“তুমি যতক্ষণ নীতির মধ্যে আছ ততক্ষণ জেনো তোমার সাড়া
যেমুহূর্তে তুমি নীতিহারা সেমুহূর্তে শুরু তোমার পতনের ধারা”
‘কপাল ভালো’ ‘কপাল খারাপ’ ‘কপালে আছে’ ‘কপালে নেই’ ‘কপালগুণে’ ‘কপালদোষে’ ‘কপাল এমন’ ‘হায় রে কপাল’ ইত্যাদি—কপালকে ঘিরে ভালোমন্দের কত কথাইনা হয় তত কথা বোধহয় অন্যকোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হয় না। কতইনা অঘটন ঘটে গেছে—ঘটে যাচ্ছে এই বিশ্বে—মহাকাশে—মহাদেশে—দেশে দেশে—ঘরে-ঘরে কার খবর রাখি কে? সৃষ্টিকে নিয়ে আজ আমাদের কী উৎসুক—কত আস্ফাল! হায়! কাল কী হবে—কী হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে যদি এটুকু জানতাম সবাই! দেখছি দিনদিন শুধু পৃথিবীর উন্নতি বাড়ছে, দেখছি না অভ্যন্তরে তার কী অবনতি ঘটছে। মানুষ সৃষ্টি থেকেই ‘যুদ্ধ’ ‘যুদ্ধ’ করে মরছে আর মারছে! কে কার ঘর—কার দেশ দখলে নেবে প্রতিনিয়ত তার চর্চা চলছে। কাল বাঁচব কি না, কী ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে পৃথিবীর জন্যে এবং কী হতে পারে প্রকৃতির রূপ—কেউ কি জানি তা? জানি না। কারণ, ধারণার ওপর কোনো কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং হবেও না। ভবিষ্য জানার আগ্রহ সবার থাকলেও জানা সম্ভব নয়। কারও কারও মতে, আজ বাঁচতে পারলেই হয়। আমি খেতে পারলেই হয়। আমার সুবিধা হলেই হয়। আমরা কেবল নিজ নিজ স্বার্থের কথাই ভাবি। অনাত্মীয় দূরে থাক, আত্মীয়তা ও স্বজনপ্রীতিতেও আজ আমরা বিমুখ। আমাদের কাছে আজ কোনো বন্ধনেরই গুরুত্ব নেই। অর্থের কাছে সম্পর্ক এতটাই গৌণ হয়ে যাচ্ছে যে, যতটা-না উচ্চের কাছে তুচ্ছ। এভাবে চলতে চলতে কবে নাজানি দয়ামায়া, আদরস্নেহ ও শ্রদ্ধাশীল কথাগুলোন বা শব্দগুলো মানুষের অন্তর থেকেই শুধু নয়, মুখ থেকেও মুছে যায় কে জানে! ‘বিপদে বন্ধুর পরিচয়’ এমন কথা হয়তো একদিন প্রবাদেও থাকবে না। মানুষ মায়ামমতা থেকে ক্রমান্বয়ে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। ‘সবকিছু অদৃষ্টের লিখন’ যারা সব সময় কপালের দোষ দিয়ে বসে থাকে, তারা নাজানি সাঙ্ঘাতিক ঘটনাবলী বা দৈবত্বকে কী বলে! আর কেউ ‘উদ্দেশ্যহীন’ ‘উদ্দেশ্যহীন’ বিশ্ব নিয়ে পাগলামির যাত্রায় নেমেছে! বোঝা দরকার, অন্ধ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু অন্ধের মতো চোখ বন্ধ করে সবকিছু মেনে নেওয়া অস্বাভাবিক। যারা মধ্যম তারা হয়তো চিন্তাশীল। কোনেক অদৃশ্য ইশারায় সবকিছু চলছে এবং ঘটছে। প্রত্যেক চলনা আর ঘটনার পেছনে যে কোনো কারণ নেই (উদ্দেশ্যহীন) এমন ভাবা অযৌক্তিক। কিছু-না-কিছু হেতু তো অবশ্যই আছে—সমস্ত ঘটনের পিছে। যতই যুক্তি থাকুক, এমনি এমনি কোনো কিছুই ঘটে না এবং ঘটবে না। তদ্রূপ মানতে হবে, কপালদোষে ও কপালগুণেও সবকিছু হয় না; কিছু ঘটনা আদতের দ্বারাও ঘটে থাকে।
