সহযাত্রীনী | থ্রিলার ফিকশন | তৃতীয় পর্ব
২৪ জুন ২০২৪
Naoroz Bipul
স্থানীয় থানায় এসে হাসীব বুঝতে পারলো, নুমা এই থানার অফিসার-ইন-চার্জ। নিজের চেম্বারে নিয়ে এসে হাসীবকে বসালো নুমা। ওর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে- মেয়েটার ইশারা দেখে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে, প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে ফিরে এসে, মেয়েটার ডেডবডি আবিষ্কার করা পর্যন্ত- সব কথা জানালো হাসীব।
‘ধরা পড়ার পর সব ক্রিমিনালই এই রকম হাস্যকর গল্প তৈরি করে।’ সব শুনে বলল নুমা, ‘শর্মিলা, এফআইআর রেজিষ্টার নিয়ে এসো।’
নিজের ডেস্ক থেকে এফআইআর রেজিষ্টার নিয়ে আসলো লেডি এসআই শর্মিলা। রেজিষ্টার নিয়ে নিজেই কিছু লেখালেখি করলো নুমা। এক সময় থামলো। হাসীবের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার ওয়াইফের নাম কী ছিল?’
‘ম্যাম, মেয়েটা আমার ওয়াইফ না!’ বলল হাসীব, ‘আমি তার নাম জানি না। ভেবেছিলাম, বাকি রাস্তা আসতে আসতে তার নাম পরিচয় জেনে নিবো। কিন্তু সেই সুযোগ আমার হয়নি।’
‘লেডি অফিসার দেখে আমাকে কোমল হৃদয়ের নারী মনে করলে ভুল করবেন।’ বলল নুমা, ‘রিমান্ডে নিয়ে এসে এমন ধোলাই দেবো- বউয়ের নাম তো কি, শাশুড়ীর মায়ের নাম পর্যন্ত দিবেন।’
‘আপনি তা করতেই পারেন ম্যাম, তাতে আপনার পণ্ডশ্রম হবে।’ বলল হাসীব, ‘আমার যা বলার তা বলে দিয়েছি। বিশ্বাস করা না করা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার।’
এসআই শর্মিলার দিকে তাকালো নুমা। বলল, ‘মেয়েটার যা কিছু আছে সব সার্চ করো। পরিচয় নিশ্চিত করা যায় তেমন কিছু পাওয়া যায় কি না দেখো।’
শর্মিলা চলে আসলো। ফিরে আসলো কয়েক মিনিট পর। মেয়েটার হ্যান্ডব্যাগটা ডেস্কের উপর রাখলো। বলল, ‘শুধুমাত্র প্রসাধন সামগ্রী ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায়নি স্যার।’
‘এনআইডি কার্ড?’
‘নাই।’
‘এই ভদ্রলোকের গল্প মতে- মেয়েটা নাকি কোনো কর্পোরেট অফিসে জব করতো।’ বলল নুমা, ‘কোনো অফিসের আইডেন্টিফিকেশন কার্ড?’
‘সেটাও নাই স্যার।’
‘ডেডবডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দাও। পিস্তলটা পাঠিয়ে দাও ব্যালেস্টিক টেস্টের জন্য।’ বলল নুমা, ‘আর ফরেনসিকে খবর দাও। তারা আসলে গাড়িটা তাদের কাছে হ্যাণ্ড ওভার করো। হাসীব সাহেব, আপনার মোবাইল ফোন দেন।’
মোবাইল ফোন বের করে ডেস্কের উপর রাখলো হাসীব। হাত বাড়িয়ে মোবাইল ফোন টেনে নিলো নুমা। ডিসপ্লে অন করলো। হাসীবের দিকে ধরলো। পাসওয়ার্ড দিয়ে মোবাইল ফোন আনলক করে দিলো হাসীব। ওর মোবাইল ফোন নিয়ে কী করছে তা সে বুঝতে পারলো না। দীর্ঘ সময় নিয়ে কোনো কথা না বলে মোবাইল ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকলো নুমা। এক সময় আবার মোবাইল ফোনটা হাসীবের দিকে ঘুরিয়ে ধরলো। ডিসপ্লেতে আঙ্গুল তাক করে বলল, ‘এইটা কি?’
