
বা রে, আমাক বাঁচাও রে।
একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। কন্ঠস্বরের মালিক এদিকেই ছুটে দৌঁড়ে আসছে মনে হয়। হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল লাবু মাস্টার। রাত প্রায় ১ টা বাজে। এমপি সাহেবের বাড়ির এলাকায় কে বলছে– আমাকে বাঁচাও রে?
আ… আ… আ… আমাক বাঁচাও রে!
লাবু মাস্টার আবার হতভম্ভ হয়ে গেল। এমপি মহোদয় সাকলাইন চৌধুরী রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন । বোঝা যাচ্ছে লোকটা মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় আছে। দৌড়ানোর ভঙ্গি এলোমেলো। একটু পেছনেই দেখা গেল, এমপি সাহেবের স্ত্রী বড় একটা বটি নিয়ে ধাওয়া করছে তাকে !
এমপি সাহেবের স্ত্রীর কন্ঠ শোনা গেল— তোরে আইজ মাইরা ফালামু। প্রতি রাইতে, নতুন নতুন ** লাগে তোর। বুড়া শুয়োর।
এমপি সাহেব দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন । তার পা আর চলছে না। পেছনে তার স্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছে লাবু মাস্টার। মহিলার চোখের দৃষ্টি ভয়ানক। আজ মনে হয় খুনোখুনি হবে।
রাস্তায় লাফিয়ে এগিয়ে গেল লাবু মাস্টার। তাকে দেখে এমপি সাহেব জড়িয়ে ধরে বলল, বাঁচা রে লাবু, বাঁচা।
লাবু মাস্টার এমপিকে এক পাশে আড়াল করে বলল, ভাবী থামেন, থামেন। ভাবী থামেন।
পরদিন সকাল। রাস্তাটা নিরিবিলি। বাড়িটির বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কি হচ্ছে। এটা এমপি সাকলাইনের প্রাইভেট চেম্বার। সেখানে সারি সারি বিদেশী মদ সাজানো। আজ চেম্বারে লাবু মাস্টার সহ কয়েকজন বসে আছে । সাকলাইনের চোখ বন্ধ। সে বন্ধ চোখ মাঝে মাঝে খুলছে, মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ সে নতুন একটা গ্লাসে মদ ঢালল। লাবু মাষ্টারের দিকে এগিয়ে দিল। বলল, খা রে লাবু।
লাবু মাস্টার মদ খায় না। সে সাকলাইন খানের প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট স্কুলের হেডমাস্টার। এককালে রাজনীতি করত। ছিল জেলা সরকারী কলেজের ছাত্র সংগঠনের লিডার। সরকার পরিবর্তনের পর র্যাবের অভিযান শুরু হলে তাকে ৪ বছর নানার বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল । এরপর একসময় আবার সরকার পরিবর্তন হয়। রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ হয় লাবুর। কিন্তু সে কানে ধরে তাওবা করেছে, রাজনীতি আর করবে না। সুন্দরমত বৌ-বাচ্চা নিয়ে জীবন কাটাবে। কিন্তু পুরাতন রাজনীতির জের ধরে এমপি সাকলাইন তাকে এখনো দাম দেয়।
লাবু গ্লাস সরিয়ে রেখে বলল, খাই না এখন বস। এমনিই লিভারের জায়গায় ব্যাথা হয়। ভয় লাগে, কখন মরে যাই!
