সহযাত্রীনী | থ্রিলার ফিকশন | দশম পর্ব

২৪ জুন ২০২৪

Naoroz Bipul

রাত সাড়ে দশটার পর বাসা থেকে বের হলো ঈশান। হাসীবের বাসা পর্যন্ত সে বাইক চালিয়ে আসলো। প্রায় একশো গজ দূরত্ব রেখে ওর পেছনে পেছনে আসলো আরেকটা বাইক। বাইকের রিয়ারভিউ মিররে পেছনের বাইকটাকে লক্ষ্য করেছে ঈশান। সেই বাইক আরোহী পিবিআইয়ের একজন সোর্স। কয়েক দিন ধরে একই বাইক নিয়ে ফলো করে বেড়াচ্ছে। 
হাসীবের গাড়িতে করে ওরা আবার বের হলো। এবার গাড়ির পেছনে যুক্ত হলো দুইটা বাইক। দুই বন্ধু চলে আসলো ওদের আরেক বন্ধু গিয়াসউদ্দিনের বাসায়। সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছিল গিয়াসউদ্দিন। ওদের এ্যাপার্টমেন্টের পেছন দিকে একটা ইমার্জেন্সি এক্সিট আছে। সেখানে নিজের বাইক আগে থেকেই রেডি করে রেখেছে সে। বন্ধু গিয়াসউদ্দিনের বাসায় পোশাক পরিবর্তন করলো হাসীব আর ঈশান। ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে বন্ধুর বাইক নিয়ে বের হলো। এবার পেছনে পিবিআইয়ের কোনো সোর্স চোখে পড়লো না। 
মনোহরিণী রাজকন্যার বলে দেয়া সেই ক্লাবের সামনে চলে আসলো। রাস্তার বিপরীতে অন্য একটা রেষ্টরন্টে বসলো। ক্লাবের প্রধান দরজায় নজর রাখলো। অনেকেই আসছে। দুইজন সিকিউরিটি গার্ড এসে তাদেরকে আটকাচ্ছে। কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। কথাবার্তা শেষে আগতদেরকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে।
ঈশান আর হাসীবকেও সেই দুই সিকিউরিটি গার্ড আটকালো। একজন বলল, ‘আপনাদেরকে স্যার খুব সম্ভবত আজই প্রথম দেখছি।’
জবাবে ঈশান বলল, ‘হ্যাঁ, এই ক্লাবে আমরা আজই প্রথম এসেছি।’
‘নিশ্চয় খুঁজছেন কাউকে?’
এবার জবাবে হাসীব বলল, ‘ম্যাডাম ফুলির বাড়ি কোথায়?’
একে অপরের দিকে তাকালো দুই সিকিউরিটি গার্ড। নিজেদের মধ্যে কোনো কিছুর সংকেত সূচক মাথা নাড়লো। হাসীবের দিকে তাকালো। ওদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। একজন বলল, ‘কোথায় আর হবে স্যার, এটাই তো ম্যাডাম ফুলির বাড়ি। ভেতরে চলে আসুন।’
ভেতরের পরিবেশ আর দৃশ্যপট দেখে ওরা আশ্চর্যান্বিত, বাকহত কিংবা অভিভূত- কিছুই হলো না। এমন সব জায়গায় আসার পূর্ব অভিজ্ঞতা অনেক আছে। রেষ্টরন্টের আদলে পেতে রাখা হয়েছে চেয়ার টেবিল। নজরকাড়া সেই চেয়ার টেবিলে নজরকাড়া সব নারী-পুরুষ। লুকানো সাউণ্ড সিষ্টেম থেকে ভেসে আসছে ল্যাটিন বিটের মিউজিক। ডান্স ফ্লোরে সেই মিউজিকের সাথে চলছে মদ্যপ নারী-পুরুষের যুগল ডান্স। ওয়েটাররা সবাই স্বল্প পোশাকের নারী।
একেবারে ভেতরের দিকে একটা হাসীবকে নিয়ে এসে বসলো ঈশান। ওদের সেবায় এগিয়ে আসলো একজন নারী ওয়েটার। বলল, ‘কীভাবে আপনাদেরকে আনন্দিত করতে পারি স্যার?’
