সহযাত্রীনী | থ্রিলার ফিকশন | দ্বাদশ পর্ব
২৪ জুন ২০২৪
Naoroz Bipul
ডিফেন্স লইয়ার ব্যারিস্টার নিম্নি সূবর্ণার কল আসলো হাসীবের মোবাইল ফোনে। বুকের ভেতরে যেন নেচে উঠলো হাসীবের। মেয়েটাকে সত্যিই ওর খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর সাথে কোনো রকম ফ্লার্ট করতে গেলো না। কল রিসিভ করলো সে। বলল, ‘বলুন ম্যাম।’
অপর প্রান্ত থেকে সুন্দরী লইয়ার নিম্নি সূবর্ণা বলল, ‘হাসীব সাহেব, ডিএনএ ম্যাচ করেছে!’
‘সেটা আমার মনের ভেতর থেকে কেউ যেন বলে দিচ্ছিলো ম্যাম।’ বলল হাসীব, ‘আব্দুল গফুর কি এই বিষয়ে কিছু জানে?’
‘এখনো নয়। আপনি একবার তার সাথে কথা বলেন। প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে এসে আমাকে দেন।’ বলল নিম্নি সূবর্ণা, ‘আব্দুল গফুরকে পরে আমি সব জানাবো।’
‘ঠিক আছে ম্যাম, রিপোর্টটা আমাকে হোয়াটসএ্যাপে দিয়ে দেন।’ বলল হাসীব, ‘আম আজই কথা বলার ব্যবস্থা করছি।’
‘এখনি দিয়ে দিচ্ছি। আর কিলারের কোনো রকম তথ্য কি পেয়েছেন?’
‘পাওয়া যায়নি এখনো। আমাদের সোর্স সাতদিন সময় নিয়েছে।’
‘ঠিক আছে, তাহলে সেই ফাঁকে আপনি এই কাজটা সেরে ফেলেন।’
‘ওকে ম্যাম।’
নিম্নি সূবর্ণার সাথে কথা শেষ করলো হাসীব। বন্ধু ঈশান আর গিয়াসউদ্দিনকে কল করলো। ওরা আসলে একসাথে আবার বের হলো। রাস্তায়া চলতি পথে ক্রিস্টল আই গ্রুপের সিইও ইয়াসিন যাহেরের সাথে যোগাযোগ করলো। বোর্ড মিটিং না হলেও আজ নাকি ইয়াসিন যাহের অফিসেই আছে। ওর অফিসে পৌঁছে সরাসরি ওর চেম্বারেই আসলো হাসীব আর ঈশান। চেম্বারে যাওয়ার পথে হাসীব লক্ষ্য করলো, আজও ওদের দিকে তাকিয়ে আছে মিথিলা। ওর দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় হাসীব জানতে চাইলো- কী?
মনে মনে ইডিয়ট বলে নিজের কাজে মনযোগ দিলো মিথিলা।
চেম্বারে ঢুকলে ঈশান আর হাসীবকে বসার আহবান করলো ইয়াসিন যাহের। পিএস রুমলী তখন চেম্বারেই ছিল। ইয়াসিন যাহের বলল, ‘কী হেল্প করতে পারি বলুন।’
‘অত্যন্ত গোপনীয় একটা বিষয়ে আলাপ করতে এসেছিলাম স্যার।’ বলল হাসীব। রুমলীকে দেখালো। বলল, ‘ম্যামকে যদি বাহিরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলতেন…’
রুমলীর দিকে তাকালো ইয়াসিন যাহের। বসের ঈশারা পেয়ে সে চেম্বার থেকে বের হয়ে গেলো। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে হাসীবের দিকে তাকালো ইয়াসিন যাহের। মোবাইল ফোন বের করে হোয়াটসএপ ওপেন করলো হাসীব। ইয়াসিন যাহেরের সামনে মোবাইল ফোন ধরলো। বলল, ‘স্যার, এটা আপনার ডিএনএ রিপোর্ট। আলিয়ার ভ্রূণের ডিএনএ’র সাথে আপনার ডিএনএ ম্যাচ করেছে!’