এমপি সাকলাইন চোখ খুলে মুচকি হাসল । সামনে আবার ইলেকশন। সবাইকে হাতে রাখতে হবে তার। লাবু মাস্টার রাজনীতি ছেড়ে দিলেও খুবই বিশ্বাস্ত লোক। গতকাল রাতে তাকে বাঁচিয়েছে সে। অবশ্য বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। সাকলাইন চৌধুরী মনে মনে ভাবছেন ।
এমপি সাকলাইন একটা টাকার ব্যাগ বের করে এগিয়ে দিলেন সবার সামনে। বললেন, ভাগ করে নে সবাই।
সাকলাইনের মুখে হাসি লেগেই আছে। সামনে নির্বাচন। এজন্য প্রচুর টাকা ঢালতে হবে এখন। সমস্যা নেই। টাকার কমতি নেই তার। গত ৪ বছরে শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি, ব্যাবসা হয়েছে । এটা অবশ্য সরকারী দলের এমপিদের সম্পদের তুলনায় কিছুই না। সাকলাইন শরীক দলের এমপি। এজন্যই তার আয়ের কমতি আছে । এই কমতি তিনি সামনের বার পুষিয়ে নিতে চান ।
সবাই এমপির চেম্বার থেকে চলে গেলেও সাকলাইন নিজে যান না। বেশ কিছুদিন হলো তিনি নিজের বাসায় থাকছেন না। থাকছে্ন না বললে ভুল হবে। তাকে তার স্ত্রী থাকতে দিচ্ছে না। স্ত্রী হুমকি দিয়েছে, দেখা মাত্রই বটি দিয়ে কোপ দিবে সে। নিজের স্বামীকে কুপিয়ে মারবে। এজন্য চেম্বারেই বসবাস । এমপির আফসোসও হচ্ছে, আবার রাগও হচ্ছে। কিন্তু কী করার আছে? আর তার স্ত্রীর অভিযোগ মিথ্যা নয়। আসলেই তার প্রতিরাতে নতুন নতুন ** প্রয়োজন হয়। চমৎকার কিছু সাপ্লায়ার আছে। দূর দূরান্ত থেকে তারা সাপ্লাই দেয়। মোটা অংকের টাকা দিয়ে পুষতে হয় তাদের।
সাকলাইন চৌধুরী দীর্ঘদিন রাজনীতি করে এইবারই প্রথম এমপি হয়েছেন। এজন্য ভেবেছিলেন, জীবনে তো মোজ মাস্তির প্রয়োজন আছে! কত রিস্ক নিয়ে তাকে রাজনীতি করতে হয়েছে, গত সরকারের মেয়াদে ৩ বছর জেল খাঁটতে হলো । সামনের বার সরকার পরিবর্তন হলে আবার জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাজনীতি করতে হলে এক পা জেলে রেখে রাজনীতি করতে হয়। রিস্ক যেমন লাভও তেমন! অবশ্য সামনের বার সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। সরকারী দল নানান ফন্দি করে একতরফা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মানে হলো, যে শরীক দল যে আসনে মনোনয়ন পাবে, যার মনোনয়ন চূড়ান্ত হবে সেই এমপি হবে। সোজা রাস্তা!
সাকলাইন চৌধুরী সরকারী দলের প্রধানের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক করার জন্য অনেক চেষ্টা চরিত্র করছেন। আর নিজ দলের চেয়ারম্যানের সুনজরে তিনি আছেনই। তার মন খুশি খুশি।
পড়ন্ত বিকেল। চেম্বার ফাঁকা। একা একা ভালো লাগছে না এমপির । তিনি গ্লাসে মদ ঢেলে নিলেন। এ নিয়ে পাঁচ গ্লাস। তার হঠাৎ মনে হলো, নাহ! মদ খাওয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে লিভার নষ্ট হয়ে আবার হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হবে। কিন্তু নেশা ছাড়া কি সহজ? মদের নেশা বড় নেশা। আর তার চেয়ে বড় নেশা নতুন নতুন তরুনী *** নেশা। হা হা। আবার রাজনীতির নেশা বড়ই নেশা! এমপি হওয়ার নেশা বড়ই নেশা! হা হা। হা হা। সাকলাইন চৌধুরী ভাবছেন, মদ কি তাকে মাতাল করে ফেলেছে? এরকম মাতলামি কথা ভেবে যাচ্ছেন কেন তিনি? নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারালে তো চলবে না! রাজনীতি করতে হলে জাতে মাতাল তালে ঠিক ঠাকতে হবে! না ভুল হয়েছে। বরং মদে মাতাল তালে ঠিক থাকতে হবে! হা হা। হা হা।
ঘন্টা খানেক পর। চেম্বারে গোল করে বসে আছে এমপির খাস লোকেরা। তার মধ্যে একজন এইমাত্র এমন একটা খবর শোনালো, যা শুনে সাকলাইন চৌধুরীর কান ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করেছে। চেহারায় তার লাল আভা। তিনি ঘন ঘন মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি… আবার বল।
একপাশ থেকে লোকটি বলল, কনফার্ম খবর এমপি সাব। চেয়ারম্যানের ভাগনে বিদেশ থেকে দেশে আইতাছে। দেশেই থাকব। এই আসনে তারে মনোনয়ন দিব চেয়ারম্যান স্যারে। নিজের ভাগনে বলে কথা।
