সহযাত্রীনী | থ্রিলার ফিকশন | ষষ্ঠ পর্ব
২৪ জুন ২০২৪
Naoroz Bipul
আলিয়া রায়হানার গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো ঈশান আর হাসীব। ঈশান গিয়ে গাড়ির দরজায় হাত দিয়েছে তখন পিবিআইয়ের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। হাসীবের গাড়ির থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজের মতো দূরে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা। ড্রাইভিং সিটের সিট থেকে নেমে আসলো তদন্ত টিমের লিডার ধরনের সেই অফিসার। ভদ্রলোক বয়সে ঈশান আর হাসীবের চেয়ে কিছুটা সিনিয়র। গায়ের রঙ অনেকটা কালো হলেও অফিসার দেখতেও অনেক সুদর্শন। লম্বাচওড়া সুঠাম শারীরিক গঠন। জিন্সের সাথে গাঢ় খয়েরী রঙের টি-শার্ট খুব মানিয়েছে ভদ্রলোককে।
অফিসার নিজেই হাসীবের দিকে এগিয়ে আসলো। ওর দিকে হাত বাড়ালো। বলল, ‘এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ আব্দুল গফুর- ফ্রম পিবিআই।’
অর্থাৎ হাসীবের সম্পর্কে সবকিছুই জানে এসিপি আব্দুল গফুর। কেসের ফাইলে তো হাসীব আর আলিয়ার সেলফি আছেই- ফলে আব্দুল গফুর ওকে দেখেই চিনে ফেলেছে। তার বাড়ানো হাতের সাথে হাত মেলালো হাসীব। বলল, ‘আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আমি খুবই আনন্দিত স্যার।’ ঈশানকে দেখালো সে। বলল, ‘আমার বন্ধু ঈশান।’
একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই মুখে সৌজন্যমূলক হাসি ফুটিয়ে তুললো। হাসীবের দিকে ফিরলো আব্দুল গফুর। বলল, ‘হাসীব সাহেব, আপনি তো দেখছি সব জায়গাতে পিবিআইয়ের চেয়েও একধাপ এগিয়ে আছেন!’
‘এগিয়ে থাকা বলবো না স্যার।’ বলল হাসীব, ‘দূর্ভাগ্যজনকভাবে খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছি। আমি আসলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আমার ডিফেন্স লইয়ারকে সহযোগিতা করছি।’
‘নিজেকে নির্দোষ মনে করলে আপনার নিজেকেই কেন এতো কষ্ট করতে হবে?’ বলল আব্দুল গফুর, ‘পিবিআইয়ের উপর বিশ্বাস নেই আপনার?’
‘বিষয়টা স্যার আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখছি না।’ বলল হাসীব, ‘আপনি তো স্যার রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে প্রসিকিউশনকেই সহযোগিতা করবেন। মামলাটা তো স্যার রাষ্ট্র আর আমার মধ্যে। সুতরাং আপনার তদন্ত রিপোর্ট স্বাভাবিকভাবেই আমার বিপক্ষেই যাবে।’
‘আপনার ধারনা সম্পূর্ণ ভুল হাসীব সাহেব।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘কোনো পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে নয়, পিবিআই সব সময় সত্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। সেই সত্য আপনার বিপক্ষেও যেতে পারে, আবার আপনার পক্ষেও কাজ করতে পারে। এখানে এসে কোনো তথ্য কি পেয়েছেন?’
‘যা জানতে পারলাম স্যার- দুই সপ্তাহের ছুটির কথা আলিয়া রায়হানার বাড়িতে কেউ জানে না। বাড়িতে এসে পরের দিনই সে চলে গেছে।’ বলল হাসীব, ‘ওর মারা যাওয়ার কথা বাড়িতে কেউ এখনো জানে না।’
‘আমি এসেছি, এবার জানবে।’ বলল আব্দুল গফুর, ‘অজ্ঞাত পরিচয়ের ডেডবডি হিসেবে আর কতো দিন হিমাগারে ফেলে রাখবো। পরিচয় পাওয়া গেছে এখন ডেডবডি হস্তান্তর তো করতে হবে। আপনি আপনার নম্বরটা আমার টিম মেম্বারের কাছে দিয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আপনাকে আমি পিবিআই হেড কোয়ার্টারে ডাকবো। সোনালী…’
আব্দুল গফুরের ডান পাশ থেকে সাড়া দিলো এসআই সোনালী, ‘স্যার…’
‘হাসীব সাহেবের নম্বরটা নিয়ে নাও।’
আব্দুল গফুর বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। সোনালী ছাড়া টিমের অন্যান্য সদস্যরা সবাই টিম লিডারের পিছুপিছু চলে গেলো। হাসীবের নম্বর নিয়ে সোনালীও প্রায় প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
গাড়িতে উঠে খুব ঈশানকে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলল হাসীব। আলীয়া রায়াহানার হত্যাকাণ্ডের খবরটা অফিসারের কাছ থেকে তার বাবা-মা শোনার পর, হাসীব স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে ভিলেন হয়ে যাবে। সেই সময় যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আব্দুল গফুরও পুরো ফোর্স নিয়ে আসেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেয়া তার জন্যও কঠিন হয়ে যেতে পারে। সুতরাং এখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়াই ভালো।
গ্রামের রাস্তা থেকে গাড়ি হাইওয়েতে তুলে নিয়ে আসলো ঈশান। মোবাইল ফোন হাতেই ছিল হাসীবের। কল আসলো। ডিসপ্লে’র দিকে তাকিয়ে দেখলো, ব্যারিস্টার নিম্নি সূবর্না কল করেছে। কল রিসিভ করলো হাসীব। বলল, ‘ম্যাম…’
অপর প্রান্ত থেকে নিম্নি সূবর্ণা জানতে চাইলো, ‘হাসীব সাহেব, আপনি কোথায় আছেন?’