দুই বন্ধুর দিকে একবার একবার করে তাকালো ইয়াসিন যাহের। ঈশান বলল, ‘কীভাবে কে কখন আপনার ডিএনএ স্যাম্পল কালেক্ট করেছে তা কিন্তু আমরা জানি না স্যার। রিপোর্টটা আমরা লইয়ারের কাছ থেকে পেয়েছি।’
‘ডিএনএ ম্যাচ করবে তা আমি জানতাম।’ বলল ইয়াসিন যাহের, ‘আলিয়ার সাথে আমার গোপন একটা সম্পর্ক ছিল।’
বন্ধুর দিকে একবার তাকালো হাসীব। ইয়াসিন যাহেরের দিকে ফিরে বলল, ‘তাহলে কি স্যার আপনিই…’
‘না।’ হাসীবকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল ইয়াসিন যাহের, ‘আলিয়াকে আমি মারিনি। তখন আমি মালয়েশিয়ায় ছিলাম। ওর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমি সত্যিই কিছু জানি না। অফিসিয়ালি দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে, সবার অলক্ষ্যে আলিয়া আসলে মালয়েশিয়ায় আমার কাছেই যাচ্ছিলো। সেখানে গিয়ে দুজনের আলোচনার মাধ্যমে ওর ভ্রুণের ব্যাপারে একটা ডিসিশনে আসার প্ল্যান ছিল আমাদের।’
‘হতাশ হয়ে গেলাম স্যার!’ বলল হাসীব, ‘ভেবেছিলাম, হত্যাকারীর অপবাদ থেকে এবার রক্ষা পাবো। কিন্তু আপনি তো প্যাঁচ লাগিয়ে দিলেন!’
হাসীবের কথা শুনে ইয়াসিন যাহের হেসে উঠলো। বলল, ‘আলিয়াকে আমি মেরে ফেললে আপনার জন্য সুবিধাই হতো তাই না? কিন্তু, আমি সত্যিই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত না। অন্য কেউ অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ওকে মেরে ফেলতে পারে?’
‘কার কী উদেশ্য থাকতে পারে স্যার?’ জানতে চাইলো, ‘আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?’
‘আপনার মতো করে আমিও চিন্তা করেছি।’ বলল ইয়াসিন যাহের, ‘অফিসের কেউ জড়িত আছে কি না তা নিশ্চিত না। আলিয়ার পারিবারিক কোনো সমস্যার কারণেও ওর হত্যাকাণ্ড হতে পারে।’
‘স্যার, আমার আরেকটা প্রশ্ন করার ছিল।’ বলল হাসীব, ‘যদি কিছু মনে না করেন।’
‘আপনাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আমি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবো।’ বলল ইয়াসিন যাহের, ‘নির্ভয়ে বলেন।’
‘আপনার অফিসের অন্য আর কোনো ফিমেল স্টাফের সাথে কি আপনার গোপন কোনো সম্পর্ক ছিল?’ বলল হাসীব, ‘কিংবা বর্তমানে আছে?’
‘বর্তমানে নেই। এক সময় ছিল।’ বলল ইয়াসিন যাহের, ‘সম্পর্কটাতে অবশ্য অবচেতন ভাবে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।’
‘অবচেতন ভাবে দূরত্বটা কি স্যার আপনার দিক থেকে তৈরি হয়েছে?’
‘বলতে পারেন আমার দিক থেকেই হয়েছে।’ বলল ইয়াসিন যাহের, ‘এবং তা হয়েছে আলিয়ার সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে।’
বিষয়টা এবার পুরোপুরি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে হাসীব। প্রচুর টাকা পয়সাওয়ালা এবং ক্ষমতাধর পুরুষ লোকদের এটাই একটা বড় সমস্যা। তাদের ঘরে থাকে একটা বৈধ বউ, আর ঘরের বাহিরে থাকে অসংখ্য অবৈধ উপপত্নী। আলিয়াও ছিল সেইসব উপপত্নীদেরই একজন। ইয়াসিন যাহেরের ফিমেল স্টাফদের মধ্যে আর কে কে ওর উপপত্নী তা তো স্বাভাবিকভাবেই হাসীবের জানা নাই। আলিয়ার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর, অন্য যে ফিমেল স্টাফের সাথে ইয়াসিন যাহেরের দূরত্ব তৈরি হয়েছে- খুব সম্ভবত সেই ফিমেল স্টাফই আলিয়া হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। কে সেই ফিমেল স্টাফ?
জিজ্ঞেস করলেও ইয়াসিন যাহেরের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না বলেই ধারণা হাসীবের। আবার তাকে বেশি ঘাঁটাতে গেলে বিপদেও পড়তে হতে পারে। রাজনৈতিক ও পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতাধর যুবক ইয়াসিন যাহের। এখন পর্যন্ত ঈশান আর হাসীবের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণই করেছে। কিন্তু ওকে ঘাঁটাতে গেলে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ শত্রুতায় পরিনত হবে না- তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। সুতরাং সে তার স্টাফদের কাকে কাকে ভ্রুণ দিয়ে বেড়াচ্ছে, বেড়াক। তাতে হাসীবের কোনো সমস্যা নাই। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ইয়াসিন যাহেরের সেই উপপত্নীকে পেলেই কাজ হয়ে যাবে হাসীবের। সে বলল, ‘ওকে স্যার, আমরা আমাদের অনুষ্ঠানের ডেট টাইম ভেন্যু ঠিক করে আপনাকে জানাবো।’
‘ঠিক আছে, আমিও প্রস্তুত আছি।’ বলল ইয়াসিন যাহের, ‘আপনার যেতে পারলে খুবই আনন্দ লাগবে আমার।’
ইয়াসিন যাহেরের কাছ থেকে বিদায় নিলো ওরা। তার চেম্বার থেকে বের হলো। আবারো ওরা মিথিলার বাঁকা দৃষ্টিতে আবদ্ধ হলো। মিথিলার সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করলো হাসীব। একইভাবে সে চোখের ইশারা করলো। জিজ্ঞেস করলো- কী?