সাকলাইন চৌধুরী বলে উঠে, যেকোনভাবেই হোক, যেকোনো শর্তেই হোক, আমার এমপি থাকা লাগবে। চেয়ারম্যান স্যারের সাথে সাক্ষাত করার ব্যাবস্থা কর। বড় মিটিং করার মত সময় লাগবে। যা, সবাই যা।
লোকটি বলল, ওকে বস।
মাস পার হয় নি। এক ঝাঁ ঝাঁ রোদে ভরা দুপুর। চারপাশের গাছে থাকা কাকগুলোর কা কা আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে তাদের গলা ভীষন শুকনো। সাকলাইন চৌধুরী খুব ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজ দলের চেয়ারম্যানের চেম্বার থেকে বের হয়ে আসছেন। তার পাশে ৪ জন খাস লোক। তারা পিছু পিছু বের হচ্ছে। সাকলাইনের বুকে ব্যাথা হচ্ছে। কুৎসিত গালি দিতে ইচ্ছে করছে চেয়ারম্যানকে। কিন্তু না। ধৈর্য্য ধরতে হবে। ধৈর্য্য। চেয়ারম্যান তাকে মনোনয়ন দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু পেপারমিল ছাড়া তার শত শত কোটি টাকার সব সম্পত্তি লিখে দিতে হবে চেয়ারম্যানের নামে। এমপির খাস লোকেরা তাকে পরামর্শ দিয়েছে, এবার মনোনয়ন না নিতে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এমপি তাকে আবারো হতেই হবে। সব সম্পত্তি লিখে নিবে তো কি হয়েছে। পরেরবার এমপি হয়ে গেলে, সব পুষিয়ে নিতে পারবে। সমস্যা হবে না।
এমপি সাকলাইন দ্রুত পদে হেঁটে নিজের গাড়িতে উঠে গেলেন। বাইরের তীব্র রোদে ভালো লাগছে না তার। গাড়িতে এসি আছে। ঠান্ডা। যদিও তার মন ঠান্ডা নেই। খচখচ করছে।
কয়েকদিনের মধ্যে সাকলাইন চৌধুরী তার সব সম্পত্তি লিখে দিলেন দলের চেয়ারম্যানের নামে।
কিছু মাস পরেই নির্বাচন। মনোনয়ন প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। এমপি সাকলাইনের আসনে নাম এসেছে বাংলাদেশ গ্রামবাংলা পার্টির চেয়ারম্যানের আপন ভাগনে ‘সাদাব নাহিয়ান খানের’। সাকলাইন চৌধুরী একা তার চেম্বারে বসে আছেন। তার চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। তিনি এক হাতে মদের গ্লাস উঠানামা করছেন। আরেক হাতে চোখের পানি মুছছেন।
পরিস্থিতি তিনি এখনো মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেন নি। তার মনে হচ্ছে, ভুল হয়েছে কোথাও, ভুল হয়েছে। তিনি আবার চেয়ারম্যানের কাছে যাবেন। স্মরণ করিয়ে দেবেন সেই মিটিং এর কথা। না, এখনই ভেঙ্গে পরার কারন নেই। সময় আছে এখনো। সময় আছে।
কিছুক্ষন পরেই সাকলাইন চৌধুরীর মন পরিবর্তন হলো। তিনি এখন বুঝতে পারছেন, তার আর কিছু করার নেই। তিনি নিজ দলের বুড়ো চেয়ারম্যানের কাছে চরম ভাবে ঠকেছেন। এখন তার সম্পদ বলতে আর কিছুই নেই। নিজের বাড়িটিও করেছিলেন স্ত্রীর নামে। সেই স্ত্রী তাকে খুন করার জন্য ওঁত পেতে আছে।
এমপি মহোদয় সাকলাইন চৌধুরী রাগে ক্ষোভে ফুঁসছেন। তার মন বলছে, মুনাফিক সম্রাট গ্রাম বাংলা পার্টির চেয়ারম্যানের আপন ভাগনে এই আসনে একাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে। অন্য কারো পাত্তা থাকবে না সেখানে। দলের জন্য সাকলাইন চৌধুরীর দীর্ঘ দিনের ত্যাগ তিতিক্ষা সব জলে যাবে।
সাকলাইন চৌধুরী মাথা নিচু করে কঠিন কিছু অভিশাপ বানী উচ্চারণ করলেন নিজ দলের চেয়ারম্যানের নামে। তার বুক হাহাকার করে উঠছে। বারবার মনে হচ্ছে, তিনি আর এমপি নন। তিনি আর এমপি নন। এই চরম বাস্তবতা মেনে নিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। অথচ এই এমপি হওয়ায় জন্য তিনি কত কিছু করেছেন ছাত্রাবস্থা থেকে। কত কিছু! এমনকি খু* … ! না, না থাক। এখন এসব চিন্তা করতে নেই। না, তিনি কোনো অন্যায় করেন নি। তিনি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। এমপি হয়ে মানুষের সেবা করেছেন। অন্যায় আর মুনাফেকী যদি কেউ করে থাকে তাহলে সেই ব্যক্তি হলো তার পার্টির চেয়ারম্যান। তার শত কোটি টাকার সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারী বানিয়ে ছেড়েছে এই শয়তান।
এমপি সাকলাইন নিজেকে সামলাতে পারছেন না। তার শরীর ভেঙ্গে কান্না আসছে। সুস্বাদু মদও কেমন বিস্বাদ লাগছে ।