সহযাত্রীনী | থ্রিলার ফিকশন | চতুর্দশ পর্ব
২৪ জুন ২০২৪
Naoroz Bipul
ফাইলের প্রত্যেকটা পাতায় সিগনেচার করলো ইয়াসিন যাহের। সিগনেচার শেষ করে ফাইলটা মিথিলার হাতে ফিরিয়ে দিলো। জরুরী কিছু ফাইল জমা হয়ে ছিল। সেগুলো সিগনেচার করার জন্যই অফিসে এসেছিল ইয়াসিন যাহের। সিগনেচার করা শেষে সে অফিস থেকে চলে গেলো।
ফাইল নিয়ে নিজের ডেস্কে আসলো মিথিলা। অফিস টাইম শেষ। ডেস্কে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলো সে। অফিস থেকে বের হলো। সামনের মোড় পর্যন্ত হেঁটে আসলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো ওকে। একটা সিএনজি অটোরিকশা আসতে দেখা হাত তুলে সেটাকে থামালো। দরদাম ঠিক করে সিএনজিতে উঠে বসলো সে। সিএনজি চালক একটানে ওকে এসে ওর এ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ালো। সিএনজি থেকে নেমে মিথিলা ভাড়া পরিশোধ করলো। ফ্ল্যাটে চলে আসলো। ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফ্রিজে থাকে রান্না করা খাবার বের করে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। লিভিং রুমের দিকে যাওয়ার পথে ওর ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজলো।
দরজার দিকে একবার তাকালো মিথিলা। এই সময়ে ওর বাসায় কারো আসার কথা নয়। হয়তো প্রতিবেশীদের কেউ এসেছে। আবার একবার কলিং বেল বাজলো। দরজায় এসে ডোর হোলে চোখ দিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। দরজা খুললো। সামনে হাসি হাসি মুখে হাসীবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হলো মিথিলা। সে কিছু বলার আগে হাসীব, ‘ওহ্, মিথিলা মিথিলা মিথিলা… মাই বেইবি, মাই সুইটহার্ট…’ দুই হাত বাড়িয়ে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরতে আসলো হাসীব।
দুই পা পিছিয়ে আসলো মিথিলা। বলল, ‘কী অসভ্যতা হচ্ছে এইসব! আমি আপনার সুইটহার্ট মানে কি?’
‘তোমার প্রেমে পড়ে গেছি বেইবি!’
এবার দুই হাত বাড়িয়ে মিথিলা কোমড় জড়িয়ে ধরলো হাসীব। নিজেকে ছাড়াতে দুইহাতে ওকে ধাক্কাতে লাগলো মিথিলা। হাসীব বলল, ‘এমন করতে হয় না বেইবি। প্রেমে তো পড়েই গেছি- এসো না বেইবি, আমায় একটু আদর করে দাও মাই মনোহরিণী রাজকন্যা!’
জোর করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ছাড়িয়েই নিলো মিথিলা। হাসীবের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলো। সে লক্ষ্য করলো হাসীবের বন্ধু ঈশান, আর আরেকটা ছেলে এসে ওর পেছনে দুই পাশে দাঁড়ালো। তৃতীয় এই ছেলেটাকে মিথিলা চিনে না। সে নিজের ওড়না ঠিকঠাক করে নিলো। হাসীবের দিকে তাকালো। বলল, ‘আচ্ছা, সবকিছু তাহলে তোমরা বের করেই ফেলেছো! কীভাবে?’
‘ক্রিমিনাল নিজের অজান্তেই তার ক্রাইমের কোনো না কোনো সূত্র রেখেই দেয়।’ বলল হাসীব। মোবাইল ফোন বের করলো। আহমেদ বোরহানের কাছ থেকে পাওয়া স্ক্রিনশট ওপেন করে, মিথিলার সামনে ধরলো। বলল, ‘নিজের এ্যাকাউন্ট থেকে কন্টাক্ট কিলারের এ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স ট্রান্সফার করে মারাত্মক ভুল করেছো।’
মিথিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাসীবের কথা শুনছে। ওর চেহারায় কোনো ধরনের অপরাধবোধ কিংবা অনুশোচনার ছায়াও দেখা যাচ্ছে না।
‘তোমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিন, গাড়িতে তোমার খুব কাছাকাছি বসে কথা বলেছিলাম।’ বলল হাসীব, ‘নাইট ক্লাবে সেই রাতে মনোহরিণী রাজকন্যা সেজে তুমি অন্ধকারে বসে থাকলে কী হবে, নিজের কন্ঠ তো আর লুকাতে পারবে না।’ মিথিলার কাছে গেলো হাসীব। ওর হাত ধরার জন্য হাত বাড়ালো।
নিজের হাত সরিয়ে নিলো মিথিলা। বলল, ‘এই খবরদার, আমাকে টাচ করবে না।’
‘এমন করো কেন বেইবি, দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না তোমার?’ মিথিলার পেছন দিক দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো হাসীব। লিভিং স্পেসের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘চলো, বসে কথা বলি।’
লিভিং স্পেসে নিয়ে এসে মিথিলাকে সোফায় বসালো হাসীব। সামনের সিঙ্গেল সোফায় বসলো সে। বলল, ‘বান্ধবী হিসেবে আলিয়া নিজের গোপন কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক। নাইট ক্লাবেও মনোহরিণী রাজকন্যা হয়ে বললে, আলিয়া তোমার বান্ধবী, সে তোমাকে অনেক গোপন কথা বলে। তারপর ধরা যাক, তোমার হাতের রিঙ…’
বাম হাত উঠিয়ে অনামিকা আঙ্গুলে পরা রিঙের দিকে তাকালো মিথিলা। চোখ তুলে তাকালো হাসীবের দিকে। হাসীব বলল, ‘আমার গাড়িতে বসে তোমার হাতে রিঙটা দেখেছি। সেই রাতে তুমি অন্ধকারে বসে থাকলেও, আলো এসে তোমার হাতে পড়েছিল তা লক্ষ্যই করোনি। সেই আলোতেই তোমার হাতে রিঙটা দেখেছি। তারপর অফিসে সেইদিন তোমার নম্বর নিতে গেলাম, তখনও তুমি সেইম রিঙ পরে ছিলে।’
হাসীবের কথার ধারাবাহিকতায় মিথিলা বলল, ‘সেইম রিঙ কি অন্য কেউ কিনতে পারে না নাকি?’