ওয়েটারের আপাদমস্তক একবার দেখলো হাসীব। এটা মনোহরিণী রাজকন্যা কি না তা বোঝার চেষ্টা করলো। সাইজ শেপ কোনো কিছুতেই মনোহরিণী রাজকন্যা বলে মনে হলো না। ওর প্রশ্নের জবাবে হাসীব বলল, ‘লেমন জুস।’
‘আমাদের এখানে সেটারও ব্যবস্থা আছে স্যার।’ বলল ওয়েটার, ‘প্লিজ অপেক্ষা করুন।’
ওয়েটার চলে গেলো। ফিরে আসলো হাতের তালুতে করে ট্রে নিয়ে। ট্রের উপরে লেমন জুসের দুইটা গ্লাস। দুজনের সামনে দুইটা গ্লাস রাখলো ওয়েটার। গ্লাস নিয়ে চুমুক দিতে গিয়ে হাসীব লক্ষ্য করলো- একেবারে উপরে ইংরেজিতে ছোট্ট করে লেখা আছে- ফাইভ জিরো ওয়ান। গ্লাস ঘুরিয়ে নিয়ে চুমুক দিলো হাসীব। বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোর গ্লাসেও কি পাঁচশো এক লেখা আছে?’
‘না তো!’ জবাবে বলল ঈশান, ‘তোর গ্লাসে লেখা আছে?’
জবাব না দিয়ে লেখাটা বন্ধুকে দেখালো হাসীব। দেখে নিয়ে ঈশান বলল, ‘অর্থাৎ আমাদের জন্য এটা মনোহরিণী রাজকন্যার সংকেত। পাঁচশো এক নম্বর রুমে যেতে হবে আমাদেরকে।’
ইশারায় ওয়েটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো হাসীব। ওদের বিল নিয়ে আসতে বলল। বিল নিয়ে আসলো সে। বিল পরিশোধ করলো হাসীব। বলল, ‘লিফটটা কোনদিকে?’
দুইহাতে একদিকে ইঙ্গিত করলো ওয়েটার মেয়েটা। বলল, ‘ওয়াশরুমের পাশে।’
লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালো ঈশান আর হাসীব। লিফট উপর থেকে নিচের দিকে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লিফট এসে থামলো। দরজা খুলে গেলো। ভেতরে একজোড়া কপোত-কপোতী। নেশায় বুঁদ হয়ে নিজের উপর ভারসাম্য রাখতে পারছে না মেয়েটা। ছেলেটা ওকে জাপটে ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। কোনো রকমে মেয়েটাকে টেনেটুনে নিয়ে বের হয়ে গেলো ছেলেটা। 
লিফটের ভেতরে ঢুকে ফোর্থ ফ্লোরের বাটন চাপলো ঈশান। পাঁচ তলায় এসে লিফট থামলো। লিফট থেকে বের হয়ে ওরা সামনে লম্বা একটা করিডোর দেখতে পেলো। পাঁচশো এক নম্বর রুমটা ওরা একেবারে শেষে খুঁজে পেলো। দরজায় নক করলো হাসীব। প্রথম বার নক করতেই ভেতর থেকে একটা নারীকন্ঠ বলল, ‘দরজা খোলা আছে, চলে এসো।’
ঘরের ভেতরে এসে ওরা দেখলো, ঘরের অর্ধেকটাতে আলো আর অর্ধেকটাতে অন্ধকার। অন্ধকার অংশে একটা সোফায় বসে আছে বোরখা পরিহিত একটা নারী অবয়ব। আলো গিয়ে মেয়েটার উপরে এমনভাবে পড়েছে- তাতে তার কোমর থেকে নিম্নাংশ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মেয়েটার সুন্দর হাত। হাতে গ্লাস। গ্লাসে রেড ওয়াইন। ওর হাতে পাথর বসানো আংটি- আলো পড়ে আংটির পাথরটা মাঝে মাঝেই ঝলমলিয়ে উঠছে।