‘কপাল’ ‘কপাল’ করে বনেজঙ্গলে ঘুরলে কপাল প্রসন্ন হয় না। কপাল ভালো হয় বুদ্ধির জোরে। টাকার বস্তা আসমান থেকে নেমে আসে না, তা নিজেকেই উপার্জন করে নিতে হয়। ভাগ্যের চেয়ে অবস্থান বড়। অবস্থান ভালো হলে ভাগ্যও ভালো। মান তো একটা প্রত্যেক জিনিসেরই থাকে এবং আছে তবে থাকলেও সব তো আর মানী হয় না, তদ্রূপ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সকলে জ্ঞানী হন না। অনেক শিক্ষিতদের মধ্যেও দেখা যায় বিবেকহীন কাজ করতে! সবকিছু কপালের ওপর নির্ভর করা যেমন চলে না আবার সবকিছুতেই কপালের দোষ দেওয়াও ঠিক না। ‘ভালোমন্দ কপালের লিখন’ ঠিক আছে তবে স্বভাবচরিত্র কপালের লেখা নয়। ভাগ্যে যা আছে ঘটুক—চোখবুজে দিলাম ঝাঁপ আগুনে, হা-হা-হা...আমি কোন মহাপুরুষ ভাই রক্ষা করবেন রক্ষাকারী? আগে আমার আমিকে বুঝতে হবে এবং ভালোভাবে জানতে হবে, তারপর খুঁজতে হবে বাঁচার রাস্তা; তারপর পথ দেখালেও দেখাতে পারেন দিশারি। এককথায়—আমার আমিকে বুঝতে অক্ষম হলে সবকিছুকেই বোঝা অক্ষম।
‘অদৃষ্টের লিখন খণ্ডানো যায় না’ তবে কিছু কর্মগুণে অদৃষ্টই বদলে যায়। বিধি ভাগ্যের রচয়িতা কিন্তু মানুষ কর্মের স্রষ্টা। মনে রাখা দরকার চিরন্তন কথা—ভালো কর্মের ফল সব সময়ই ভালো। কাউকে মারতে গেলে নিজেই মরতে হয়। কাউকে আঘাত করলে নিজেই আঘাতী হতে হয়। অপমানের দরদ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কখনো কাউকে লাঞ্ছিত করা ঠিক না। কখনো কিছু অবহেলা করাও ঠিক নয়। একটি গাছ থেকে লক্ষ দিয়াশলাইয়ের কাঠি বনতে পারে, আবার একটি কাঠি লক্ষ গাছেরও বিনাশক হতে পারে। সুতরাং কাউকে ক্ষুদ্র ভাবতে নেই। আমি দেখছি ছয় তুমি দেখছ নয়। আমি আমার জায়গাতেই ঠিক তুমি তোমার জায়গাতেই সঠিক। তবে? ভুল-শুদ্ধের বিচার তখনই করা যায় বা যাবে যখনই তুমি আমার জায়গায় আমি তোমার জায়গায় অবস্থান করি বা করব। চোখের দেখাও সব সময় শুদ্ধ নয়। ভুল আর শুদ্ধ বুঝতে হলে জায়গা পরিবর্তন অতীব জরুরি। কাউকে এক আঙুল দেখাতে গেলে নিজের দিকে তিন আঙুল তাক করে থাকে। হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে হাজার পিপীলিকা একবারে মারা যায় কিন্তু কখনো আবার একটি পিঁপড়া হাতির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই নিজেকে ক্ষমতাবান বা শক্তিশালী মনে করাও ভুল। চাল এখন তোমার হাতে একটুপর আমার হতে দেরি নেই। আজ তুমি রাজা—রাজত্ব তোমার—কিন্তু, মনে রেখো, সময় স্থির নয়—প্রকৃতি পালটে যায় মুহূর্তেই। কারও ক্ষতি করে নিজের পথ সুগম করার মতো অপরাধ আর কিছু নেই। সৎপথ অবলম্বন করা কঠিন তবে অসৎপথে চলা মারাত্মক অন্যায়। এই জিন্দেগি বড়ই ক্ষীণ, এখানে অমরত্ব লাভ করা যেমন যায় না তদ্রূপ অমরকীর্তি সৃষ্টি করাও সহজ না।
কিছু কিছু সত্য খুব তিক্ত হয়। যেখানে এধরনের সত্যের তিক্ততা রয়েছে সেখানে মিথ্যাকেই পথ দেওয়া ভালো। কারণ, এমন কিছু সত্য—যা প্রকাশ করলে রক্তপাতের আশঙ্কা বা কারও জিন্দেগি বিপন্ন কিবা বিরান হতে পারে, এমন সত্যের সামনে মিথ্যাকেই গ্রাহ্য করা মঙ্গলের কাজ। কথায় আছে, একটা অপরাধে যদি দশটা উপকার হয় এবং দশটা অপরাধে যদি পুরো জাতির মঙ্গল হয়, তা হলে সেই অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। একের কষ্টে যেখানে দশের কষ্ট, সেখানে মিথ্যাই যদি মঙ্গল তবে মিথ্যাকেই সত্যরূপে মেনে নেওয়া উত্তম। এরূপ মিথ্যার কাছে