সহযাত্রীনী | থ্রিলার ফিকশন | ত্রয়োদশ পর্ব
২৪ জুন ২০২৪
Naoroz Bipul
এ্যাপার্টমেন্টের বিপরীত পাশে প্রায় দেড়শো গজ দূরে গাড়ির ভেতর বসে আছে তিন বন্ধু গিয়াসউদ্দিন, ঈশান আর হাসীব। আসমিনার এক ইনফর্মার এ্যাপার্টমেন্টের গেটের আশেপাশেই কোথাও অপেক্ষা করছে। আজ এই এ্যাপার্টমেন্টে আলিয়ার হত্যাকারী সেই কন্টাক্ট কিলারের আসার কথা। এ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সাথে সাথেই আসমিনার ইনফর্মার মেসেজ পাঠাবে গিয়াসউদ্দিনের ফোনে।
সাড়ে বারোটার পরে মেসেজ পেলো গিয়াসউদ্দিন। দুই বন্ধুকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে, সে আগেই চলে আসলো ইনফর্মারের কাছে। কন্টাক্ট কিলারের নাম, ছবিসহ এ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা জেনে নিলো। বন্ধুদেরকে ডাকলো। ওরা আসার পর ভেতরে যেতে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের বাধা পেলো। সিকিউরিটি গার্ড জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনেরা স্যার কোন ফেলাটে যাইবেন?’
সামনে এগিয়ে গেলো গিয়াসউদ্দিন। বলল, ‘গিয়াসউদ্দিন আঙ্কেলের বাসায়।’
ভ্রু-কুঁচকে ওর দিকে তাকালো হাসীব আর ঈশান। বুঝতে পারলো, গিয়াসউদ্দিন ভেতরে ঢোকার জন্য কোনো একটা টেকনিক খাটাচ্ছে। ওরা চুপচাপ থাকলো।
ওদিকে সিকিউরিটি গার্ড আবার বলল, ‘কিন্তু স্যার, গিয়াসউদ্দিন স্যার তো এখন বাসায় নাই।’
সিকিউরিটি গার্ডের কথা শুনে এবার দুই বন্ধুর দিকে তাকালো গিয়াসউদ্দিন। বলল, ‘কোথায় গেছে?’
‘অফিসে গেছে।’
‘বাসায় আন্টি তো আছে?’
‘হ, ম্যাডাম আর ম্যাডামের বড় মাইয়া রইছে।’
‘ম্যাডামের বড় মাইয়ার হাজবেন্ডরে তুমি কখনো দেখছো?’
‘দেহি নাইক্কা স্যার।’
‘দেখোনি কেন?’
‘হেই তো ইহানে আহেই না। কেমতে দেকমু?’
‘আসে না কেন?’
‘কেমতে আইবো, স্যারের মাইয়ার লগে জামাইয়ের সম্পর্ক তো ভালো না।’ বলল গিয়াসউদ্দিন, ‘মাইয়াও যায় না, হের জামাইয়েও আসে না।’
‘আজ চলে এসেছে- সম্পর্ক ঠিকঠাক করে বউরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাসীবকে দেখালো গিয়াসউদ্দিন। বলল, ‘এইটা হলো তোমার স্যারের মেয়ের হাজবেন্ড। আমরা দুইজন তোমাদের এই দুলাভাইয়ের কাজিন। রাগ ভাঙ্গিয়ে আমরা আমাদের ভাবিকে নিয়ে যেতে এসেছি। ঠিক করেছি না?’
‘অবশ্যই ঠিক করছেন স্যার। বিয়াইত্তা বেডিগো বাপের বাইতে বেশিদিন থাইকতে হয় না।’ বলল সিকিউরিটি গার্ড, ‘আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শীরা বিভিন্ন কতা কয়। যান গা স্যার, আপনেগো ভাবিরে বুঝাইয়া শুনাইয়া লই যান।’
দুই বন্ধুকে ভেতরে আসতে দুই হাতে ইশারা করলো গিয়াসউদ্দিন। নিজে ভেতরের দিকে পা বাড়ালো। লিফটের দিকে যেতে যেতে হাসীব বলল, ‘তোরা আর কত মেয়ের হাজবেন্ড বানাবি আমাকে বল দেখি?’
‘না বানাইলে সিকিউরিটি গার্ড ভেতরে ঢুকতে দিতো?’ বলল গিয়াসউদ্দিন, ‘এমন চাপা দিয়েছি তাতে সে ভিজিটর রেজিষ্টারে আমাদের ইনফরমেশনও লেখেনি।’
জবাবে ঈশান বলল, ‘কিন্তু বন্ধু, এখানে যে গিয়াসউদ্দিন নামে অন্য কেউ থাকে তা কীভাবে জানলি?’
‘জানতাম না। ফাঁকতালে মেরে দিয়েছি, লেগে গেছে।’
‘যদি না লাগতো তখন?’