‘আমি তোমাদের মনোহরিণী রাজকন্যা।’ বলল মেয়েটা। হাতের গ্লাসে একবার চুমুক দিলো। অন্ধকার অংশে বসে থাকায় মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সে বলল, ‘রেড ওয়াইন- নিয়ম মেনে পান করলে স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো। চলে নাকি তোমাদের? চললে, তোমাদের সামনের টি-টেবিলে রাখা আছে। আমি উঠে আসতে পারছি না। কষ্ট করে নিজেরা একটু সার্ভ করে নাও।’
টি-টেবিলের উপর ওয়াইনের পুরো একটা বোতল, দুইটা গ্লাস আর বাটিতে রাখা আইস কিউব দেখতে পেলো ওরা। ওদিকেই এগুতে যাচ্ছিলো ঈশান। ওর হাত ধরে থামালো হাসীব। ফিসফিস করে বলল, ‘বি কেয়ার। অন্য কোনো ব্যাপার স্যাপার থাকতে পারে।’
‘রাইট।’
‘অন্ধকারে কেন বসে আছো?’ জিজ্ঞেস করলো হাসীব, ‘তা-ও আবার বোরখা পরে?’
‘পর্দায় থাকতে দাও বয়েস।’ বলল মনোহরিণী রাজকন্যা, ‘নারীর পর্দা হরনের চেষ্টা করো না। আলিয়ার হত্যাকাণ্ড পিবিআই তদন্ত করছে। তোমরা কেন ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছো?’
‘আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছি।’
‘তুমি তো নির্দোষই। হত্যাকারীর আসলে তোমাকে ফাঁসানোর কোনো চিন্তাই ছিল না।’ বলল মনোহরিণী রাজকন্যা, ‘দূর্ভাগ্যজনকভাবে তুমি ঘটনাচক্রে ফেঁসে গেছো। সুতরাং, এইসব নিয়ে তোমরা ঘাঁটাঘাঁটি করো না। ট্র‍্যাক থেকে সরে যাও।’
‘কিন্তু হত্যার অভিযোগ ঝুলে আছে আমার মাথার উপরে।’ বলল হাসীব, ‘হত্যাকারীকে সামনে না নিয়ে আসলে- মহামান্য আদালত আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেবেন। আলিয়াকে হত্যা করার মূল কারণ কি?’
‘এ্যাফেয়ার।’
‘কার সাথে ওর এ্যাফেয়ার ছিল?’
‘ওকে যে ভ্রুণ দিয়েছে তার সাথে।’
‘কথা অতো না পেঁচিয়ে সরাসরি বলো।’
‘আমি জানি না, আলিয়া তার অতো গোপন কথা আমাকে জানায়নি।’
‘জানো নাকি বলবে না?’
‘তুমি যে নির্দোষ- শুধু সেটা বলার জন্যই তোমাকে আমি এখানে ডেকেছি।’ বলল মনোহরিণী রাজকন্যা, ‘বলা হয়ে গেছে, এখন চলে যাও।’
অর্থাৎ এই মেয়ে সবকিছুই জানে। জানে কিন্তু সে বলতে চায় না। এই মেয়ের পরিচয় বের করতে পারলেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। কে এই মেয়ে? মনোহরিণী রাজকন্যা’র নামের আড়ালে সে কেন লুকিয়ে আছে? এই মুহুর্তে ওকে অন্ধকার থেকে আলোলতে টেনে নিয়ে আসার চিন্তা করলে, সেটা হবে বোকামি। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই ঈশান আর হাসীবকে এখানে ডেকেছে। ওর সর্বশেষ কথার ধারাবাহিকতায় হাসীব বলল, ‘আলিয়ার এ্যাফেয়ার কার সাথে ছিল সেটা অন্তত বলো।’
‘এ্যাফেয়ারের ব্যাপারে আলিয়া আমাকে কখনোই কিছু বলেনি।’ বলল মনোহরিণী রাজকন্যা, ‘ওর অফিসে খোঁজ করে দেখতে পারো। হতে পারে ওর কোনো উর্ধতন কর্তৃপক্ষ, অথবা কোনো সহকর্মী।’
‘আলিয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ জানতে চাইলো ঈশান, ‘তুমিও কি আলিয়ার অফিসেই জব করো?’