আগের মতোই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিলো মিথিলা। হাসীব এবার সরাসরি মিথিলার ডেস্কের সামনে গেলো। আস্তে করে দুইবার কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। মিথিলা তাকালো না। বলল, ‘বলেন, শুনতে পাচ্ছি।’
জবাবে হাসীব বলল, ‘ভালো আছেন ম্যাডাম?
‘আলহামদুলিল্লাহ্!’ বলল মিথিলা, ‘কোনো কাজে এসেছিলেন নিশ্চয়?’
‘জি, ছোট্ট একটা কাজে।’ বলল হাসীব, ‘আমরা একটা ওটিটি এ্যাপ লউঞ্চ করবো। সেই উদ্দেশ্যে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানে সিইও স্যারকে প্রধান অতিথি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। কথা হয়েছে। সিইও স্যার রাজিও হয়েছেন। ম্যাডাম, আপনার সেলফোন নম্বরটা যদি দিতেন…’
শুধু চোখ তুলে হাসীবের দিকে তাকালো মিথিলা। বলল, ‘আপনার চীফ গেষ্ট হবেন আমাদের সিইও স্যার, আমার নম্বর দিয়ে আপনি কী করবেন?’
‘এই অফিসে আপনিই শুধু আমার পরিচিত।’ বলল হাসীব, ‘সিইও স্যার দেশের বাহিরে যাচ্ছেন, কখন বিদেশ থেকে আসছেন- সেইসব জানার জন্যই আসলে আমি আপনার কাছে প্রয়োজনে ফোন করবো।’
হাসীবের কথার বিপরীতে আর কোনো কথা বলল না মিথিলা। ডেস্কে রাখা কার্ড হোল্ডার থেকে একটা ভিজিডিং কার্ড নিলো। হাসীবের দিকে বাড়ালো। বলল, ‘এটাতে আমার নম্বর পাবেন।’
‘ধন্যবাদ ম্যাডাম।’ বলল হাসীব। কার্ডটা শার্টের পকেট রাখলো। বলল, ‘বুক পকেটে রেখে দিলাম আপনার কার্ডটা।’
চেহারায় বিরক্তির একটা ছাপ ফুটিয়ে তুললো মিথিলা। মনে মনে, ইডিয়ট বলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিঃশব্দে হেসে ওর সামনে থেকে চলে আসলো হাসীব।
গিয়াসউদ্দিন গাড়িতে বসে আছে। হাসীব আর ঈশান এসে গাড়িতে বসলো। গিয়াসউদ্দিন বলল, ‘দোস্ত, আসমিনা ফোন করেছিল। সে নাকি কন্টাক্ট কিলারের খোঁজ পেয়েছে। একটা ঠিকানাও আমাকে হোয়াটসএ্যাপে টেক্সট করে দিয়েছে। সেই ঠিকানায় এই মূহুর্তে যেতে নিষেধ করেছে।’
জবাবে ঈশান জিজ্ঞেস করলো, ‘নিষেধ কেন করেছে?’
‘আরো চারদিন পর কিলার সেই ঠিকানায় আসবে।’ বলল গিয়াসউদ্দিন, ‘প্রথম দিনই কখন গিয়ে আমরা তাকে ধরতে পারবো তা আসমিনা পরে আমাকে জানাবে। আমাদেরকে সে রেডি থাকতে বলেছে।’
রেডি হয়েই থাকলো ওরা। হাসীব ভাবছে, কন্টাক্ট কিলারের কাছ থেকে নিশ্চয় মূল হত্যাকারীর তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু কন্টাক্ট কিলার ওদেরকে কেন সেই তথ্য জানাবে? জানাতে গেলে তো সে নিজেও ধরা পড়বে। এই অবস্থায় করণীয় কী হতে পারে- তা জানতে ডিফেন্স লইয়ার নিম্নি সূবর্ণার কাছে ফোন করলো হাসীব। ওকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে দিলো নিম্নি সূবর্ণা। (ত্রয়োদশ পর্বে চলমান)।