‘আমি আলিয়া রায়হানার গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম ম্যাম।’
অজ্ঞাত পরিচয়ের সেই মেয়েটার পরিচয় বের করা সম্ভব হয়েছে তা নিম্নি সূবর্ণা জানে। টাইম-টু-টাইম নিজের ডিফেন্স লইয়ারকে সবকিছু জানিয়েছে হাসীব। এখানে আসার আগেও সে নিম্নি সূবর্ণার মেসেঞ্জারে টেক্সট করেছে।
নিম্নি সূবর্ণা আবার জানতে চাইলো, ‘কোনো তথ্য পেয়েছেন?’
তথ্য কী কী পেয়েছে তা নিম্নিকে জানালো হাসীব। শুনে নিয়ে নিম্নি বলল, ‘হাসীব সাহেব, আপনি তো নতুন আরেকটা ঝামেলা বাধিয়ে দিয়েছেন।’
‘নতুন আবার কী ঝামেলা বাধালাম ম্যাম, আমার আর নতুন কোনো বউ বের হয়েছে?’
‘না, নতুন বউ নয়।’ বলল নিম্নি, ‘আপনার পুরনো অলিখিত বউই যে আড়াই মাসের প্রেগনেন্ট ছিল, তা তো আপনি আমাকে বলেননি।’
‘ম্যাম, আপনিও….’
নিম্নি সূবর্ণার হাসি শুনতে পেলো হাসীব। হাসতে হাসতেই সে বলল, ‘পোস্ট মার্টেমের দ্বিতীয় একটা রিপোর্ট এসেছে আমার হাতে। রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি আলিয়া আড়াই মাসের প্রেগনেন্ট ছিল। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকে ডা. নীলিমা আপনাকে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন।’
‘আমার সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি কী করবেন?’
‘টেস্টের জন্য উনি আপনার ডিএনএ স্যাম্পল নিবেন।’
‘কী বলছেন ম্যাম, আমার ডিএনএ স্যাম্পল!’
‘আলিয়ার ভ্রুণের ডিএনএ টেস্ট করেছেন উনি।’ বলল নিম্নি সূবর্ণা, ‘আপনার ডিএনএ ভ্রুণের ডিএনএ’র সাথে ম্যাচ করে কি না, উনি তা টেস্ট করে দেখবেন।’
‘কী সাংঘাতিক কথাবার্তা!’ আশ্চর্য্য হয়ে বলল হাসীব, ‘যে মেয়েকে চেনা তো পরে, যাকে আমি কোনো দিন দেখিইনি তার ভ্রূণের সাথে আমার ডিএনএ ম্যাচ করবে কীভাবে?’
‘অতো ভয় পাচ্ছেন কেন?’ বলল নিম্নি সূবর্ণা, ‘টেস্টটা করালে কিন্তু আপনিই সুবিধা পাবেন। আপনার দাবি অনুযায়ী, আলিয়ার ভ্রূণের সাথে স্বাভাবিকভাবেই আপনার ডিএনএ ম্যাচ করবে না। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে এটা হবে আপনার একটা প্লাস পয়েন্ট। সুতরাং যেখানেই থাকেন, ডা. নীলিমার সাথে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন।’
নিম্নি সূবর্ণার সাথে কথা শেষ করলো হাসীব। ঈশানকে সব কথা জানালো। ডিফেন্স লইয়ার আর ডা. নীলিমার কথাকেই সমর্থন জানালো ঈশান। বন্ধুকে নিয়ে বিএসএমএমইউ’র ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে চলে আসলো সে। ডা. নীলিমাকে খুঁজে বের করলো ওরা। হাসীব ভেবেছিল, চশমাপরা বয়স্ক কোনো মহিলা ডাক্তার হবে ডা. নীলিমা। কিন্তু তাকে দেখে পুলকিত হয়ে গেলো হাসীব। ডাক্তারনী ওরই সম বয়সী সুন্দরী এক তরুণী। পরিচয় পেয়ে হাসীবকে ল্যাবের ভেতরে ডেকে নিলো ডা. নীলিমা। ঈশানকে বাহিরে বসিয়ে রাখলো। হাসীবের ডিএনএ স্যাম্পল কালেক্ট করা হলে ওকে ছাড়লো ডা. নীলিমা।
ব্যারিস্টার নিম্নি সূবর্ণা’র কাছ থেকে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট জানতে পারলো হাসীব- আলিয়া রায়হানার ভ্রূণের ডিএনএ’র সাথে ওর ডিএনএ ম্যাচ করেনি। অন্তত একটা অপবাদ থেকে রেহাই পেলো সে। কিন্তু এতেও ওর উপর থেকে অভিযোগ উঠে যায় না। ভ্রূণের দায়-দায়িত্ব ওর ঘাড়ে এসে চাপেনি, কিন্তু আলিয়াকে হত্যার অভিযোগ এখনো ওর মাথায় রয়ে গেছে। আলিয়ার ভ্রুণটায় সম্ভবত ওর মৃত্যুর কারণ। ওকে ভ্রূণটা দিলো কে? যে দিয়েছে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হাসীবের এখন তাকেই খুঁজে বের করতে হবে। (সপ্তম পর্বে চলমান)।