নুয়ে যাওয়া সত্যের পরাজয় নয়। ক্ষতির চেয়ে মীমাংসা উত্তম। যারা মীমাংসা মেনে নিতে পারে না তারা ক্ষতির থেকে বাঁচতে পারে না। ‘সত্য’ ‘সত্য’ করে গলা ফাটালে মিথ্যা কখনো সত্য হয়ে যায় না। অতএব, মিথ্যার জোরে সত্যকে কখনো দাফন করতে যেয়ো না। বিধির বিধান আসল জায়গাতেই স্থির থাকে। আমাদের কাজ ও কথা এবং স্থান পরিবর্তন হয় বলে আমরা কেউই আসলে সত্যবাদী না। আমরা আসলেই মিথ্যুক—বিবাদী, বিবাদ আমাদের ধর্ম। সকলেই প্রতিদিন কিছু-না-কিছু এবং কার কাছে না কার কাছে সত্য বা সততার অভিনয় করি! মানুষ এমন এক জাতি, হিংসার আগুনে সারা জীবন জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে পারে কিন্তু সামান্য একটু ভালোবাসার বণ্টনে এতটুকুন পথ চলতে পারে না। এটাই মানুষের ধর্ম এবং এটাই মানুষের কীর্তি! এটার একমাত্র কারণ হচ্ছে—ধোঁকা। মানুষ ধোঁকা খেতে খেতে একসময় নিজেই ধোঁকাবাজে পরিণত হয়। দুনিয়ার অভিধানে হয়তো ‘ধোঁকা’ শব্দ না থাকলে ‘মিথ্যা’ শব্দও থাকত না।
‘আপদ কেটে গেলে আমি নিরাপদ’ তবে সবক্ষেত্রে বিপদ ডিঙিয়ে যেতে পারলেই বেঁচে যাওয়া ভুল। সবখানে সমস্যাকে এড়িয়ে গেলে সমাধান নয়। অপরাধী যে-ই হোক, অপরাধকে ঢাকতে গেলে অন্যায় বাড়বেই। ন্যায়ের সমাদরে এবং সততার সঙ্গে কেউ পথ চলতে না পারলেও মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করা ক্ষতি। প্রতিটি ঘরের কর্তা, প্রতিটি সমাজপতি, প্রতিটি মহল্লার প্রধান এবং প্রতিটি বিভাগের চালক সৎ হলে সততা একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। মানুষ ভুল করবে তবে বারবার ভুল করা মানুষের বোকামি নয়, স্বভাব—দোষের। অভ্যাসের দাস বলে কোনো কথা নেই। চেষ্টাই সবকিছু অর্জন এবং চেষ্টাই সবকিছু সফল। চেষ্টা করতে হবে। মন উদার এবং পরিষ্কার রাখতে হবে। আদত বদলাতে হবে। তবেই একটি জাতি বা দেশ উন্নতির শীর্ষে পৌঁছা কিবা বদলে যাওয়া সম্ভব। একজন হীনমন্যতা নিয়ে পথ চললে আরেকজন উদারমনা হতে পারে না কথা ঠিক নয়। উদারমনা যে সে সবখানেই উদার। মন্দের আশ্রমে বসবাস করে ভালো স্থান তৈরি করা মানুষগুলোই উন্নতি করে বা মানুষ বনে। জীবনের সফলতা আসে মানুষ বনা থেকে।
একদম ঠিক, মানুষ যা কল্পনা করে তা কখনো হয় না আর যা কল্পনা করে না হঠাৎ তা-ই হয়ে যায়! আমি কখনো কল্পনা করিনি কালি ও কলমের সঙ্গে হবে আমার হৃদ্যতা এবং ঘনিষ্ঠতা। ভাগ্যে কাকে কোথায় নিয়ে যায় এবং কাকে কোথায় এনে দাঁড় করায় একমাত্র ভাগ্যরচয়িতায় ভালো জানে, যিনি ভালোমন্দের কপাললেখক এবং রচকের রচক। কোনো বৈদ্য, ওঝা, কবিরাজ ও জ্যোতিষীর ভালোমন্দ কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কেউ পানির ওপর হাঁটছে তো কেউ ওড়ছে হাওয়ায় ওটা কারও ভাগ্য নয়—একমাত্র সাধনার বল। মানুষ বলতেই সকলে এক। শুধু মানুষের কর্ম ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, মস্তিষ্কের চিন্তা ভিন্ন, অন্তরের ভাব ভিন্ন আর গায়ের রং ভিন্ন এবং চাহার চাহনি ভিন্ন। এখানেই মানুষের ভিন্নতা আর এখানেই মানুষের অমিল। অন্যথায় সকলে সমান এবং সকলেরই পরিণতি এক।