‘তখন কী হতো সেটা নিয়ে এখন আর চিন্তা করার কোনো দরকার নাই।’ বলল গিয়াসউদ্দিন, ‘আমরা আমাদের কাজে ফোকাস করি চল।’
লিফটে উঠলো ওরা। লিফট ওদেরকে নিয়ে এসে এগারো তলায় নামিয়ে দিলো। পুরো ফ্লোর ভালো করে দেখে নিলো ওরা। পাশাপাশি সামনা-সামনি চারটি ফ্ল্যাট। ইনফর্মারের বলা ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল বাজালো ঈশান। কয়েক মিনিট যাবৎ কেউ দরজা খুললো না। আবার কলিং বেল বাজাতে যাবে, সেই সময় দরজা খুলে গেলো। দরজায় দাঁড়িয়ে সুদর্শন এক যুবক। ওদেরই সম বয়সী। ওদের তিনজনকেই একবার করে দেখে নিলো যুবক। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে হাসীব জানতে চাইলো, ‘আপনি কি আহমেদ বোরহান?’
‘জি। আপনারা?’
‘আমরা আলিয়া রায়হানার কাছে এসেছিলাম।’ বলল ঈশান, ‘ম্যাডাম কি বাসায় আছেন?’
‘নাই।’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘আপনারা খুব সম্ভবত ভুল ঠিকানায় এসেছেন। এখানে ঐ নামে কাউকে পাবেন না।’
‘এক মিনিট।’ বলল হাসীব। মোবাইল ফোন বের করলো। ফটো এ্যালবাম থেকে আলিয়ার সাথে তোলা সেলফিটা বের করলো। আহমেদ বোরহানের দিকে ধরলো। বলল, ‘এই মেয়েটাকে তো অবশ্যই চিনেন?’
‘স্যরি, এই মেয়েকে আমি চিনিনা।’
দরজা চট করে বন্ধ করে দিতে লাগলো আহমেদ বোরহান। দুই বন্ধুকে দুইপাশে সরিয়ে দিয়ে সামনে আসলো গিয়াসউদ্দিন। দরজা বন্ধ করার আগেই সে দরজায় সজোরে একটা লাথি মারলো। দরজার ধাক্কায় ভারসাম্য হারিয়ে পেছন দিকে গিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়লো আহমেদ বোরহান। দ্রুত গতিতে ভেতরে আসলো গিয়াসউদ্দিন। কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে- ঈশান আর হাসীবকে হতভম্ব করে দিয়ে একটা পিস্তল বের করলো গিয়াসউদ্দিন। চেপে ধরলো আহমেদ বোরহানের মাথায়। বলল, ‘কোনো রকম চালাকি করলে এখনই তোর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবো।’
‘রিল্যাক্স বন্ধু, রিল্যাক্স।’ গিয়াসউদ্দিনকে ক্ষান্ত করলো ঈশান। আহমেদ বোরহানের দিকে তাকালো। বলল, ‘বুঝতেই পারছেন, আপনার সম্পর্কে আমরা সবকিছু জেনেশুনেই এসেছি।’
‘কে রে ভাই আপনারা?’ ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বলল আহমেদ বোরহান, ‘পুলিশ?’
‘আমরা পুলিশ না।’ বলল হাসীব, ‘আসেন, বসে কথা বলি।’
আহমেদ বোরহানের দিকে পিস্তল ধরেই থাকলো গিয়াসউদ্দিন। আহমেদ বোরহান একজন কন্টাক্ট কিলার। ওকে সহজ ভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। ওকে নিয়ে লিভিং রুমে আসলো ওরা। সোফায় বসিয়ে পেছন দিক থেকে ওর মাথায় পিস্তল ধরে থাকলো গিয়াসউদ্দিন। সামনে বসলো হাসীব আর ঈশান। হাসীব বলল, ‘আলিয়া রায়হানকে কেন মেরে ফেললেন, ওর সাথে আপনার কীসের শত্রুতা?’
‘এই মেয়ের নাম আলিয়া রায়হানা নাকি?’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘আগে শুনিনি কখনো।’
‘আহমেদ বোরহান সাহেব, আপনি একা আমরা তিনজন।’ বলল ঈশান, ‘আমরা তিনজনে যদি আপনাকে ধোলাই করতে শুরু করি, আপনি কী করবেন?’
‘কিছুই করতে পারবো না।’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘দুইজন হলে সামলানো যেতো। তিনজনের সাথে পেরে উঠা কঠিন।’
‘সুতরাং যা জিজ্ঞেস করা হবে তার সঠিক জবাব দেন।’ বলল হাসীব, ‘মেয়েটাকে মেরে ফেললেন কেন?’
‘আমি কন্টাক্ট কিলার।’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘কন্টাক্ট নিয়েছি, টাকা পেয়েছি। ক্লায়েন্টের কাজ করে দিয়েছি। আমি এই মেয়েকে পার্সোনালি চিনিনা।’
‘কার সাথে আপনার কন্টাক্ট হয়েছে?’