‘অবশ্যই পারে।’ বলল হাসীব, ‘কিন্তু ব্যাংক এ্যাকাউন্ট নম্বর তো আর সবার সেইম হবে না। তোমার এ্যাকাউন্ট নম্বর দেখেই তো সব পয়েন্ট জোড়া লেগে গেছে।’
আস্তে আস্তে হাতে কয়েকবার তালি দিলো মিথিলা। বলল, ‘ফ্যান্টাসটিক! গুড জব! কিন্তু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তুমি আদালতে গিয়ে, এইসব হাস্যকর পয়েন্ট কীভাবে প্রমাণ করবে?’
‘আমি করবো না তো! আব্দুল গফুর করবে।’ বলল হাসীব, ‘আব্দুল গফুরের হাতে তোমাকে হ্যান্ড ওভার করার আগে আমাকে একবার বলো- ঘনিষ্ট বান্ধবীকে মেরে ফেললে কেন?’
‘হ্যাঁ, আমিই আমার বান্ধবী আলিয়াকে মেরে ফেলেছি!’
হাসীবের টি-শার্টে লাগানো বোতাম ক্যামেরার এ্যাপ ওপেন করলো ঈশান। এ্যাপের মাধ্যমে ক্যামেরা অন করে দিলো। শুরু হয়ে গেলো মিথিলার ভিডিও রেকর্ডিং।
‘আমার রিকমেন্ডেশনে জব হয়েছিল আলিয়ার।’ বলল মিথিলা, ‘অথচ আমাকে ডিঙ্গিয়ে সে সিইওর সাথে এ্যাফেয়ার করে প্রমোশন পেয়ে গেলো! দিনের পর দিন আমাকে ফিজিক্যালি ইউজ করেছে আমার সিইও। কয়েক বার আমাকে গর্ভপাতও করতে হয়েছে। কিন্তু আলিয়াকে পেয়ে সে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমার প্ল্যান ছিল- আলিয়াকে মারবো, সিইওকে ফাঁসাবো। সেই উদ্দেশ্যেই সিইওর অনুপস্থিতিতে তার বাসা থেকে তারই পিস্তল চুরি করেছি। কন্টাক্ট কিলারকে দিয়েছি। কিলার তার কাজ ঠিকই করেছে। আমাদের সিইওর পরিবর্তে মাঝখানে ফেঁসে গেছো তুমি।’
‘পিস্তলের সিরিয়াল নম্বর নষ্ট করে দিয়ে তো আরেকটা ভুল করেছো।’ বলল হাসীব, ‘পিস্তলটা যে তোমার সিইওর সেটা তো সে স্বীকারই করবে না।’
‘আমি নষ্ট করিনি।’ বলল মিথিলা, ‘নষ্ট করেছে গর্দভের বাচ্চা আহমেদ বোরহান। হারামিটা পিস্তলের সিরিয়াল নম্বর নষ্ট করে আমার সব প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছে!’
‘নিখুঁত প্ল্যানই করতে পারোনি তুমি। ফলাফল, জব হারিয়ে তোমাকে এখন জেলে যেতে হবে, অথবা ফাঁসিতে যেতে হবে। সিদ্ধান্ত মহামান্য আদালতের।’
মোবাইল ফোন বের করলো কারীব। ফোন করলো পিবিআইয়ের এএসপি আব্দুল গফুরকে। সে তার টিম আসলে মিথিলাকে তার হাতে হ্যান্ড ওভার করলো ওরা। অসাধারণ দক্ষতার সাথে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে, আদালত থেকে নির্দোষ প্রমাণ করে নিয়ে আসলো ডিফেন্স লইয়ার ব্যারিস্টার নিম্নি সূবর্ণা। কন্টাক্ট কিলারকে খুঁজে বের করে তাকে সহ, মিথিলার নামে আলাদাভাবে কেস স্টার্ট করতে পিবিআইকে নির্দেশ দিলেন মহামান্য আদালত। (শেষ পর্বে চলমান)।