সেই মেয়েটা আর হাসীবের কিছুটা অন্তরঙ্গভাবে তোলা সেলফি। ইদানীং যখন তখন সেলফি তোলা একটা স্টাইলে পরিনত হয়ে গেছে। পরিচিত অপরিচিত যে-ই হোক- সুযোগ পেলেই তার সাথে সেলফি তুলে ফেলে হাসীব। অপরিচিত- বিশেষ করে মেয়েরা খুব সহজে সেলফি তুলতে রাজি হয় না। রাজি না হলে পাম্প কিংবা গ্যাস মেরে রাজি করানোর চেষ্টা করে সে। কখনো জোর করে না। কিন্তু এই মেয়েটা বলতে না বলতেই সেলফি তুলতে রাজি হয়ে গেলো! তখন বিষয়টা নিয়ে কোনো রকম চিন্তাই করেনি হাসীব। এবার তো করতেই হচ্ছে। বলার সাথে সাথে মেয়েটা সেলফি তোলার জন্য ঘনিষ্ট হয়ে এসে অন্তরঙ্গভাবে পোজ দিলো। হাসীব তার কাছে অজানা অচেনা এক যুবক- তাতে সে কিছু মনেই করলো না। ব্যাপারটা কি হাসীবের জন্য কোনো ধরনের ফাঁদ ছিল? যে ফাঁদে এখন সে আটকা পড়তে যাচ্ছে?
কোন প্রেক্ষিতে মেয়েটার সাথে সেলফি তুলেছিল তা নুমাকে জানালো হাসীব। ওর কথা শুনে এবার হেসে উঠলো নুমা। বলল, ‘কাকে কী বোঝান আপনি? চেনা নাই জানা নাই হঠাৎ সাক্ষাৎ হওয়া একটা মেয়ে এসে এইভাবে সেলফি তুলবে আপনার সাথে?’
‘তখন কোনো রকম চিন্তা করিনি ম্যাম, কিন্তু এখন ব্যাপারটা নিয়ে আমিও খুব কনফিউশনে আছি!’
এএসআই সাদিককে ডাকলো নুমা। দ্রুত ওর চেম্বারে চলে আসলো সাদিক। পরবর্তী নির্দেশ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। নুমা বলল, ‘এই ভদ্রলোককে নিয়ে গিয়ে লকআপে ভরো।’
লকআপে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে হাসীব কিছু বলতে যাচ্ছিলো। বাম হাতটা তুলে ওকে থামালো নুমা। বলল, ‘আপনার আর যা কিছু বলার আছে, তা আদালতে গিয়ে বলবেন। নিজেকে নির্দোষ মনে করলে, তা জাজের সামনে প্রমাণ করবেন। সাদিক, নিয়ে যাও।’
জবাবে হাসীব বলল, ‘ম্যাম, আমার মোবাইল ফোনটা দিলে ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম- যদি আপনি যোগাযোগ করতে দেন।’
‘যোগাযোগ করার সুযোগ অবশ্যই পাবেন। তবে আপনার মোবাইল ফোন আপাতত আপনাকে দেয়া হবে না। এটা এভিডেন্স হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।’ বলল নুমা, ‘সাদিক, লকআপে নিয়ে আর তোমার ফোন থেকে কল করতে দাও।’
‘ওকে, স্যার।’
হাসীবকে নিয়ে এসে লকআপে ঢুকিয়ে দিলো সাদিক। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে হাসীবকে দিলো। বলল, ‘আপনি পাঁচ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাবেন।’
বন্ধু ঈশানের নম্বর মুখস্থ ছিল হাসীবের। সাদিকের দেয়া মোবাইল ফোনে ঈশানের নম্বর ডায়াল করলো সে। প্রথমবার দ্বিতীয়বার কল রিসিভ করলো না ঈশান। অচেনা নম্বর দেখে সে কল রিসিভ করছে না। শেষে ছোট্ট একটা টেক্সট করলো হাসীব। মুহুর্তেই কল ব্যাক করলো ঈশান। হাসীবের সারা পেয়ে বলল, ‘এটা কার নম্বর, তোর ফোন কোথায়?’
