতটা কোথাও কাটাতে হবে, আর তার মেস ছাড়া বিকল্প কিছু মাথায় আসছে না।
বন্ধুর মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেসে পৌঁছে গেলাম। মেসের পরিবেশ রাতের মতোই নির্জন, তবে এখানে রাত জেগে থাকা ছেলেদের অভ্যাস। কেউ লেখাপড়া করে, কেউ কার্ড খেলে, কেউ বা মোবাইলে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্পে মেতে থাকে। তবে আব্দুল মোতালেবের বেলায় সবটাই ব্যতিক্রম। সে নিরিবিলি পড়ালেখার জন্য একক একটি রুম নিয়ে থাকে। তার রুমের দরজায় গিয়ে ডাকতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ ডাকার পর সে দরজা খুলল। আমি এত রাতে এসেছি দেখে তার মধ্যে কোনো বিস্ময় নেই। একটুও সময় না নিয়ে সে আবার পড়ার টেবিলে ফিরে গেল।
আমি বললাম, "বন্ধু, আজ রাতে তোর কাছে থাকব।"
সে ভুরু কুঁচকে বলল, "আমি জানতাম তুই আমার কাছে থাকবি। নইলে এত রাতে কে গল্প করতে আসে?"
তারপর সে বলল, "তুই একটা কাজ কর এখন। ড. মোহাম্মদ ইউনুস মার্কা একটা ঘুম দে।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "সেটা কেমন ঘুম?"
সে হাসিমুখে বলল, "শান্তির ঘুম। ড. মোহাম্মদ ইউনুস অর্থনীতিবিদ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ভাবা যায়, বন্ধু? শান্তির জন্যও অর্থ লাগে! তাই কথা না বাড়িয়ে তুই ঘুমিয়ে পড়। আমার কিছু পড়াশোনা আছে। শেষ করে আমিও ঘুমাব।"
আমি হেসে বললাম, "কি এমন পড়াশোনা করিস, যে সারারাত লাগে?"
সে বলল, "আমি 'সময়' নিয়ে পড়াশোনা করছি। শোন, পদার্থের ক্ষুদ্রতর কণা নিউট্রিনোরা নাকি আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। এই বিষয়টা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল তর্ক চলছে। যদি সার্নের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পারেন, তবে আমরা সময় পরিভ্রমণের (টাইম ট্রাভেল) সম্ভাবনা পেতে পারি। তবে বড় সম্ভাবনা হলো, আমরা হয়তো কখনোই টাইম ট্রাভেল করতে পারব না। এর কারণ টাইম ট্রাভেল অসম্ভব নয়, বরং আমরা আবিষ্কার করতেই পারব না।"
বন্ধুর এই গভীর চিন্তার মাঝেই আমি বললাম, "বন্ধু, আমার সময় নিয়ে ভাবার সময় নেই। বরং সময় থাকতে ঘুমিয়ে নিই। তুই তোর 'সময়' নিয়ে চিন্তা কর।"
ড. মোহাম্মদ ইউনুস মার্কা শান্তির ঘুমের জন্য শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর দুটো ভালো পদ্ধতি আমার জানা আছে। এক, উল্টো দিক থেকে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত গণনা করা। দুই, নিউজিল্যান্ডের কোনো বড় সবুজ মাঠ কল্পনা করা, যেখানে অনেক গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখান থেকে একটা একটা করে গরু গণনা করা। আমি এই দুটির যেকোনো একটা পদ্ধতি বেছে নিলাম.......