‘আলিয়া আমার ফ্রেন্ড ছিল।’ বলল মনোহরিণী রাজকন্যা, ‘তোমাদের আর কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দেবো না। যা জানাতে তোমাদেরকে ডেকে ছিলাম তা জানিয়েছি। এখন তোমরা যেতে পারো।’
‘তোমার কন্ঠ আমার কাছে খুব পরিচিত লাগে।’ বলল হাসীব, ‘মনে হয়, আগেও কোথাও খুব কাছে থেকে আমি তোমার সাথে কথা বলেছি।’
এবার মনোহরিণী রাজকন্যা’র হাসি শুনতে পেলো ওরা। হাসি থামিয়ে সে বলল, ‘সেটা কোনো সমস্যা না। নারীর কন্ঠ পুরুষের কাছে সব সময় পরিচিতই মনে হয়।’
নারীর চিরাচরিত হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা। ওর সাথে কথা বলে আর কোনো লাভ নাই। হাসীব যে নির্দোষ তা আপাতত নিশ্চিত ওরা। কিন্তু সেটা নিজেদের মধ্যে থেকে গেলে হবে না। নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে আদালতে। কীভাবে নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে তার কোনো সোর্সই এখন পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। একটা ব্যাপার অন্তত জানা গেলো- ঘটনাচক্রে ফেঁসে গেছে হাসীব। আলিয়াকে হত্যার মোটিভ সম্পর্কে অনুমান করা যাচ্ছে- বয়ফ্রেন্ডের সাথে সম্পর্কের কারণে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে আলিয়া। সেটা নিয়েই বয়ফ্রেন্ডের সাথে হয়তো ঝামেলা তৈরি হয় আলিয়ার। ওর বয়ফ্রেন্ড এমন একজন কেউ- আলিয়ার প্রেগন্যান্সির কথা প্রকাশ হলে যে সমস্যার সম্মুখীন হতো। সমস্যা এড়াতে ভ্রুণসহ আলিয়াকে মেরে ফেলতে হয়েছে? কে সেই বয়ফ্রেন্ড?
মনোহরিণী রাজকন্যা’র দেয়া তথ্যানুযায়ী- আলিয়ায় বয়ফ্রেন্ড হতে পারে তার কোনো উর্ধতন কর্তৃপক্ষ, কিংবা ওর সহকর্মী। এখন পর্যন্ত আলিয়ার দুইজন উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে হাসীবের। প্রথম জন এমডি তাহের আজিজ। দ্বিতীয় জন সিইও ইয়াসিন যাহের। অন্য আর কোনো উর্ধতন কর্তৃপক্ষ অথবা সহকর্মীর সাথে পরিচয় নেই ওদের। সব এমপ্লয়ির সাথে সমন্বয় করে কাজ করতো আলিয়া। কার সাথে ওর এ্যাফেয়ার হয়েছিল সেটা এখন কীভাবে বের করা যায়? কার সাথে এ্যাফেয়ার ছিল সেই কথা এখন কেউই স্বীকার করবে না। প্রত্যেক এমপ্লয়ির সাথে কথা বলতে যাওয়ায়ও কঠিন। ওদের পক্ষে প্রত্যেকের পিছু ধাওয়া করতে যাওয়া তো আরও কঠিন। ডিফেন্স লইয়ার ব্যারিস্টার নিম্নি সূবর্ণার সাথে কথা বলা প্রয়োজন হাসীবের। (একাদশ পর্বে চলমান)।