‘বন্ধু, আমি একটা ঝামেলায় আটকা পড়েছি।’ বলল হাসীব, ‘তোকে এখনই একবার আমার কাছে আসতে হবে।’
‘কী ঝামেলায় পড়েছিস?’
‘ফোনে অতো কথা বলা যাবে না। আগে আয় তারপর বলছি।’
‘কোথায় আসবো?’
থানার নাম আর লোকেশন জানালো হাসীব। ঢাকা থেকে আসতে ঈশানের কিছুটা সময় লেগেই গেলো। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। অফিসার-ইন-চার্জ নুমা তখন থানায় নাই। ডিউটি শেষ করে বাসায় চলে গেছে। ডিউটি অফিসারের সাথে কথা বলে বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলো ঈশান। ঘটনা অঘটনের সমস্ত বিবরণ শুনলো। শেষে বলল, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, মেয়েদের প্রতি অতি আগ্রহের কারণে কোথাও না কোথাও ফাঁসবি। আমার কথা সত্যি হলো তো! লুইচ্চা শালা!’
‘এখন চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেয়া বন্ধ করে, কী করা যায় সেটার বুদ্ধি দে।’
‘করার এখন একটাই কাজ আছে- নিজেকে তোর নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে।’
‘কিন্তু ভেতরে আটকে থেকে প্রমাণ করবো কীভাবে, আমাকে তো গ্রেফতার করে নিয়েছে। এফআইআরও হয়ে গেছে।’ বলল হাসীব, ‘তোর জানাশোনা কোনো উকিল থাকলে তার সাথে যোগাযোগ কর। যেকোনো ভাবে আমাকে জামিন করাক। তারপরের বাকি কাজ পরে দেখা যাবে।’
‘উকিলের ব্যাপারে চিন্তা করিস না, তোর জন্য একটা উকিল যোগাড় করতে পারবো না তাহলে আর বন্ধু হলাম কেন?’ বলল ঈশান, ‘সুন্দরী এক ব্যারিস্টার আছে- আমার দূর সম্পর্কের কাজিন। চলবে?’
‘ভাইরে ভাই, সুন্দরীদের চক্করে আর পড়তে চাই না!’ বলল হাসীব, ‘পুরুষ কাউকে পেলি না?’
‘আমার কাজিনের দিক থেকে কোনো সমস্যা নাই। সে তোর মতো লুচ্চা না।’ বলল ঈশান, ‘তুই নিজের দিক থেকে ঠিক থাকিস তাহলেই হবে। আমি গেলাম, রাতেই কাজিনের সাথে বিস্তারিত আলাপ করবো।’
ঈশান চলে গেলো। স্বাভাবিকভাবেই সারারাত লকআপেই কাটিয়ে দিতে হলো হাসীবকে। ঘুম হলো না। পরিবেশ ঘুমানোর মতো মনেই হলো না ওর কাছে। কিছুটা ক্লান্তি লাগলে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে পুরো চিত্রটা আরেকবার চিন্তা করতে লাগলো সে- মেয়েটা হাইওয়ের ঠিক ঐ জায়গাতেই কীভাবে আসলো? ওখানে কোনো যাত্রী ছাউনি নাই। বাসস্টপেজও নয়। ঠিক করে হাসীবকেই থামালো সে। গাড়িতে উঠার পর সেলফি তুলতে চাইলে অন্তরঙ্গ হয়ে আসলো। কেন? মেয়েটা কি তাহলে হাসীবকে আগে থেকেই চিনতো? কোনো কারণে হাসীবকে কি সে কোনো ভাবে ফাঁসাতে চাইছিল? কিংবা মেয়েটাকে কাজে লাগিয়ে কি অন্য কেউ ফাঁসাতে চাইছিল হাসীবকে? কে ওকে এভাবে ফাঁসাতে চাইবে?
অনেক ভাবে বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে চিন্তা করলো হাসীব। ওকে ফাঁসিয়ে লাভ হবে তেমন কোনো শত্রু সে খুঁজে পেলো না। ফেঁসে তো গেছেই সে। নিজেকে এখন নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। সেইজন্য মেয়েটার পরিচয় বের করতে হবে। তারও আগে দরকার হাসীবের জামিন। (চতুর্থ পর্বে চলমান)।