‘সত্যিকারের নাম বলতে পারবো না।’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘মনোহরিণী রাজকন্যা নামের একটা ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মেসেঞ্জারে আমার সাথে কন্টাক্ট করা হয়েছিল। মেসেঞ্জারেই ছবি দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় নিয়ে প্ল্যান করেছি, একদিন হাইওয়েতে তাকে আমি ঠুকে দিয়েছি।’
প্রথমে গিয়াসউদ্দিন, তারপর ঈশানের দিকে তাকালো হাসীব। আলিয়া হত্যাকাণ্ডের সাথে ঘটনাচক্রে ফেঁসে গিয়েছে- সেটা জানাতে মনোহরিণী রাজকন্যা যে রাতে নাইট ক্লাবে ডেকেছিল, মূলত সেই রাতেই সে বুঝতে পেরেছিল সেই মেয়েটায় মূল ক্রিমিনাল। মেয়েটার সত্যিকারের পরিচয় কি? সত্যিকারের পরিচয় হয়তো আহমেদ বোরহানের কাছ থেকেও পাওয়া যাবে না।
আহমেদ বোরহানের কথার ধারাবাহিকতায় হাসীব বলল, ‘যে পিস্তল দিয়ে গুলি করেছেন সেটা পেয়েছেন কীভাবে? পিস্তলটা তো ক্রিস্টল আই গ্রুপের সিইও ইয়াসিন যাহেরের।’
‘কার পিস্তল তা আমি জানি না।’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘সেটাও সেই মনোহরিণী রাজকন্যাই সরবরাহ করেছিল।’
‘তাহলে তো তাকে আপনার দেখার কথা, সামনা-সামনি সাক্ষাৎ না হলে সে আপনাকে পিস্তলটা দিলো কী করে?’
‘গিফট বক্সে করে।’ বলল আহমেদ বোরহান, ‘বোরখা পরিহিত একটা মেয়ে এসে গিফট বক্সটা সিকিউরিটি গার্ডের কাছে রেখে গিয়েছিল।’
‘ইয়াসিন যাহেরকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্য ছিল।’ বলল হাসীব, ‘কিন্তু মাঝখান থেকে ফেঁসে গেছি আমি।’
আহমেদ বোরহান এবার ভ্রু-কুঁচকালো। জানতে চাইলো, ‘আপনি কীভাবে ফেঁসে গেছেন?’
‘আরেহ্ মিয়া বুঝতে পারছেন না!’ কিছুটা ধমক দিয়ে বলল হাসীব, ‘যে গাড়িতে আলিয়াকে গুলি করেছেন সেই গাড়িটা ছিল আমার। আলিয়াকে পুলিশ আমার বউ বানিয়ে আমার নামে কেস করে দিয়েছে! সেই থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আমি এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছি!’
জোরে জোরে হেসে উঠলো আহমেদ বোরহান। বলল, ‘একেই বলে উদুর পিণ্ডি বুদুর ঘাড়ে!’
বন্ধুকে রেগে যেতে দেখে ওর ঘাড়ে হাত রেখে শান্ত করলো ঈশান। আহমেদ বোরহানকে বলল, ‘পেমেন্ট নিয়েছেন কীভাবে?’
জবাবে আহমেদ বোরহান বলল, ‘ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে।’
আবারও হাসীবের কাঁধে হাত রাখলো ঈশান। বলল, ‘পেয়ে গেছি বন্ধু, অপরাধী নিজের অজান্তেই প্রমাণ রেখে দেয়। বোরহান সাহেব, যে এ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ট্রান্সফার হয়েছে সেই এ্যাকাউন্টের নম্বরটা।’
‘স্যরি ভাই, আমি আমার ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা ফাঁস করি না।’
‘আমরা তিনজন আর আপনি?’
‘একা।’ বলল আহমেদ বোরহান। টি-টেবিলের উপর থেকে মোবাইল ফোনটা নিলো। বলল, ‘এ্যাকাউন্ট নম্বর দেবো, কিন্তু একটা শর্তে।’
‘কী শর্ত?’
‘আপনারা আমার ক্লায়েন্টকে ধরেন, ছেড়ে দেন- যা খুশি করেন। আমাকে আপনারা নিরাপদে ছেড়ে দিবেন।’
‘নম্বরটা বলেন।’
‘আমার শর্ত?’
‘শর্ত আমরা মানবো।’
ব্যাংকের মোবাইল ফোন এ্যাপ ওপেন করলো আহমেদ বোরহান। ওর ক্লায়েন্টের নম্বরসহ ট্রানজেকশনের স্ক্রিনশট নিলো। শেয়ারইট করে স্ক্রিনশট পাঠিয়ে দিলো। স্ক্রিনশট ওপেন করে সেটা হাসীবকে দেখালো ঈশান। ট্রানজেকশনের পরিমাণ, এ্যাকাউন্ট নম্বর এবং এ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম স্পষ্টভাবে লেখা আছে স্ক্রিনশটে। (চতুর্দশ পর্বে চলমান)।